আমাদের দেশে একটি নতুন শিক্ষাপদ্ধতি চালু হয়েছে। এর একটি বিজ্ঞানসম্মত দিক হলো, পুরাতন পদ্ধতিটি দিয়ে আর চলা যাচ্ছে নাÑ অর্থাৎ সমাজকে অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না, আমরা ‘পিছিয়ে পড়া’র কাতারেই থেকে যাচ্ছি, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠছে না এবং অন্যান্য জাতি ও দেশ থেকে ক্রমাগত আরও পিছিয়ে পড়ছিÑ দেখেশুনে মনে হচ্ছেÑ এই বাস্তব সত্যটি রাষ্ট্রপ্রশাসনের উপলব্ধিতে এসেছে এবং ইতিবাচক তৎপরতা শুরু হয়েছে। এই তৎপরতাকে ১৮৩৬ সালের দিকে ব্রিটিশ কর্তৃক ভারতবর্ষের দেশীয় শিক্ষাপদ্ধতিকে বাতিল করে আমলাতান্ত্রিক প্রভুত্ব সৃষ্টির প্রকল্পের সাঁচে ফেলে রাষ্ট্র পরিচালনার অচলায়তন ভাঙার প্রচেষ্টা বলেও বিবেচনা করা
যায় এবং সামগ্রিক বিবেচনায় কাজটা একেবারে মন্দ নয়। কিন্তু কর্মপ্রয়োগের ক্ষেত্রে পদ্ধতির ব্যবহারটার ধরণ বদলে না গেলেই হলো, যেমনটা আমাদের দেশে হয়ে যায়। বহুনির্বাচনী প্রশ্নপদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছিল, ঘটানো হয়েছিল সৃজনশীলতা থেকে বিচ্যুতি। কারও হাতে আনাজ কাটার দা তোলে দিলে সে যদি মানুষ কাটতে শুরু করে, সে-ক্ষেত্রে দায়ের তো কোনও দোষ নেই, দোষ কর্তারূপী মানুষেরই। অস্ত্র ও শাস্ত্রের ব্যবহার মানবিকতা থেকে দানবিকতায় পর্যবশিত হলে আবির্ভূত দুর্গতি নাশের জন্যে দুর্গতিনাশিনী শক্তির আগমন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে, বিপ্লবকে ঠেকানো যায় না, অনিবার্য হয়ে উঠে। জানা কথা, একদিন তো সোজা পথে হাঁটতেই হবে, তো ক’দিন আগে সে-পথে হাঁটা শুরু করলে দোষ কী? জল ঘোলা করে পান করে নিজেকে গাধা প্রমাণিত করার কী দরকার?
নতুন শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে অনেক অনেক অভিযোগ। কেউ কেউ বলছেন, ইংরেজি মাধ্যমে যেমন ‘অনেক লেখাপড়া’ আছে এই নতুন শিক্ষাক্রমে তেমন ‘অনেক লেখাপড়া’ তো নেইই, বলতে গেলে, ‘নতুন শিক্ষাক্রমে কোনো লেখাপড়াই নেই’। চমৎকার! অভিযোগের মতো অভিযোগ বটে। কিন্তু অভিজ্ঞমহলের ধারণা এই যে, ‘অনেক লেখাপড়া’ করলেই হবে না, আসল কথা সৃজনশীল মানুষ হওয়া।
একটু খতিয়ে দেখা যাক। জানা কথা, নতুন শিক্ষাক্রমের আগের শিক্ষাক্রমটিতে ইংরেজি মাধ্যমের প্রাধান্য ছিল। প্রথম শ্রেণি থেকে ইংরেজি পড়ানো হতো। কিন্তু তার ফলে আমাদের দেশে শিক্ষার্থীনির্ভর, অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও শিক্ষার্থীকে সৃজনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে শিক্ষার্থীর মেধায় বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার শক্তি উজ্জীবিত করতে পারে এমন মানসম্মত সমাজ তৈরি হয় নি, বিপরীতে বিদেশের অনেক দেশেই যা হয়েছে এবং হচ্ছে। তাই প্রশ্ন থেকেই যায়, আমাদের দেশে হবে না কেন?
যদি পশ্চাদপদতা থেকে উত্তরণ চাই, তাহলে যথার্থ অর্থে নতুন শিক্ষাক্রমের প্রয়োগ অবশ্যই প্রয়োজন। সমালোচনার ধারালো চাকু দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রমের গলা কেটে পুরনো শিক্ষাক্রমের উমেদারি পরিহার করতে হবে, শিক্ষাকে পণ্য করে তোলার দালালি বর্জন করতে হবে। মূলকথা শিক্ষার্থীকে কেবল শিক্ষিত করে তোললে চলবে না, শিক্ষিত করার সঙ্গে সৃজনশীল মানুষরূপেও গড়ে তুলতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, ভবিষ্যতে সৃজনশীল মানুষেরাই বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে পারবে, উত্তরাধিকার বলে কোনও কীছু দুনিয়ায় গুরুত্ব বহন করবে না।