1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৪০ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

কমরেড শ্রীকান্ত দাশ ও কিছু কথা

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২১

:: তরুণ কান্তি দাস ::
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হাওরবেষ্ঠিত প্রত্যন্ত অঞ্চল শাল্লা উপজেলার ৩নং বাহাড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত মাতৃস্বরূপ ‘দাড়াইন’ নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত আঙ্গারুয়া গ্রাম। এই গ্রামের বাসিন্দা শ্রীকান্ত দাশ ছিলেন ছিপছিপে গড়নের একজন শান্ত স্বভাবের চিন্তাশীল লোক। নদীর যেমন লক্ষ্য থাকে সব বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে সাগরে মিশে যাওয়া; ঠিক তেমনি শ্রীকান্ত দাশও ছিলেন নদীর মতই শান্ত কিন্তু ধাবমান। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নিয়েও সাংসারিক অভাব-অভিযোগ তাঁকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি। হাওর এলাকায় জন্ম নিয়ে হাওরের মতোই উদার ছিল তাঁর মানসিকতা। রাশিয়াসহ সারা বিশ্বে যখন সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি সংস্কারের ঝড় উঠে তখনও কিন্তু তিনি কমিউনিস্ট ত্যাগ করেননি। আমরা লক্ষ্য করেছি, মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বিশ্বাস করতেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব একদিন সফল হবেই।
ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, জাতীয় দিবসগুলোতে তিনি মেয়ে-ছেলেসহ সদরের (শাল্লা) সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। ‘কাউয়ায় ধান খাইলরে খেদানোর মানুষ নাই…’ গানটি তৎকালীন সময়ে খুব আলোড়ন সৃষ্টি করছিল। গণসঙ্গীত “নিক্সন দেখরে চাহিয়া, ভুট্টো দেখরে চাহিয়া বাংলার মানুষ ঘুমে নাইরে উঠছে জাগিয়া” গানটি আমার কাছে খুব লাগতো।
৪র্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় যাত্রাপুরের নাট্যমোদী কতিপয় ব্যক্তির উদ্যোগে “হত্যার প্রতিশোধ” নামক নাটকটি মঞ্চায়নের ২/১ ঘণ্টা পূর্বে একজন শিল্পীর অভাব থাকায় প্রাক্তন মেম্বার প্রয়াত গোপেন্দ্র চন্দ্র দাস আমাকে নির্বাচন করে চালিয়ে যাবার প্রস্তাব করলে আমিও লোভ সংবরণ করতে না পেরে রাজি হয়ে গেলাম। গান শেষে সবাই আমার অভিনয় ও সংগীতে খুশি। বিশেষ করে শ্রীকান্ত বাবু এমনভাবে উৎসাহ দিলেন যেন ইচ্ছা করলে আমি অনেক কিছু করতে পারবো বলে তাঁর বিশ্বাস ছিলো।
