বাংলাদেশের পলল জমিনে জন্ম নিয়েছেন কতো রথি মহারথি। নিজের মেধা মননে কর্মে আলোকিত করেছেন দেশ ও দেশের মানুষকে। কিছু মানুষ নীরবে নিভৃতে ধূপের মতো নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন সমাজ, রাষ্ট্র, মানুষকে বদলে দিতে সুন্দর একটি বাংলাদেশ বিনির্মাণে। সে সব মানুষের খবর আমরা রাখিনি। সুনামগঞ্জের হাওর জলে জন্ম নেয়া তেমনি এক মানুষ কমরেড শ্রীকান্ত দাশ। আজ ১৯ নভেম্বর তাঁর ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর স্মৃতির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
‘কাউয়ায় ধান খাইলরে, খেদানির মানুষ নাই, কামের বেলা আছে মানুষ, খাইবার বেলা নাই’। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে যে গণসংগীতগুলো বহুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই গণসংগীতটি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। উপরোক্ত গণসংগীতটি বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল যার কণ্ঠে তিনি হচ্ছেন শ্রীকান্ত দাশ, যাকে কমরেড শ্রীকান্ত দাশ নামেই সবাই চিনতেন।
কমরেড শ্রীকান্ত দাশ ১৯২৪ সালের ৫ জুলাই শাল্লা উপজেলার আঙ্গারুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা যোগেন্দ্র কুমার দাশ ও মাতা জ্ঞানদায়িনী দাশ। মাত্র ৮ মাস বয়সে মাকে হারিয়ে বাবার সং¯পর্শে বেড়ে উঠেন। বাবার কাছ থেকেই মূলত সমাজতান্ত্রিক দর্শনের প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠেছিলেন।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে থাকায় পড়াশোনার মধ্যদিয়েই মাস্টার মশাইয়ের সাথে মিছিলে যোগ দিয়ে ‘বন্দে মাতারম’ স্লোগান দিতেন। নবীগঞ্জ উপজেলার বাল্লা জগন্নাথপুর গ্রামে তার শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি।
১৯৪৩ সালে কমরেড করুণাসিন্ধু রায়ের কাছে রাজনীতিতে তালিম নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেন। জীবনে চলার পথে নানা ঘটনা নানা সময় তাঁর জীবনে ঘটেছে। ১৯৫০ বাংলার ফালগুন মাসে (১৯৪৩/১৯৪৪) সুরমা উপত্যকায় ৮ম কৃষক সম্মেলনে তিনি প্রথম গণসংগীতে যোগ দেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন করুণাসিন্ধু রায় (কমরেড বরুণ রায়ের বাবা), লালা শরদ্বিন্দু দে, অজয় ভট্টাচার্য্য, সুরত পাল, বীরেশ মিশ্র, ইরাবত সিংহ, কমরেড মণিসিংহ, রাখাল বাবু, আদম আলী, তারা মিয়া, প্রবোধ নন্দ কর, সত্যেন সেন, রণেশ দাসগুপ্ত, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নির্মলেন্দু চৌধুরী প্রমুখ। সেখানেই শ্রীকান্ত দাশ পার্টির বিশ্বস্ত কর্মী হিসেবে চিহ্নিত ও যুক্ত হন। তবে নেতৃবৃন্দ তাকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন কারণ উনার কণ্ঠে যে গণসংগীত নিঃসৃত হতো তা যেমন সোচ্চার কণ্ঠের ধ্বনিত হতো তেমনি কোমলতার ¯পর্শে বিশেষ ভঙ্গিমা লাভ করত। পরে হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার বাল্লা জগন্নাথপুরে এক মাস ব্যাপী গণসংগীত, পথসভা, হাত-সভা, গ্রামীণ বৈঠক ইত্যাদিতে তিনি যোগ দেন। ১৯৪৪/১৯৪৫ সালে নেত্রকোণায় ‘অল ইন্ডিয়া কৃষক সম্মেলনে’ এ তিনি যোগ দিয়েছিলেন।
