1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৫:২৪ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

কথার কথা বনাম কাজের কথা! :ড. মো. আব্দুল হামিদ

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৬ জুলাই, ২০২৩

বলুন তো আপনার জীবনে সবচেয়ে উপভোগ্য টক শো ছিল কোনটি? আজও কেন সেটা স্মৃতিতে রয়ে গেছে? সেটা কি আলোচকের ক্ষুরধার যুক্তি, প্রাঞ্জল উপস্থাপনা, শালীন বাক্যচয়ন বা সৌজন্যবোধের উৎকর্ষ প্রদর্শনের জন্য? খুব সম্ভবত না। এমন টক শো অধিকাংশের কাছে ম্যাড়মেড়ে লাগে। কিছুক্ষণ পর দর্শক আনমনে অন্য চ্যানেলে ঘুরতে যায়। কিন্তু হঠাৎ যদি দেখেন এক আলোচক আরেকজনকে বাক্যবাণে জর্জরিত করছেন কিংবা মাঝেমধ্যে শার্টের হাতা গোটাচ্ছেন, উপস্থাপক অতি কষ্টে তাকে ম্যানেজ করছেন। তবে সেই অনুষ্ঠানে আঠার মতো লেগে থাকবেন, তাই না?
পাঠক, এবার কি বুঝতে পারছেন যারা মুখ খুললেই দুর্গন্ধ বের হয়, যা বলেন তার পুরোটাই গার্বেজ তারপরও চ্যানেলগুলো কেন তাদের বারবার অতিথির আসনে বসায়? এর মূল কারণ হলো আপনার-আমার মতো দর্শকেরা মুখে অপছন্দের কথা বললেও কাজে তাদের সমর্থন করি! অনুষ্ঠান আয়োজকদের দরকার টিআরপি। যাদের হাজির করলে সেটা বাড়ে তারা তো সেই সব ব্যক্তিকেই আমন্ত্রণ জানাবে, তাই না? ফলে যদি সত্যিই কাউকে অপছন্দ করেন তবে তাকে এড়িয়ে চলাই উত্তম।
ক’দিন আগে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিতে আকস্মিক এক টক শো শেষ করতে হয়। খুব সম্ভবত হাত থাকতে শুধু ‘মুখের ব্যবহার’-এ তারা সন্তুষ্ট থাকতে পারছিলেন না! তবে এমনটা শুধু যে আমাদের দেশেই ঘটে তেমনটা নয়। লাইভ শো চলাকালে রাগ করে মঞ্চ থেকে নেমে যাওয়া, প্রতিপক্ষকে থাপ্পড় মারা, ধস্তাধস্তি করা, পিস্তল তাক করা, এমনকি পুরো সেট তছনছ করার ঘটনাও মাঝেমধ্যে দেখা যায়। আমাদের বিশেষ অঞ্চলের এমপি-মেয়র মুখোমুখি বসার পরে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে শুধু উপস্থাপক নয় বরং সেটের পুরো টিমকেই তটস্থ থাকতে হয়!
তবুও কথার নানা রকম প্রদর্শনী চলছে। কারণ বাঙালি কথা শুনতে পছন্দ করে। তা হোক জনসভার জ্বালাময়ী বক্তৃতা, ধর্মীয় আলোচনা কিংবা হকারের মজমা…কোনোটাই শোনার লোকের অভাব হয় না। যে বিষয়ে আলোচনা হয় দর্শক-শ্রোতা সেটা বিশ্বাস না করলেও শুনতে থাকেন। অনেকে আবার নিতান্তই বিনোদন পাওয়ার জন্য সেগুলো দেখেন। হয়তো সে কারণেই এমন আলোচকদের সমন্বয়ে প্যানেল করা হয় যারা একপর্যায়ে প্রতিপক্ষের ওপর চড়াও হতে পারে। সেটা না হলেও অন্তত অন্য পক্ষকে ‘ধুয়ে দেয়া’র সক্ষমতা রয়েছে। ফলে আজকাল নিরেট ভদ্রলোক, বিনয়ী, অযৌক্তিক কথা বলেন না…এমন আলোচকদের বাজার মন্দা। ক্রমেই কথা কারিগরদের স্থান দখল করছে যুদ্ধংদেহী মনোভাবের বাচালরা।
