বড়ই অসুবিধার ভেতর রয়েছে তরুণরা। নিম্নমধ্যবিত্ত দরিদ্র তরুণরা মাদকাসক্ত হবে, ছিনতাই করবে, বসে বসে ঝিমুবে, পথেঘাটে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করবে, ভাড়া খাটবে, নগদ টাকা পেলে মানুষ খুন করতে রাজি হবে, এসবের কোনো কিছুই অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বিত্তবান গৃহের মেধাবী সন্তানরা যে জঙ্গি হয়ে পড়েছিল তার ব্যাখ্যাটা কী? বলা যাবে পরিবার ব্যর্থ হয়েছে। তা ব্যর্থ হয়েছে তো বটেই। পরিবার নিজেই তো আর পরিবার নেই। একান্নবর্তী পরিবার এখন কল্পকথা, তবে পরিবারও বিচূর্ণ হওয়ার পথে। যে-পরিবার নিজেই সন্ত্রস্ত, সন্তানদের সে সন্ত্রাসবিমুখ করবে কী করে?
মানুষের জীবনে সুখ নেই, স্বস্তিও নেই। রাষ্ট্র? রাষ্ট্র কি ব্যর্থ হয়েছে? না, হয়নি। মোটেই ব্যর্থ হয়নি। এই রাষ্ট্র ঠিক ঠিক তা-ই করছে, যা তার করার কথা। রাষ্ট্র পুঁজিবাদী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা গরিব মানুষকে মুক্ত করেনি, মুক্ত করেছে পুঁজিবাদকে। পুঁজিবাদ অবাধ বিকাশের উন্মুক্ত স্বাধীনতা পেয়ে গেছে। কথা ছিল সাম্য আসবে, সাম্যের প্রতিশ্রুতি ঠেলেঠুলে কোনোমতে নিজের জন্য একটা জায়গাও করে নিয়েছিল, সংবিধানে। এখন সাম্যের নামনিশানা নেই। এখন কেবল উন্নতি, এবং কেবলি বৈষম্য বৃদ্ধি। যত উন্নতি তত বৈষম্য। গরিব মানুষ মনে করে, মনে করতে বাধ্য হয় যে, এ রাষ্ট্র তাদের নয়। রাষ্ট্রকে তারা ভয় পায়, রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের দেখলে গুটিয়ে ফেলে নিজের মধ্যে নিজেকে। বলে দিতে হয় না, বুঝে নেয়। তাদের অবস্থা লজ্জাবতী লতার মতো, ¯পর্শভীতিতে সন্ত্রস্ত।
গরিব মানুষ জানে এ-রাষ্ট্রকে বদলানো তাদের সাধ্যে নেই। বিত্তবান ঘরের যে মেধাবী তরুণরা ঘর ছেড়ে বের হয়ে পড়েছিল এবং জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে, রাষ্ট্রের ওপর তারাও অত্যন্ত অসন্তুষ্ট, তাদের কাছেও এ রাষ্ট্র পছন্দের নয়, তারা চেয়েছে কল্পনার খেলাফতী রাষ্ট্র এবং তারা সেটা পাওয়া সম্ভব বলে মনে করে। তারা তাই ‘জিহাদ’-এ নেমেছিল এবং অন্ধ ও উন্মাদের মতো বিদেশি ও ভিন্ন ধর্মের মানুষদের জবাই করবে বলে ঠিক করেছে। এভাবে কী করে খেলাফত প্রতিষ্ঠা হবে সেটা জিজ্ঞাসা করার উপায় নেই, কারণ তাদের পাওয়া যাবে না এবং পাওয়া গেলেও তারা কোনো প্রকার আলোচনায় আসবে না। তারা হুকুম পেয়ে গেছে এবং হুকুম পালন করছে। তাদের কোনো ভয় নেই, কারণ তারা বিশ্বাস করে যে এ রকম অতিজঘন্য অপরাধ করে তারা সরাসরি বেহেশতে চলে যাবে এবং সেখানে অনন্তকাল ধরে মহাসুখে জীবন কাটাবে। গোপনে গোপনে এরা উগ্ররূপে ভোগবাদী। নকশালবাড়ির সঙ্গে এদের নৃশংসতার কিছুটা মিল আছে, কিন্তু পার্থক্যটা মৌলিক। নকশালবাড়ির তরুণরা যাদের শত্রু বলে চিহ্নিত করেছিল তারা ছিল জোতদার এবং অত্যাচারী, রাষ্ট্রের কাঠামোর সঙ্গে তাদের একটা যোগ ছিল। ধর্মীয় জঙ্গিরা যাদের হত্যা করছে তারা নিরীহ ও নিরপরাধ; রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের কোনো যোগ নেই, তাদের সরিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রকে কীভাবে বদলানো যাবে তার কোনো হদিশ নেই। এই জঙ্গিরা ধর্মান্ধ। ধর্মের নৈতিকতার ও সামাজিকতার দিক সম্পর্কে এরা মোটেই ওয়াকিবহাল নয়। ধর্মের নামে আদিকাল থেকে মানুষ হত্যা চলে আসছে, এদের কাজটা সেই ইতিহাসেরই নবীন সম্প্রসারণ। এরা প্রাচীন মানুষ, এসেছে আধুনিককালে, নতুন বেশে। বিপথগামী এই তরুণরা ভীষণ রকম পিতৃতান্ত্রিক এবং অসংশোধনীয় রূপে নারীবিদ্বেষী।
