এই নিবন্ধে আলোচিত কিছু প্রসঙ্গকে অপ্রিয় বলার একাধিক কারণ আছে। প্রথম কারণ, বিষয়টির এমনই জগাখিচুড়ি অবস্থা যে এ নিয়ে আলোচনা করতে আমার নিজেরও ভালো লাগে না। আমি স্বচ্ছন্দ বোধ করি না। দ্বিতীয় কারণ, বিষয়টি সম্পর্কে আমার ভাবনা গণমাধ্যমের অনেকেরই ভালো না-ও লাগতে পারে। তৃতীয় কারণ, রাষ্ট্রযন্ত্র বিষয়টিতে বিব্রত বোধ করে, যা আমার কাছে গৌণ মনে হলেও উপেক্ষণীয় নয়। তারপরও কিছু কথা বলা দরকার মনে করি। এর একমাত্র কারণ, আমার ৩০ বছরের বেশি সাংবাদিকতা জীবনের যৎকিঞ্চিৎ বোধ এবং অভিজ্ঞতার তাড়না।
দুই.
এ বিষয়ে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখন বিপদগ্রস্ত। শুধু আমাদের দেশে কিংবা নির্দিষ্ট অন্য কোনো দেশে নয়, সারা পৃথিবীতে। আমাদের দেশের পরিস্থিতি স¤পর্কে আমরা সবাই জানি। পৃথিবীর অবস্থা স¤পর্কেও একেবারে অজ্ঞাত নই। তবে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বক্তব্য পৃথিবীর পরিস্থিতি স¤পর্কে আমাদের আরও ¯পষ্ট ধারণা দেয়। তিনি বলেছেন, বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আক্রমণের মুখে রয়েছে।
এ বছর বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় জাতিসংঘের মহাসচিবের এই বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। ওই বার্তায় তিনি আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। যেমন ‘আমাদের সব স্বাধীনতা নির্ভর করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের ভিত্তি, মানবাধিকারের প্রাণশক্তি’ প্রভৃতি। এ কথাগুলোর তাৎপর্য প্রথমত অনুধাবন করা দরকার শাসক ও রাজনীতিকদের। তারপরই অনুধাবন করা দরকার স্বয়ং গণমাধ্যমের।
শাসক ও রাজনীতিকদের অনুধাবন করা দরকার। কারণ, তাঁরা যেন রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো পর্যায়েই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করেন, যা বর্তমানে পৃথিবীজুড়েই করা হচ্ছে। আর গণমাধ্যমের অনুধাবন করা দরকার নিজের স্বাধীনতার মহামূল্য বহুমাত্রিকতা বোঝার জন্য। এটা বোঝার সামর্থ্য যদি গণমাধ্যমের না থাকে (অধিকাংশের নেই বলে আমার ধারণা), কিংবা অর্জন করতে না পারে, তাহলে তার স্বাধীনতাই বুমেরাং হয়ে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার বিঘিœত করতে পারে। স্বাধীন গণমাধ্যম কখনো পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে না। স্বাধীন গণমাধ্যম কারও প্রতি অনুরাগ-বিরাগেরও অনুবর্তী হতে পারে না। এগুলো কোনো আপ্তবাক্য নয়।
তিন.