যা হোক, ম্যাজিক, সার্কাস, ফ্যাশনের মতো বিষয়গুলোতে ‘শো’ খুব স্বাভাবিক ঘটনা। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিশেষ দক্ষতা আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপনের বা প্রদর্শনের জন্যই তেমন আয়োজন করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর বিকাশলগ্নে হঠাৎ করেই ‘টক শো’ বেশ জনপ্রিয় পণ্যে পরিণত হয়। স্বল্প সময়ে কিছু মানুষের ‘কথা বলার দক্ষতা’ দারুণ গ্রহণযোগ্যতা পায়। তখন ‘খবর’-এর পরেই সচেতন মানুষদের বিনোদনের প্রধান উপকরণ হয়ে ওঠে বিভিন্ন চ্যানেলের মধ্যরাতের টক শো।
চাহিদার উত্থান-পতন খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ফলে টক শো তো বটেই এমনকি টিভি চ্যানেলগুলোর দাপটও কয়েক বছরের মধ্যে ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। এখন দেশে ঠিক কতটা চ্যানেল আছে, তাও আমরা জানি না। এমতাবস্থায় সেসব চ্যানেলে প্রচারিত বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানের কথা আলাদাভাবে খেয়াল করার কারণ নেই। তাই খুব ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ টক শোর ব্যাপারে আয়োজক ও আলোচক ছাড়া অন্য কেউ আগ্রহ দেখায় না। মাঝেমধ্যে অবশ্য উত্তেজনা ছড়ানো দু-তিন মিনিটের ‘কাটপিস’ ভাইরাল হয়। সেগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়ায়। তখন সেগুলো অনেকেই দেখে। সে ব্যাপারে আলোচনা-সমালোচনাও চলে কয়েকদিন।
মিডিয়া বিস্তারের এই যুগে নিয়ন্ত্রিত, পক্ষপাতদুষ্ট, গৎবাঁধা ফরম্যাটে চলতে থাকায় সাধারণ টিভি চ্যানেলগুলো আকর্ষণ হারিয়েছে। অসংখ্য চ্যানেলে প্রবেশাধিকার হাতের মুঠোয় থাকার পরও আজকাল মানুষ সেগুলোতে খুব একটা মনোযোগ দেয় না। এমন পানসে পরিস্থিতিতে বিকল্প প্লাটফর্ম হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর লাইভ অনুষ্ঠানগুলো। তবে সেখানেও ক্রেডিবিলিটি বজায় রেখে, মানসম্মত অনুষ্ঠান প্রচারের সংখ্যা বেশ কম। শুরুর দিকে যারা এমন উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাদের হাতে গোনা কয়েকজন ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পেরেছেন। অন্যেরা সাময়িক ক্রেজ সৃষ্টি করে দ্রুতই হারিয়ে গেছেন। তবে আজকাল ব্যক্তি উদ্যোগে নিজের কথা বলার মতো চ্যানেলও নেহাত কম নয়। তাদের কেউ কেউ খুব ভালো করছেন। অন্যেরা কোনো রকমে টিকে থাকার সংগ্রাম করছেন।
এ প্রসঙ্গে দুটো অভিজ্ঞতা বর্ণনা করি। অনুষ্ঠানের হোস্ট একসময় নামকরা এক টিভি চ্যানেলে উপস্থাপনা করতেন। এমনকি বিশেষ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানেরও উপস্থাপক ছিলেন। তিনি ইন্টারভিউ করছিলেন হেভিওয়েট এক অতিথিকে, যার সমগ্র ক্যারিয়ারে রয়েছে ঈর্ষণীয় সব সাফল্য। এখনো অতিগুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকরণ করছেন। কিন্তু সেই লাইভ চলাকালে বিস্ময়করভাবে লক্ষ করলাম মোট চারজন দর্শক সেটা দেখছে! অন্য একদিন দেশের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের একজনের নিজস্ব চ্যানেলে শো চলাকালে আমিসহ তিনজন দর্শক ছিলাম! অথচ কিছু চ্যানেলে ভিডিও আপলোডের পর ঘণ্টায় লক্ষাধিক ভিউ হয়। তাদের কিছু ভিডিও মানুষ কয়েক মিলিয়ন বার দেখেছে! এবার বলুন, কেন এমন পার্থক্য হয়?