বোঝাই যাচ্ছে এদের মগজকে খুব ভালোভাবে ধোলাই করা হয়েছে। কিন্তু সে কাজটা কেন সম্ভব হলো? মন্ত্রণাদাতারা নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তারা কেন সফল হয়েছে? কারণ কী? কারণ হচ্ছে অভাব। আমরা একটি অভাবগ্রস্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। অভাব এখানে অনেক কিছুরই। সবচেয়ে বড় অভাব ন্যায়বিচারের। আইন আছে, প্রয়োগ নেই। জবাবদিহিতাকে হাঁকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে নির্বাচন হয়, ভোট ছাড়াই। জবরদস্ত সরকারি শাসন চালু থাকে, জনসমর্থনের আবশ্যকতা দেখা দেয় না। রাজনীতিকরা একে অপরকে নির্মম ভাষায় আক্রমণ করেন। সহনশীলতা কোথাও নেই, সবচেয়ে বেশি নেই শাসক শ্রেণির নিজের ভেতর। গণতন্ত্র এখানে প্রহসন, সাম্য কবরস্থ। মিথ্যাচার, প্রতারণা, ফাঁকিবাজি, জোরজবরদস্তি এখানকার মানুষের জন্য ওপরে উঠার সিঁড়ি। সহিংসতা এর আকাশে-বাতাসে। এখানে মানুষ অনেক, জায়গা অল্প। সর্বত্র কাড়াকাড়ি, ধাক্কাধাক্কি। প্রায় অমানবিক এই পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রভাব সবার ওপরেই পড়ছে, বিশেষভাবে পড়ছে সংবেদনশীল ও ¯পর্শকাতর তরুণদের ওপর। তারা আশা দেখে না, ভরসা পায় না।
তরুণরা দুঃসাহসী। তারা সঠিক আদর্শ চায়। সঠিক আদর্শটা আদতে একটা স্বপ্ন। মানুষ মাত্রেই স্বপ্ন দেখে, সবচেয়ে বড় স্বপ্নটা মুক্তির। মুক্তি ব্যক্তিরই; কিন্তু ব্যক্তির মুক্তি নিহিত থাকে সমষ্টির মুক্তির ভেতরে। বনে-জঙ্গলে কিংবা পাহাড়ে-পর্বতে যে মুক্তি পাওয়া যায় সেটা সাময়িক অনুভূতি ছাড়া কিন্তু অন্যকিছু নয়। সামাজিক মুক্তির স্বপ্নটা বৈজ্ঞানিক এবং আলোকোজ্জ্বল। জঙ্গিরাও মুক্তির স্বপ্ন দেখেছে, কিন্তু সেটা সমষ্টিগত মুক্তির নয়, ব্যক্তিগত মুক্তির। এরা বেহেশতের দুর্গম পথের দুঃসাহসী যাত্রী। একসঙ্গে চলেছে ঠিকই, কিন্তু প্রত্যেকের হিসাবটা তার নিজস্ব। তাদের আদর্শবাদিতার ভেতর ইহজাগতিকতা যেমন নেই, তেমনি নেই পুঁজিবাদবিরোধিতা। নিজেদের অজান্তে এরা পুঁজিবাদের পক্ষেই কাজ করছে। কোনো সন্দেহ নেই যে, জঙ্গিদের প্রধান শত্রু সমাজতন্ত্রীরাই। পারলে তাদের ওপর চড়াও হতো। সমাজতন্ত্রীরা এখন সামনে নেই, তাই নিজেদের মধ্যে তারা গৃহবিবাদ বাধিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশে এখন শিক্ষার বিস্তার উলেখযোগ্য; কিন্তু জ্ঞানের অনুশীলন সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। কারণ জ্ঞান ভালো পণ্য নয়। জ্ঞানদানের কথিত কর্মশালা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববিদ্যার চর্চা একেবারেই অকিঞ্চিৎকর। বিজ্ঞানের চর্চাও নেই। আছে সেসব দক্ষতায় শিক্ষিত করার ব্যবস্থা যেগুলোতে আয়-উপার্জনের সুবিধা হবে। এমন কি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও আজকাল অর্থকরী বিদ্যারই কদর বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার কাজ অতি সামান্য। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শূন্যের কোঠায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও লজ্জাকর রূপে স্বল্প। বইমেলাতে বইয়ের প্রচুর ছড়াছড়ি ঘটে, কিন্তু অধিকাংশ বইতেই জ্ঞানের কোনো ছাপ থাকে না, ছাপটা যেখানে থাকে সেখানেও সারবস্তু সামান্য। জ্ঞানহীন সাহিত্যচর্চায় না বাড়ছে সাহিত্যের মূল্য, না জ্ঞানের।
কেউ কি বিশ্বাস করবে যে, ইতিহাসের চর্চা বাদ দিয়ে জ্ঞানের চর্চা সম্ভবপর? কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষা কর্তৃপক্ষ মনে হয় সেটাই মনে করে। নইলে ইতিহাসের চর্চার প্রতি এমন উদাসীনতা কেন? ব্যাখ্যা অবশ্য আরও একটা আছে। সেটা হলো এই যে, কোনো দেশের শাসকশ্রেণিই ইতিহাস পছন্দ করে না, কারণ তাদের নিজেদের ইতিহাসটা গৌরবজনক নয়। শাসকরা তাদের নিজেদের বানোয়াট গৌরবের কাহিনিকেই জাতীয় ইতিহাস বলে চালিয়ে দিতে চায়। যখন পারে না তখন ইতিহাসচর্চার ওপরেই রুষ্ট হয়। ইতিহাস-উৎসাহী ইংরেজরাও আমাদের দেশে এসে কেবল তাদের ইতিহাসই যে অবশ্যপাঠ্য করে দিয়েছিল তা-ই নয়, আমাদের ইতিহাসকেও বিকৃত করে উপস্থাপন করেছিল। যেমন নবাব সিরাজউদ্দৌলার কাহিনি। সে বেচারা ইংরেজদের তাড়াতে চেয়েছিলেন, দখলদার ইংরেজ সে কাহিনিকে অবলুপ্ত করে দিয়ে সামনে নিয়ে এলো ওই যুবকটির কথিত চরিত্রদোষকে। এমন জোরেশোরে এনেছিল যে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পর্যন্ত তাদের বানানো গল্পটা বিশ্বাস না করে পারেননি।
কত বড়মাপের ঐতিহাসিক ছিলেন, স্যার যদুনাথ সরকার! কিন্তু অতীত ইতিহাসের চর্চা থেকে তিনি যখন সমসাময়িক ইতিহাসের বিবেচনায় চলে আসেন তখন তিনি শাসক ইংরেজের পক্ষে দাঁড়িয়ে যান এবং পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাবের পরাজয়কে মনে করেন ভারতবর্ষে এমন এক রেনেসাঁর সূচনা, যার কাছে ইউরোপীয় রেনেসাঁ তুচ্ছ। তিনি এটাও আমাদের জানিয়েছেন যে, ইংরেজের শাসন বাঙালিকে জাতি গঠনের জন্য উপযোগী ঐক্য সরবরাহ করেছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে স¤পূর্ণ উল্টো।
অতীতকে বুঝতে, বর্তমানকে ব্যাখ্যা করতে এবং ভবিষ্যৎকে গড়ে তুলতে হলে ইতিহাসকে উপেক্ষা করে এক পা-ও এগোনো সম্ভব নয়। শাসকদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য যে ইতিহাস তৈরি হয় চরিত্রগতভাবেই সেটা জনবিরোধী। এটা একটা সত্য। আরেকটা সত্য হলো এই যে, ইতিহাসের সত্য-উদ্ঘাটনের কোনো শেষ নেই। নতুন নতুন ব্যাখ্যা আসবে, পাওয়া যাবে নতুনতর তথ্য। ইতিহাসের জ্ঞান সমৃদ্ধ হতে থাকবে। এটাই নিয়ম। এবং তাতে বৃদ্ধি ঘটবে জ্ঞানের। জ্ঞান ভিন্ন সত্যের উন্মোচন নেই। জ্ঞানের ক্ষেত্রে অর্জন জাতীয় অগ্রগতির প্রাথমিক শর্ত। আদর্শের জন্য, মুক্তির জন্য তরুণদের সে পথেই হাঁটতে হবে। [সংকলিত]
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়