সম্মানিত পাঠক, ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে যখন ৫ম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষায় গিরিধর কেন্দ্রে যেতাম তখন আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকবৃন্দের গিরিধর হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা বাবু মহেন্দ্র মাস্টার, রামকৃষ্ণ পরমহংস ব্রহ্মচারী উপেন্দ্র বাবু, কমরেড মণি সিংহ’র ভাব শিষ্য ও সংগ্রামী সত্যেন সেনের সাথী উদীচী শিল্পী শ্রীকান্ত দাশ, ঋষিকেশ মজুমদার, রামানন্দ দাসসহ অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিগণের আলোচনায় মুগ্ধ হয়ে যেতাম।
আজকের শিক্ষার হার এবং ঐ সময়ের শিক্ষার হারের মধ্যে তুলনা চলে না। আমরা ঐ বছরে সারা শাল্লা থানায় মোট ৭৮ জন বৃত্তি পরীক্ষার্থী ছিলাম। আমিসহ বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম আমরা তিনজন। আজ সব স্মৃতি, প্রায় শেষ হচ্ছে আমার চাকরি জীবনও। শ্রীকান্ত বাবু স¤পর্কে বলতে গিয়ে জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোও বার বার জড়ো হচ্ছে। পারছিনা আলাদা করতে। তাই পাঠকবৃন্দের কাছে প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক লাগলেও নিজগুণে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশাকরি। কারণ উনার সাথে আমার সম্পর্কটা এমন। পারিবারিকভাবে উনার ছেলে-মেয়েদের কাছে শিক্ষক হলেও উনার সাথে স¤পর্কটা ছিল গুরুজ্যেষ্ঠ হতে বন্ধু বা সম-অসম সম্পর্কের চেয়েও অধিক যা বর্ণনাতীত।
সুধী, আর একটি কথা না বলে শান্তি পাচ্ছি না ঐ বৃত্তির ফলাফলটা যেদিন আমি পাই সেদিনটির সময়টা একটু বলছি। আমার এক বড়ভাইসহ আমাদের হাওর বৈঠাকোঁড়ার কাড়াতে (পানি বা সেচ নিষ্কাশনের নালা) একটি তিন-বায়নার চাই/গুই (মাছ ধরার কল) সূর্যদিন সন্ধ্যায় পেতে আসি। আরও দুটো চাই শুকনো জালাক্ষেত/চারাতে পেতে আসি। বৃষ্টি হলে মাছ ঢুকবে এই ভরসায়। রাতে এমন মুষলধারে বৃষ্টি হলো পরদিন ভোরে চাই ওঠাতে গিয়ে অবাক হয়েগেছি। কারণ শুকনো জায়গাতে যে দুটো চাই ছিল সেগুলো অর্ধেক পূর্ণ পুটি, ধাইরা, টেংরা ইত্যাদিতে এবং কাড়াতে যে তিন বায়নার চাই ছিল তাও প্রায় ৩/৪ ভাগ কাংলা, পাবদা, শিং, টেংরা ইত্যাদি আছে। চাই উত্তোলনের চেষ্টা করেই ব্যর্থ হয়ে গেলাম। কেননা মাছের শব্দ এবং ওজনে আমি অনেকটা ভয় পেয়ে গেলাম। অবশেষে খবর দিয়ে বড় ভাইকে নিয়ে প্রায় ৩০ কেজি মাছ নিয়ে আসছিলাম বেলা তখন ৯/১০ টা বাজে।
বিকেলে মাঠে খেলতে যাবো। গাছে পাকা জাম। বেলা প্রায় সাড়ে তিনিটার দিকে গাছপাকা কালোজাম খেতে খেতে মাঠের দিকে গেলেই প্রয়াত অধীর রঞ্জন তালুকদার আমাকে বললেন, তোমার একটা সুসংবাদ আছে। তাছাড়া ননী বাবু (প্রাইমারি টিচার এবং অফিসে কাজ করতেন) বললেন- শাল্লায় ৩ জনের বৃত্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে আমিও নাকি ১জন। ঐদিন স্রষ্টাকে প্রণাম জানিয়ে বললাম শুধু আজকের দিনটাকে আমার জন্য এতই আনন্দের। প্রিয় পাঠকবৃন্দ, জীবনের অনেক সময় অনেক আনন্দ পেয়েছি কিন্তু ঐদিনের মাছ ধরা, জাম খাওয়া, বৃত্তির ফলাফল জানা এবং শাহীদ আলী মাঠে ঐ দিনের খেলাটা ও ছিল চিত্তাকর্ষিত।