ছাত্রজীবনে বক্তৃতা-বিতর্কে যুক্ত থাকার কারণে কোনো বক্তা যদি গ্রহণযোগ্যতা পায় তবে তাকে বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করি। পাবলিক স্পিকিংয়ে ভরাট কণ্ঠ, প্রমিত উচ্চারণ, সুন্দর চেহারা, কাব্যিক উপস্থাপনা কোনো কিছুই সেভাবে কাজ করে না। যদি তাই করত তবে আবৃত্তি শিল্পীরা সবচেয়ে জনপ্রিয় বক্তা হতেন। বাস্তবে তা হয় না। তার মানে এগুলোর বাইরে আরো কিছু বৈশিষ্ট্যের দরকার হয়। এককথায় সেটা হলো জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলন।
অর্থাৎ যাদের সামনে কথা বলা হচ্ছে ওই বিষয়ে তারা যা শুনতে চায় তা বলতে পারার স্ব-ক্ষমতা। পাশাপাশি বক্তার বিশ্বাসযোগ্যতাও খুব দরকার। দেশের ভেতরে বসে দু-একজন সাহস করে সেভাবে বলছেন। লোকে তাদের কথা শুনছে। তবে যারা দেশের বাইরে বসে বলছেন, তারা একটু বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন। দেশের মূলধারার গণমাধ্যম যে কথাগুলো বলছে না বা বলতে পারছে না, তারা সেগুলো বলায় দর্শক গোগ্রাসে গিলছে। আকর্ষণীয় শিরোনাম ও ছবির ব্যবহারে তারা সহজেই দর্শকদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হচ্ছেন। ফলে তাদের দর্শক-শ্রোতার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ছে।
তবে ওয়ান ম্যান শোর একটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো সৃজনশীলতা। নিত্যদিন নতুন তথ্য, ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ হাজির করা মোটেই সহজ কাজ নয়। ফলে উঠতি টিকটকারদের মতো তাদের আকর্ষণও ফিকে হতে থাকে। অনেকে দর্শকের অভাবে কিছুদিন পর রণেভঙ্গও দিচ্ছেন। যারা সক্রিয় আছেন তাদের অনেকেই দিনে কয়েকবার ভিডিও ছাড়ছেন। ফলে নিজের কথার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। মাঝেমধ্যে তাদের ব্যক্তিগত ভালো লাগা-মন্দ লাগা, অনুরাগ-বিরাগ তীব্রভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ছে। তাছাড়া বৈচিত্র্যহীনতা বা একঘেয়েমির ব্যাপার তো আছেই।
আজকাল চারপাশে অনেক কথা হচ্ছে। ইউটিউব বা ফেসবুকে মাঝেমধ্যে মনে হয় সবাই বুঝি কথা বলছে। তবে সেগুলোর অধিকাংশই কথার কথা বা বাজে কথা। সেগুলোর পেছনে অসংখ্য মানুষের মেধা, শ্রম ও সময় নষ্ট হচ্ছে। কেউ কেউ কথা বলার এই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বা খারিজ করে দিতে পারেন। বলতে পারেন, কথা দিয়ে আদৌ কি কোনো কাজ হয়? অবশ্যই হয়। তার বড় প্রমাণ হলো মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র। সেখানকার অন্তর্নিহিত ম্যাসেজ প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা মুক্তিকামী মানুষকে প্রেরণা জুগিয়েছে, স্বপ্ন দেখার সাহস দিয়েছে। এমন দরকারি কথা যারা বলবেন তাদের কণ্ঠ বা ভাষার চেয়ে দিন শেষে মেসেজটা বড় হয়ে উঠবে।
তাই হাতের মুঠোয় দামি ফোন আর তাতে লাইভ করার সুযোগ থাকলেই কথা বাণিজ্যে নামা ঠিক হবে না। নামলেও প্রত্যাশিত সফলতা পাওয়া যাবে না। মনে রাখবেন, কাস্টমার খুব স্বার্থপর। যেকোনো পণ্যে প্রথমেই তাদের লাভ খোঁজে। তাই আপনার কথাপণ্যে দৃশ্যমানভাবে তাদের অভাব মোচনের মতো উপাদান থাকতে হবে। নইলে আপনি যেই হোন না কেন, তারা আপনাকে এড়িয়ে চলবে। দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আলোচক এরই মধ্যে নিজেদের ‘ক্রেডিবিলিটি’ হারিয়েছেন। তাদের অনেকের আলোচনা নিতান্তই বাজে কথায় পরিণত হয়েছে। তাই যদি বলতে চান তবে কাজের কথা বলুন। নইলে চুপ থাকাই শ্রেয়।
[ড. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও ‘মস্তিষ্কের মালিকানা’ বইয়ের লেখক]

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com