১৯৭২ সালের ১৯ জানুয়ারি ভারতের মেঘালয়ে পরিমল হাজং এর মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে করমর্দনের স্মৃতি তাঁর জীবনের আনন্দের স্মৃতি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সাংবাদিক সালেহ চৌধুরীর নেতৃত্বে তাঁর নিজ উপজেলা শাল্লা অপারেশন করেন এবং দিরাই যুদ্ধে গ্রুপ কমান্ডার সুধীর দাশের সঙ্গে সশস্ত্রভাবে অংশ নিয়েছিলেন। এবং যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতে নিজ হাতে লঙ্গরখানা খুলেছেন। সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনেও তাঁর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।
আসলে বিপ্লবী জীবনের অনন্য চরিত্রের অধিকারী কমরেড শ্রীকান্ত ছিলেন প্রবীণ রাজনীতিক, সাহসী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণসংগীত শিল্পী, উদীচীর কেন্দ্রীয় উপদেষ্টাম-লীর সদস্য অসাধারণ নির্লোভ চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের ঋদ্ধ এক বিরল ব্যক্তিত্ব। নিজের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে ছিল তাঁর এই মানসিকতা। অজপাড়া গাঁয়ে জন্ম নেয়া এই ছিপছিপে গড়নের মানুষটি কীভাবে এতোটা দৃঢ়তার সাথে সাম্যবাদী ধ্যান-ধারণা আঁকড়ে ছিলেন তা অবিশ্বাস্য। সারাবিশ্বে যখন সমাজতন্ত্রের একে একে পতন হচ্ছে, পেরেস্তাইকা-গ্লাসনস্তমুখি সমাজতন্ত্র একটার পর একটা ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে, রাশিয়ায়, জার্মানিতে এমনকি বাংলাদেশেও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে, সমাজতন্ত্র সর্বশ্রেষ্ঠ মতবাদ কিনা নাকি সমাজতন্ত্রের দিন শেষ, মানুষ এ নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলছে, নেতারা একদল থেকে অন্যদলে যাচ্ছেন, নতুন ফ্রন্ট করছেন, ফোরাম করছেন, কেউবা হালুয়া রুটির আশায় বড় দুই দলে ভিড়ছেন ঠিক তখনও তিনি ছিলেন অনড়, অটল। হঠাৎ আসা বন্যার পানি নদীর তীরে ছাপিয়ে উঠে এলে যেভাবে তীরে পুঁতে রাখা কোন শক্ত খুঁটি পানির স্রোতে নড়ে চড়ে, কিন্তু ভেসে যায় না বা উগড়ে স্রোতের টানে ভেসে যেতে পারে না, শ্রীকান্ত দাশ তেমনি একজন। তিনি নিতান্তই সহজ সরল সাদা মনের মানুষ ছিলেন।
একবার পহেলা বৈশাখে সিলেট জেলা উদীচী সংসদ শ্রীকান্ত দাশকে নিয়ে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করছিল তখন দেখেছি উনার চোখের জলের আবেগধারা। ভাবখানা এমন সিলেট জেলা সংসদ এর মতো একটা সংসদ আমার মতো নগণ্য শ্রীকান্তকে এতোটা মূল্য দিচ্ছে। আমি কি সেই মূল্যের উপযুক্ত! কিন্তু সিলেট জেলা উদীচী এই মহামূল্য জীবনকে ঠিকই চিনেছিল। তাঁর আনন্দাশ্রু সিলেট বর্ষবরণ উৎসবকে আরো গুরুত্ববহ করেছিল।
প্রয়াত শ্রীকান্ত দাশ ভাটি অঞ্চলের কৃষক আন্দোলনে তিনি ছিলেন পুরোধা, নিবেদিত প্রাণকর্মী তেজস্বী ও সাহসী। তাঁর চারপাশের কৃষকভাইদের যারা শোষণ করতো, নানাভাবে নিপীড়ন-নির্যাতন করতো তাদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক প্রতিবাদী সাহসী কণ্ঠ। জোতদারগোষ্ঠী তাঁকে কখনো ভালো চোখে দেখেনি। ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হলেও আজকের রাজনৈতিক পরিম-লে এমন নির্লোভ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর দেখামেলা খুবই কষ্ট। তিনি কখনো অর্থের পেছনে ছুটেননি। এমনকি রাজনৈতিক অর্থনৈতিক চরম সংকটময় মুহূর্তেও শ্রীকান্ত দাশ তথাকথিত তাঁর সঙ্গীসাথী কমরেডদের মতো ব্যক্তিগত হীন স্বার্থে নীতি আদর্শ বিসর্জন দেননি। তিনি বিবৃতির রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন না। বিশ্বাস করতেন কর্মে। যেমন তিনি ২০০৪ সালের ৬ই অক্টোবর নিজ চেতনায় মরণোত্তর দেহ “চিকিৎসা শাস্ত্রের শিক্ষা ও গবেষণা”র (সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ) কাজে নিজের টাকা খরচ করে নোটারি পাবলিক করে দান করেছেন এবং তার চোখ দুটো সন্ধানীকে দান করে গিয়েছেন। কর্মজীবনে কখনো কখনো শহরে থাকলেও গ্রামের কৃষকদের সাথে তাঁর ছিল নিবিড় স¤পর্ক। যাকে বলা যায় আত্মিক স¤পর্ক। তিনি গরিব কৃষকদেরকে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করতেন। তিনি সত্যিকার অর্থেই ছিলেন মনেপ্রাণে কৃষকবান্ধব। মঞ্চে দাঁড়িয়ে গলা ফাটানো আওয়াজে কৃষক দরদি আর বাস্তবে কৃষকের ঘামের গন্ধ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা কমরেড শ্রীকান্ত দাশের চরিত্রে কখনো স্থান পায়নি। তাইতো তিনি রণে-মনে-প্রাণে-গানে কৃষকের দুর্ভাগ্য দুর্দশার কথাই আজীবন বলে গেছেন যেমন-
‘আজ দিন এসেছে চাষীমজুর দেখরে চাহিয়া/ কে তোদের মুখের অন্ন নেয়রে কাড়িয়া/সাম্রাজ্যবাদের পা চাটারা দাঁড়ায়ে তোর দ্বারে/ গদীর লোভে পরের হাতে তোদের বিক্রি করে, আজ কর বিচার, দেওরে শাস্তি, সবে মিলিয়া। / যারা ধোঁকা দিয়ে, ধান নিয়ে ভুখারে করে গুলি, / খাদ্যের দাবি করলে তারা বলে রাজদ্রোহী / আজ মার্কিনে দেশ বিক্রি করে করছে বাহাদুরি। তারাই মোদের বিভীষণ ভাই লওরে চিনিয়া।।’
কমরেড শ্রীকান্ত দাশ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন কিন্তু কোন উচ্চ পদাধিকারী নেতা ছিলেন না কিংবা কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড় ডিগ্রী ছিলো না। তবে মনন মানসে ছিলেন আধুনিক। তিনি জীবনের কথা, মানুষের কথা, মানুষের দুঃখ দুর্দশা থেকে মুক্তির ভাবাদর্শ সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পন্থায় চর্চা ও অনুসরণ করেছেন। কমরেড শ্রীকান্ত দাশ গ্রামের বাড়িতে থাকাকালীন একটা গানের স্কুল খুলেছিলেন। স্কুলটির নাম ছিল “শুদ্ধ সংগীত বিদ্যালয়”। পর্যাপ্ত টাকা পয়সা ও জায়গা সংকুলানের অভাবে তাঁর স্কুল আর দাঁড় করানোর আগেই পৃথিবী থেকে ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর দৈনন্দিন জীবনের ব্যাগে একটি সাইনবোর্ড “শুদ্ধ সংগীত বিদ্যালয়”র নামে থাকতো আর যখনই সুযোগ পেতেন তখন নিজ বাড়ি, এলাকার যেমন গিরিধর হাই স্কুল, শাল্লা কলেজ, উপজেলা সমাজ সেবা অফিসার ভবন এই সমস্ত জায়গায় অফিসের ফাঁকে কিংবা বন্ধের মধ্যে সংগীত ক্লাস নিয়ে নিতেন। তাই অনেকে তাঁকে ওস্তাদজী হিসেবেও ডাকতেন।
জীবদ্দশায় তিনি অসংখ্য গান-কবিতা রচনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন নাটকও। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর নিজের দেখা বাস্তব ঘটনা ও সেইসব রাজাকারদের স্বনামে রচিত নাটকের জন্য স্থানীয় রাজাকারদের সাথে ও তাকে ফ্যাসাদ করতে হয়েছে। কিন্তু আপোষ করেন নি। ‘বিলিয়ে দাও যা আছে সম্বল আর ফিরে নাহি চাও’ স্বামী বিবেকানন্দের এই বাণীর মতো নিজেকে আজন্ম বিলিয়েছেন মাটি ও মানুষের তরে, মৃত্যুর পর নিজের দেহ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও দান করে গেছেন মানবের কল্যাণে।
সাহসী মানবতাবাদী নিভৃতচারী এমন সাদামনের মানুষই আমাদের বাতিঘর।
[লেখক : জুয়েল রাজ, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য লন্ডন]