বর্তমানে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- বিশালায়তন ও ভগ্নস্বাস্থ্য। সর্বশেষ সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে এখন দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ১ হাজার ২৭৯টি। এর মধ্যে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় ৫০৪টি। ৭৭৫টি প্রকাশিত হয় ঢাকার বাইরে থেকে। দৈনিক ছাড়াও অর্ধসাপ্তাহিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক এবং বার্ষিক পত্রিকা মিলে এ সংখ্যা ৩ হাজার ১৭৬। সেদিন কথায় কথায় একজন সংবাদকর্মী বললেন, জনসংখ্যার তুলনায় দেশে পত্রপত্রিকার সংখ্যা কম। এ বিষয়ে আলোচনা কিংবা মন্তব্য নি®প্রয়োজন মনে করি। আপাতত দৈনিক পত্রিকাগুলোর বিষয়ে কিছু কথা বলি।
জাতীয় প্রেসক্লাবের মেম্বারস লাউঞ্জে প্রতিদিন সকালে শখানেক দৈনিক পত্রিকা আসে। এর মধ্যে বাংলা, ইংরেজি মিলিয়ে বড়জোর গোটা বিশেক (সংখ্যাটা বোধ হয় বাড়িয়েই বলছি) পঠিত হয়। এই পঠিতব্য পত্রিকাগুলো খুঁজে নেওয়ার সময় অন্যগুলোর নাম এবং সুরত (চেহারা নিয়ে কথা বলাটা বর্ণবিদ্বেষ বলে না ভাবার জন্য অনুরোধ রইল) নিয়ে কখনো কখনো কারও কারও মন্তব্যে লাউঞ্জে কিঞ্চিৎ হাস্যরসের সৃষ্টি হয়।
তবে সেটি বড় কথা নয়, কথা হলো – এই যে পত্রিকাগুলো প্রকাশিত হয়, অনেকে এগুলোকে বলেন, পাঠককুলের কাছে জঞ্জাল। এর অনেকগুলোর কোনো অফিস নেই। ২-৪ জন থেকে ৮-১০ জন কর্মী (নিঃসন্দেহে সাংবাদিক) হয়তো আছেন। স¤পাদক-প্রকাশক তো থাকবেনই। আর আছেন জেলা-উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত তাদের কার্ডধারী প্রতিনিধি। বলা বাহুল্য যে দেশের বিভাগীয় শহর এবং জেলা-উপজেলায় ছড়িয়ে আছেন আরও অসংখ্য সংবাদকর্মী, যাঁরা ঢাকার বাইরে থেকে প্রকাশিত ৭৭৫টি দৈনিকের কার্ডধারী প্রতিনিধি।
এই গণমাধ্যমের যাঁরা উদ্যোক্তা, তাঁরা কি স্বাধীনতা বুঝে এসব গণমাধ্যম সৃষ্টি করেছেন যে স্বাধীনতার কথা ওপরে বলা হয়েছে? নাকি সৃষ্টি করে স্বাধীনতা চাইছেন? নাকি স্বাধীনতা নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথাই নেই? গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অর্থ তাঁদের কাছে কী? আমাদের গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা, সাংবাদিক ইউনিয়ন, প্রেসক্লাব, সুশীল সমাজ – যাঁরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে উচ্চকিত, এদের নিয়ে তাঁদের ভাবনা কী? তাঁরা যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলেন, এর মধ্যে কি এগুলোও অন্তর্ভুক্ত? এই গণমাধ্যম কি গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব নিতে পারবে?
তবে এরা কিন্তু প্রভাবশালী। কারণ ওই যে গণমাধ্যম। সাংবাদিক। সেই প্রভাব। তা ছাড়া, অন্য রকম প্রভাবও আছে। না থাকলে তো পত্রিকার ডিক্লারেশনই পেতেন না। সুতরাং একাধারে প্রভাবশালী এবং বিশৃঙ্খল বিপুলায়তন একটি গণমাধ্যমকে স্বাধীনতা দিয়ে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার কিংবা মানবাধিকার নির্বিঘœ রাখা, অনুরাগ-বিরাগের অনুবর্তী না হয়ে পক্ষপাতহীন হয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জটা আমার বেশ বড়ই মনে হয়।
চার.
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার এ বছর গণমাধ্যমের স্বাধীনতার যে সূচক প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬৩তম। প্রাপ্ত নম্বর ১০০-এর মধ্যে ৩৫ দশমিক ৩১। এই সূচক ছাড়াও বাংলাদেশের পরিস্থিতি বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না।
এই পরিস্থিতির সুযোগে স্বাধীনতার সূচকে এগিয়ে থাকা, বিশ্বব্যবস্থায় প্রভাবশালী, উন্নত কোনো কোনো দেশ আমাদের দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু তাদের দেশের প্রায় স্বাধীন ও মুক্ত গণমাধ্যমেরই বা অবস্থা কী?