যাক শ্রীকান্ত বাবু প্রায়ই বাবার মতো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা-বার্তা বলতেন। পরবর্তীতে আমার হাইস্কুলে পড়াশোনা চলে শাহীদ আলীতে। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে ভর্তি হই বৃন্দাবন সরকারি কলেজে। পারিবারিক পরিবেশ এবং আমার ঐ সময়ের চিন্তাচেতনায় মিলিয়ে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেই। যোগদানের কিছুদিন পরেই নবীনবরণ উৎসব চলে আসে। আমার সহপাঠী বন্ধু রণদা প্রসাদ দাস (বর্তমানে স্বাস্থ্য সহকারী পদে কর্মরত) আমাকে বললো “তোমাদের নবীনবরণ উৎসবে তো শ্রীকান্ত বাবুসহ অনেক উদীচী শিল্পীরা আসবেন।” আমার মনে তাঁর কথা শুনেই আগ্রহ দেখা দিল যে, অনেকদিন পর তাঁকে দেখবো। অবশেষে নবীনবরণ উৎসবে শ্রীকান্ত বাবু আসলেন, অনুষ্ঠানে গণসঙ্গীত গেয়ে প্রাণবন্ত করে তুললেন। তাঁকে কাছে গিয়ে পা ছোঁয়ে প্রণাম করতেই আমাদের মাথায় হাত রেখে বললেন, “স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করি তোমারা মানুষ হয়ে সমাজসেবায় ব্রতী হও।” আমি ছাত্র-ইউনিয়ন করি, এটা জেনে তিনি আরও খুশি হলেন। বললেন, ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক ক্লাসগুলো মিস করো না। তাঁর কথা মত সাংগঠনিক ক্লাসগুলো মিস করতাম না। আজও ওই ক্লাসগুলোর মাহাত্ম্য ভুলতে পারছি না। দ্বাদশ শ্রেণিতে উঠার প্রাক্কালে আমি লজিং পরিবর্তন করে উমেদনগড় থেকে শিবপুরে চলে আসি। এতে কলেজে যাওয়ার রাস্তা আরো ২/৩ কিলোমিটার বেড়ে গেলো। তখন বালিখাল থেকে কলেজে পৌঁছাতে প্রায় দেড় ঘণ্টা লেগে যেত। রাস্তাও ছিল না নিরাপদ। তাই তখন ছাত্র রাজনীতি থেকে কিছুটা আমার দূরে থাকতে হয়েছে। বৃন্দাবন কলেজ জীবনের ক্লাস শেষ হওয়ার কয়েকদিন পূর্বে ১৯৮৪ সালের শেষের দিকে ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের মিটিং। ঐদিন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতিত্ব করার কথা। কিন্তু আমার সাথের সংগঠনের সিনিয়র সকল সদস্য ঐদিন অনুপস্থিত থাকায় দ্বাদশ শ্রেণির এক ছোটভাই শাহীন এসে বললো, দাদা, আপনিতো সংগঠনে সক্রিয় না কিন্তু আজ সভাপতিত্ব তো আমাদের সংগঠনের করার কথা আপনারা থাকতে কি আমরা সভাপতিত্ব করবো। আমি বললাম, কেন ভাই? রণধীর, রাজু, হিমাংশু বাবুসহ অন্যরা কী? শাহীন উত্তর করলো না, তাদের দেখছি না। আমি কিছুটা নীরব থেকে আত্মসম্মান রক্ষার্থে শাহীনকে বললাম, যাও, যথাসময়ে আমাকে ডাক দিও। মিটিং শুরু হলো সভাপতির পদ অলংকৃত করলাম আর ভাবলাম আজতো আর নিজেকে গোপন রাখা যাবে না। মিটিংটা ছিল স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের উপর নির্যাতন চালালো তখন। সবার বক্তব্য গরম হলো। সবশেষে সভাপতির বক্তব্য আসলো। আমি চিন্তা করলাম আর কটা ক্লাস বাকী, কোন কারণে কলেজে আসতে না পারলেও চলবে। আমার বক্তব্য এতটাই গরম হলো যে, তৎকালীন ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য, ছাত্রলীগ মুজিববাদী নেতা জহির ভাই (বর্তমান এম.পি. মহোদয়) আমার বক্তব্য শেষে দু’হাত এগিয়ে আসলেন এবং আলিঙ্গন করে বললেন, আপনারা কতজন ছাত্র-ইউনিয়ন নেতা কর্মীকে একসাথে কয়েকটা সভার সভাপতির দায়িত্ব দিলেও আপনারা তাতে সফলকাম হবেন।
১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি এসে আবার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে নিলাম। ৮৬ তে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এম,এ সবুর সাহেবের ঐকান্তিক চেষ্টায় শুরু হলো শাল্লা কলেজের কার্যক্রম। বাণিজ্য বিভাগের কোন শিক্ষক না থাকায় জনাব সবুর সাহেবের কথা রক্ষার্থে আমাকে কলেজে আসতে হলো। তখন অনেক সময় ইংরেজি, বাংলা, অর্থনীতিসহ বাণিজ্য বিভাগের সবকটি ক্লাস আমাকে নিতে হয়েছে। কলেজের ছাত্র-ছাত্রী সংগ্রহের জন্য ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে প্রয়াত শিক্ষক পরিমল বাবু সহ আমি ৩ দিনে নৌকাযোগে দিরাই, জামালগঞ্জসহ খালিয়াজুড়ী উপজেলায় প্রায় ৩৯টি গ্রামে গিয়েছিলাম। আজকে যখন দেখি কলেজে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার ষোলশ’র মতো তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। যাক ঐ সময়ে কিন্তু শ্রীকান্ত বাবুও বাড়িতে চলে আসলেন। ক্ষেতমজুর সমিতির তখন উপজেলাগুলোতে সরগরম অবস্থা। এরই মধ্যে শ্রীকান্ত বাবু একদিন অসিত তালুকদার, অধ্যাপক কানাই লাল সরকার, ডা. প্রমোদ রঞ্জন দাস (ব্রাহ্মণগাঁও), সুধীর বাবু (বাজারকান্দি), প্রাণকৃষ্ণ দাস, ক্ষিরোদ চন্দ্র দাসসহ আমাকে বললেন এবং উদীচীকে কিভাবে শাল্লায় দাঁড় করানো যায় তা আলোচনা করলেন। আমরা উদীচী শাখা গঠনে একমত হলাম। পাশাপাশি তিনি “শুদ্ধ সংগীত বিদ্যালয়” গঠনের প্রস্তাব দিতেই আমরা কয়েকজন ছাত্র হিসেবে ভর্তির আগ্রহ প্রকাশ করতেই তিনি খুশি হলেন। এভাবে কিছুদিন যেতেই উদীচীর পক্ষ থেকে শহীদ আলী স্কুলের ভিতরের মাঠে “১লা মে” দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হলো। নির্ধারিত তারিখ ও সময়ে অত্যন্ত প্রাণবন্তভাবে অনুষ্ঠানটি স¤পন্ন হলো। এ প্রোগ্রামের পর শ্রীকান্ত বাবু বললেন, “ওবা আমার বয়স তোমরা আজও কমিয়ে দিলে” তখন দেখতাম উজানগাঁওয়ের অ্যাডভোকেট সোনা মিয়া, প্রভাংশু চৌধুরী, শ্রীশ চৌধুরী, রামানন্দ বাবু, ময়না মিয়া (আনন্দপুর), বিনোদ চৌধুরী, দুঃখহরণ বাবু, অমর চাঁদ বাবুসহ অনেককে নিয়ে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে সময় দিতেন। তবে বেশি সময় দিতেন উদীচীতে।
তিনি কাগমারী সম্মেলনের কথাও বলতেন। ৭১ খ্রিস্টাব্দের থানা অপারেশন কাহিনীটি ও মাঝে মধ্যে তাঁর কাছে শুনতাম। আমি ২/১ দিন তাঁকে রাত ১১/১২ টায় দেখে বলতাম, কাকু আপনি এত রাতে না গেলে হয় না। অন্ধকারে যাওয়াতো ঝুঁকিপূর্ণ ও কতটা কষ্টকর। উনি হাসতে হাসতে বলতেন, ওবা তুমি ইংরেজির শিক্ষকের অভাবে ইংরেজি পড়াও, এভাবে বাংলার শিক্ষক না থাকলে বাংলা পড়াও তোমার বিভাগের সবগুলো বিষয় তুমি পড়াও কেন? প্রতিষ্ঠান জন্ম দিতে এমনটি হয়। তাই আমিও আমার এলাকায় উদীচীকে এবং সাম্যবাদের রাজনীতিতে রেখে যেতে এমনটি করি। দুঃখ হয় কখন জানো? যখন ২/৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করেও তোমাদের না পেয়ে চলে যেতে নয় তখন খারাপ লাগে, কষ্ট হয়। তোমাদের পেলে আমার কোন কষ্ট হয় না। আসলে সত্যিই মাঝে মধ্যে যখন নিরঞ্জন দা, ডা. প্রমোদ বাবু বা অন্য কেউ বলত যে শ্রীকান্ত বাবু অনেক সময় বসে গেছেন আমাকে পান নাই তখন আমার কাছেও খুব খারাপ লাগতো।
একবার উদীচীর কেন্দ্রীয় সম্মেলনে আমাদের শাল্লা থেকে ঢাকা যাবার প্রস্তুতি চলছিল। আজমান ভাই তখন সুরমা গণউন্নয়ন সংগঠন-এর পরিচালক। তিনিও আর্থিক ও যান্ত্রিকভাবে সংগঠনকে সহায়তা করলেন। সম্মেলনে যাবার পূর্বদিন বিশেষ অসুবিধায় আমার যাওয়া হলো না। রণজিৎ, তহশীলদার রানা বাবু (দিরাই), আজমান ভাই, পি.সি দাস, প্রাণকৃষ্ণ সহ শ্রীকান্ত বাবু ঢাকা গেলেন এবং কেন্দ্রে ভাল ভূমিকা রেখে আসলেন। পরবর্তীতে উদীচীর কেন্দ্রীয় সম্মেলনের কোন এক পর্বে তাকে সভাপতিত্ব করার সুযোগ দেয়ায় তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। এলাকাতে আমরা তাঁকে যেভাবে মূল্যায়ন করেছি জাতীয়ভাবে তাঁর মর্যাদার কথা বলে তিনি কেঁদে ফেলতেন। জাতীয় তেল, গ্যাস রক্ষার ক্ষেত্রে লং মার্চে শরীক হয়ে অসুস্থ হওয়ায় যশোরের এক দিদি তাকে সুস্থ করে তুলেছিলেন। এ ঘটনাটিই ২/৩ দিন আমার সাথে আলাপ করেছেন।
সমাজে আত্মনিয়োগে তিনি খুব খুশী হতেন। কাজের প্রতি দরদ ছিল তাঁর। প্রশ্নাতীত কোন দায়িত্ব নিয়ে তিনি জীবন বাজী রেখে স¤পন্ন করার চেষ্টা করেছেন। জ্ঞানীরা একটি কথা বলে যে, এ জীবন কর্মময়, মরিলে বিশ্রাম হয়। এ কথাটি তাঁর ক্ষেত্রে শতভাগ প্রযোজ্য। আমি যে ছিপছিপে গড়নের মানুষটিকে শিশুকালে প্রত্যক্ষ করেছি, ২/৩ জন শিল্পীসহ জাতীয় দিবসগুলোতে নিশ্চিতভাবে অংশ নিতে যে মানুষটিই মৃত্যুর ২/৩ দিন পূর্বেও শুধু লড়তেই দেখেছি। শাল্লা সদরের তিন রাস্তার মোড়ে ‘নির্বাক সভাপতি’ নামক পথ নাটকটি দেখিয়ে মানুষের মন তিনি কেড়ে নিয়েছিলেন। স্বল্প লেখাপড়া জানা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে সমাজ বদলের চিন্তায় নিমগ্ন থাকা কত যে কঠিন তা একমাত্র তিনিই উপলব্ধি করেছেন।
