শামস শামীম ::
শাল্লা উপজেলার কথিত চোরাপল্লী নারকিলা গ্রাম থেকে এই প্রথম একজন ছাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে। পাবেল মিয়া নামের ওই ছাত্র দিরাই ডিগ্রি কলেজ থেকে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ৩.৮০ পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে গ্রামকে আনন্দে ভাসিয়েছে। কথিত চোরাপল্লী নারকিলার প্রথম উচ্চ মাধ্যমিক পাস পাবেলকে নিয়ে আনন্দ বইছে তার হতদরিদ্র পরিবারেও। তবে তার উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করতে এখন খরচ নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিবার। পাবেলের উচ্চশিক্ষার ব্যয় কিভাবে সংগ্রহ হবে এটা নিয়ে এখনই দুশ্চিন্তায় পড়েছে তার পরিবার।
জেলার হাওরবেষ্টিত উপজেলা শাল্লা হবিবপুর ইউনিয়নের দুর্গম উন্নয়ন ও সুবিধাবঞ্চিত গ্রাম নারকিলা। এর পশ্চিমাংশে বর্তমানে ৬০টি পরিবারের প্রায় সহ¯্রাধিক মানুষের বসবাস। একসময় বংশানুক্রমিকভাবে এসব পরিবার চৌর্য্যবৃত্তির সঙ্গে জড়িত থাকলেও সময়ের পরিবর্তনে তারা এখন আর সেই পেশায় নেই। তবে সামাজিকভাবে এখনো তারা অবহেলা ও বঞ্চনার মধ্যে রয়ে গেছে। গ্রামটি কয়েকশ বছরের পুরনো হলেও এখনো গ্রামে কোন স্থায়ী ঘরবাড়ি নেই। স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন থেকে বঞ্চিত গ্রামবাসী। খুপড়িঘরে অবহেলিত পরিবারের মানুষজন বসবাস করে। সরকারি বা বেসরকারি কোন কর্মসূচি বা অবহেলিত মানুষ হিসেবে জীবনমান উন্নয়নে কোন প্রকল্প নেই গ্রামটিতে। দিনমজুরি, গার্মেন্ট ও পাথর কোয়ারিতে কাজ করে কোনমতে সংসার চালাচ্ছে তারা। জানা গেছে গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই দিনমজুর, দারিদ্র্য সীমার নিচে তাদের বসবাস।
শিক্ষা-স্বাস্থ্য-উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত এই পশ্চাদপদ গ্রামের হতদিরদ্র আব্দুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র পাবেল মিয়া। বাবা খরচ দিতে না পেরে একাধিকবার পড়ালেখা বন্ধ করিয়েছিলেন। কিন্তু হার মানেনি পাবেল। নিজে শ্রমিকের কাজ করে, টিউশনি করে, লজিংয়ে থেকে পড়ালেখা চালিয়েছে। তার কঠিন সংগ্রাম তাকে প্রাথমিকভাবে জয়ী করেছে। সে এখন অবহেলিত এই গ্রামের প্রথম উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে। ২০১৬ সালে শাল্লা উপজেলার শ্যামসুন্দর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসসি (বিজ্ঞান) ৩.২০ পয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিল পাবেল।
এসএসসি এবং এইচএসসিতে বিজ্ঞানের মতো কঠিন বিষয়ে পড়ালেখো করেছে নিজ থেকে। খরচের অভাবে প্রাইভেট পড়ার সুযোগ হয়নি তার। প্রচ- আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন অভাবী শিক্ষার্থী পাবেল স্বপ্ন দেখছে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে একজন প্রকৌশলী হওয়ার। কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতা পদে পদে তাকে বাধা দিচ্ছে। পিতারও সাধ্য নেই পুত্রের ইচ্ছে পূরণের। জানা গেছে পাবেলকে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা করতে বই, খাতা ও আনুষঙ্গিক খরচ দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন সুনামগঞ্জের সাবেক পুলিশ সুপার মো. হারুনুর রশিদ ও বর্তমান পুলিশ সুপার মো. বরকতুল্লাহ খান।
আব্দুর রহমানের তিন ছেলে ও ২ মেয়ের মধ্যে ছেলেদের মধ্যে সবার বড় পাবেল। বাবা দিনমজুরি করে সংসার চালান। পড়ালেখার পাশাপাশি পাবেল নিজেও শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন সময় কাজ করেছে। তার আরো দুই ছোট ভাই পড়ালেখা করছে তার আগ্রহ ও পরিশ্রমে। এখন জেলা শহরে এসে অনার্স ভর্তির জন্য লজিং থেকে পড়ালেখা করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে পাবেল।
গ্রামের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর প্রথম উচ্চ মাধ্যমিক পাস যুবক হিসেবে গ্রামের লোকজনও তাকে নিয়ে গর্ব করছেন। তার পাশের খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে আনন্দিত হন গ্রামের অনেকেই।
মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার পাবেল মিয়া দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি করে আসছে। গ্রামবাসীকে অপরাধ প্রবণতা থেকে দূরে সরিয়ে সচেতনতামূলক কাজ করার চেষ্টা করছে সে। গ্রামের মানুষের দারিদ্র্যতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন এলাকার মাদক কারবারিরা তাদের মাধ্যমে দেশীয় চোলাই মদ তৈরি বিক্রি করে বাজারজাত করে এমন অভিযোগ আছে। পাবেল মিয়া গত মাসে মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে কথা বলায় তাকে মারধর করেছিল কারবারিরা। পড়ালেখার মাধ্যমে নিজের স্বপ্নপূরণের পাশাপাশি পাবেল নিজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়নেরও স্বপ্ন দেখছে।
পাবেল মিয়া বলেন, আমাদের গ্রামের আমাদের গোষ্ঠীর লোকদেরকে এলাকাবাসী আজীবন ঘৃণা করে। গ্রামের মানুষ বহু আগেই ভালো হয়ে গেলেও এখনো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবে অংশ নিলে অনেকেই আমাদের বদনাম করে। এ কারণে অনেকে শিক্ষার্থীই বিদ্যালয়ে বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু আমি এসব গায়ে মাখিনি। আমি দারিদ্র্যতার মধ্যেও স্বাভাবিক পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছি। জানিনা আর্থিক অবস্থা শেষ পর্যন্ত আমাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে। আমি আমার অবহেলিত গ্রামের উন্নয়ন নিয়েও স্বপ্ন দেখছি।
শাল্লা উপজেলার সংস্কৃতি কর্মী ও সাংবাদিক পিযুষ দাস বলেন, পাবেল অবহেলিত নারকিলা গ্রামের প্রথম উচ্চ মাধ্যমিক পাস যুবক। দারিদ্র্যতার কাছে হার না মেনে সে নানা সমস্যার মধ্যেও পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অনেক দূর যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তার।
দিরাই ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ প্রদীপ কুমার দাস বলেন, পাবেল মিয়া খুব শান্তশিষ্ট ও নিরীহ এক ছাত্র। আমরা তাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছি। শুধু বোর্ড নির্ধারিত ফি বাদে তার কাছ থেকে অতিরিক্ত কিছু নেইনি। একটি অবহেলিত জনগোষ্ঠীর প্রথম উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা এই শিক্ষার্থী যেভাবে সংগ্রাম করে এগিয়ে যাচ্ছে আশা করি তার স্বপ্ন পূরণ হবে। তবে বিত্তবান লোকজন তাকে সহযোগিতা করলে তার স্বপ্ন পূরণ হবে।