আমরা চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের খবরাখবরের দিকে একটু নজর দিতে পারি। পৃথিবীর কোন গণমাধ্যম এই যুদ্ধের বিষয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বিশ্বাসযোগ্য খবরাখবর প্রকাশ করছে? আমি অন্তত এখন পর্যন্ত এমন কিছু দেখতে পাইনি। রাশিয়ার গণমাধ্যম সে দেশের কর্তৃপক্ষের সুরে সুর মেলাচ্ছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমও একই কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে ইরাক যুদ্ধের কথাও উল্লেখ করা যায়। ইরাক আক্রমণের জন্য আক্রমণকারী শক্তি যেসব গল্প ফেঁদেছিল, তা সমগ্র পৃথিবীর জনমানসে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে সেই সব দেশের গণমাধ্যম, যারা মুক্ত। যাদের স্বাধীনতা আছে। এগুলো ভুয়া তথ্য প্রচার করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। সেই সব গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কল্যাণে কোন কাজে লেগেছে? যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান এ বছর বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের প্রাক্কালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, ভুয়া তথ্য, অপপ্রচার এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও সাংবাদিকতার প্রতি ক্রমবর্ধমান হুমকি সৃষ্টি করছে। কথাটি বলা হয়েছে সেই সব দেশ স¤পর্কে, যেখানে গণমাধ্যম মুক্ত নয়। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই। কিন্তু আমরা জানি (নিশ্চয়ই তারাও জানে এবং বোঝে) কথাগুলো তাদের মতো উন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রেও সমানভাবে সত্য।
পাঁচ.
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘ মহাসচিবের বার্তাটি পড়তে পড়তে মনে পড়ল জুলিয়ান পল অ্যাসাঞ্জের কথা। মুক্ত গণমাধ্যমের পশ্চিমা ধ্বজাধারীরা এই সাংবাদিককে এক দশকের বেশি সময় ধরে বন্দী জীবন কাটাতে বাধ্য করছে। তাঁর অপরাধ, নিজের প্রতিষ্ঠিত প্ল্যাটফর্ম উইকিলিকসে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে পাওয়া আমেরিকার বেশ কিছু গোপন নথি প্রকাশ করেছেন। মুক্ত গণমাধ্যমের ধারণা অনুযায়ী, হ্যাক করা হয়তো অপরাধ। সে জন্য আমেরিকা অ্যাসাঞ্জের বিচার করতে বদ্ধপরিকর। কোনো আবেদন-নিবেদনই কানে তুলতে রাজি নয় দেশটি।
সরকারি অফিসে ঢুকে ফাইল থেকে গোপনীয় তথ্যসংবলিত কাগজপত্র হাতানোও কোনো সাংবাদিকের ক্ষেত্রে বোধ করি হ্যাকিংয়ের পর্যায়েরই অপরাধ। হ্যাকিংয়ের মতোই চুরি করে তথ্য সংগ্রহ করাও সাংবাদিকের কাজের স্বীকৃত পদ্ধতি নয়। এমনকি সাংবাদিক আন অথরাইজড কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতে পেলেও তা অথরাইজড বা অফিশিয়াল না করে প্রকাশ করতে পারেন না। কেননা, সাংবাদিককে তথ্যের সূত্র বলতে হয়। কোনো তথ্য চুরি করে পাওয়ার কথা তো বলা যায় না। বলা হয়ও না।
বলা হয় সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া প্রভৃতি; অর্থাৎ নির্ভেজাল মিথ্যা কথা বলা হয়। তাতে কর্তৃপক্ষের কাছে হয়তো সাংবাদিকের ওজন বাড়ে। কিন্তু সাংবাদিকতা হয় কি?
তাই এসব বিষয় নিয়ে না ভেবে, কিংবা নিজেদের মতো ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে মুক্ত গণমাধ্যম, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার দাবি তুললে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক