:: সুখেন্দু সেন ::
আজকের এই খাটখোট্টা রোদ, ব্যস্ত জন চলাচল, যানজট দেখে বুঝার উপায় নেই মাত্র ক’দিন আগেই এখানে মানুষ হাবুডুবু খাচ্ছিলো বানের জলে। শহরের রাস্তার উপর দিয়ে চলছে ইঞ্জিনের নৌকো। কোথাও গলাজলে, কোথাও সাঁতরে গেছে মানুষ এখান থেকে ওখানে। শহরের এমন কোনো ঘরবাড়ি নেই যেটি বানাক্রান্ত হয়নি। কিঞ্চিত হয়তো অক্ষত থেকেছে কিন্তু বানের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ছে কমবেশি। কারো একেবারেই শেষ হয়ে গেছে সবকিছু। ঘরটা হয়তো আছে কিন্তু জিনিষপত্র গেছে সবই। মানুষের এমন সর্বস্বান্ত হওয়ার চিত্র অনতি অতীত কেবল নয়, সুদূর অতীতেও দেখা যায় নি। একাত্তরের শরণার্থী জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার দুর্দশাচিত্র আবার যেন কিছুটা হলেও পরিলক্ষিত হলো দু’হাজার বাইশে এসে।
প্রথম তিন দিন এ বানভূমি কী অসহায় ছিল তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কে বুঝতে পারে। বিদ্যুৎহীন, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অসহায় মানুষের ব্যাকুল আর্তি আঁধারেই মিলিয়ে গেছে কেবল। শহরের যদি এ অবস্থা হয় তবে গ্রামাঞ্চলে কী দুরবস্থা হয়েছে তা অনুমান করাও কঠিন। আশ্রয় নেবার মতো কোনো শুকনো ঠাঁইও কোথাও ছিলো না। যেভাবেই হোক প্রাথমিক বিপর্যয় মানুষ কাটিয়ে উঠেছে। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সীমাহীন।
ভাটিবাংলায় বানে জলে অভ্যস্ত মানুষ। তবে এমন ভয়াবহতা এর আগে আর প্রত্যক্ষ করা যায় নি কখনও। মানুষের প্রাণ গেছে। গবাদিপশু ভেসে গেছে। বৈশাখের অকালবানে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক যুদ্ধ করে যে কিছু ফসল গোলায় তুলে ছিলো, গোলাতেই তা ডুবে গেল। স্মরণকালে এমন ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়নি মানুষের।
ত্রাণ আসছে সরকারিভাবে, প্রাতিষ্ঠানিক, ব্যক্তিগত, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় সংগঠন থেকে। বিতরণও হচ্ছে প্রচুর। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, র্যাবসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজন, বিভিন্ন সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী, ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে দুর্গত মানুষের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন যা এক অভূতপূর্ব নজির সৃষ্টি করেছে। মানুষ বাঁচতে পারছে। এমন দুর্যোগে মানুষের প্রতি মানুষের এমন সহানুভূতি, এটিও কম কথা নয়।
তবে এখানেই শেষ নয়। সাময়িক ত্রাণ হয়তো মানুষকে সাময়িকভাবে রক্ষা করেছে কিন্তু সামনে আরও কঠিন অবস্থা আরও দীর্ঘ সংগ্রাম অপেক্ষা করে আছে। মানুষকে ত্রাণমুখী না করে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিয়ে মানুষের সে জীবন সংগ্রামে সহায়তা দেয়াটাই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নিশ্চয়ই মানুষ ঘুরে দাঁড়াবে আবার। আবার নতুন করে সাজাবে জীবন।
বছর বছর বান, অকাল বান, কয়েক বছর পরপর মহাপ্লাবনের মহাভোগান্তির অভিজ্ঞতা আছে আমাদের। আর কতো অভিজ্ঞতা হলে আমরা পাবো বন্যা সমস্যার একটা কার্যকরী সমাধান। পাকিস্তান আমল থেকেই বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধান ছিল পূর্ববাংলাবাসীর প্রাণের দাবি। ছয়দফা, ছাত্রসমাজের ১১ দফার মধ্যেও দাবিটি অন্তর্ভুক্ত ছিলো। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের কোন পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে কি-না জানা নেই। বন্যায় আক্রান্ত হলে কেউ কেউ ভারতীয় পানি, সীমান্তের ওপার থেকে পাহাড়ি ঢল ইত্যাদি বয়ান এবং ত্রাণের মহড়ায়, কিছু প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাসেই পবিত্র দায়িত্ব সম্পাদন করেন।
পাহাড়ি ঢল নিম্নমুখি হবেই। উজানের পানি ভাটির নিম্নাঞ্চল প্লাবিত করবেই। সেই পানি এদেশে প্রবাহিত হয় বলেই নদীর সৃষ্টি। আমাদের দেশ নদীমাতৃক বলে পরিচিত। এখন দেখতে হবে সে নদীগুলো পানি ধারণে কতটুকু সক্ষম। সমতলে অবাধ পানি প্রবাহের ধারাগুলো সচল আছে কি-না। যত্রতত্র বাঁধ, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার নামে অপরিকল্পিত সড়ক নির্মাণ, খাল ভরাট করে আমরা নিজেরাই বন্যার মতো দুর্যোগ ডেকে আনছি কি-না তাও ভেবে দেখার বিষয়।
জলবায়ুর পরিবর্তন হয়েছে। বিশ্বব্যাপী এ এক অশনিসংকেত। ঋতুগুলোও এখন আর সঠিক আচরণ করছে না। বিশ্বের সর্বত্রই কোথাও অকাল বন্যা, কোথাও খরা এসকল প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই পরিবর্তিত অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক, স্থানীয়ভাবে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমেই স্থায়ী সমাধান সূত্র বের করতে হবে।