আমার গ্রামের ছেলে আশীষ তালুকদার আমার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের খবর পেয়ে আমার জন্য একটি টাই দিয়ে বলেছিল- কাকু, আপনি সদরের মধ্যে প্রথম মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করলেন তাই আমার এ ক্ষুদ্র উপহারটুকু ব্যবহার করলে খুবই খুশি হবো। এ বিষয়টি শুনে তিনি বলছিলেন “এই রে-বো তরুণ বাবু! দুই গ্রামের মধ্যে যেহেতু তুমি প্রথম মাস্টার্স ডিগ্রিধারী সেহেতু দুই গ্রামসহ সারা উপজেলার মানুষই তোমার কাছ থেকে সর্বোচ্চ সেবা প্রত্যাশা করে কথাটা কিন্তু মনে রাখবা”।
আমাদের গ্রামের রামকৃষ্ণ গোস্বামীর আখড়ার স¤পত্তি রক্ষাকল্পে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে যখন সামাজিক এবং আইনগত ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ি তখনও কিন্তু তিনি বার বার আমাকে বলতেন ওরে-বো তরুণ বাবু, তুমি যে ঝামেলায় পড়লে সেখান থেকে বেরিয়ে আসাতো কঠিন। কেননা তিনি গ্রাম্য রাজনীতি পছন্দ করতেন না। প্রায়ই বলতেন, আমি তোমাকে এমন একটি কাজে শ্রম, অর্থ ঘটাতে সমর্থন দিতে পারছিনা কারণ গ্রাম্য রাজনীতিতে তুমি শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সমাজের লাভ করাটা এভাবে কষ্টকর এখনো যখন আখড়ার সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়, মামলার কথা হয়, তখন সত্যিই শ্রীকান্ত বাবুর কথাটি মনে পড়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায়টি শুনার পর আমাকে এসে বললেন, ওবা, আমি এখন মরে গেলেও দুঃখ নেই। কারণ মনে একটিই শান্তি যে, শেখ সাহেবের হত্যার বিচারটা শুনে যেতে পেরেছি। তাঁর মৃত্যুর পর দেহ এবং চক্ষুদ্বয় দান করে গেছেন ওসমানী মেডিকেল কলেজে যাতে মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা বিশেষভাবে জ্ঞান অর্জন করে সমাজকে আরো সেবা দিতে পারে। হঠাৎ ১৯ শে নভেম্বর সকালে শুনি এ মহান ব্যক্তিটি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। সংবাদটা শুনেই অধ্যাপক কানাই লাল সরকার, ইন্দ্রজিৎ দাস, অ্যাড. দিপু রঞ্জন দাস সহ অনেকেই আঙ্গারুয়া মাঠে চলে যাই। তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট অবনী মোহন দাসকে সংবাদ দিতেই তিনি বললেন, তাঁকে কি রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়েছে? বিষয়টি একটু অ¯পষ্ট ছিল। পরবর্তীতে সম্মাননা দেওয়াসহ সকল কার্যক্রম যথাযথভাবে স¤পন্ন হয়েছে। আমি আশাকরি তাঁকে আর আমরা ফিরে পাবো না কিন্তু তাঁর যে লক্ষ্য ছিল তা যদি বাস্তবায়নের দিকে আমার খেয়াল রাখি তবে তাঁর প্রতি আমাদের সম্মান জানানো হবে বলে আমি মনে করি।
[লেখক- তরুণ কান্তি দাস, সভাপতি, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, শাল্লা, সুনামগঞ্জ]

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com