সংবাদে প্রকাশ, ‘বাধ্যতামূলক হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা’। সংবাদপাঠে অবগত হওয়া যায় : শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, ‘সাধারণ শিক্ষার সবক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষার একটি বিষয়ে পড়া বাধ্যতামূলক করার চিন্তা করছে সরকার।’ প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারে, ‘সবক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষা’র প্রকৃতপ্রস্তাবে কোনও প্রয়োজন আছে কি? জানা কথা দেশে কারিগরি শিক্ষার উপস্থিতি অপর্যাপ্ত। এই অভাব দেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এই কারণে ‘সবক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষার কোনও প্রয়োজন আছে কি?’ এই সহজ-সরল প্রশ্নটার উত্থাপনকে অসঙ্গত বলে সমস্যাটিকে গুরুত্বহীন করে তোলাও খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে হয় না।
পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে যে-সব দেশে সকল নাগরিককেই কোনও একটি বিশেষ বিষয়ে বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষা লাভ করতে হয়। কোনও না কোনও বাস্তব কারণে রাষ্ট্র এমন ব্যবস্থা করে রেখেছে। ইসরাইলে প্রতিটি নাগরিকের জন্য সামরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। সহজেই অনুমেয় যে, সেটা নির্ধারণ হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের বিদ্যমান যুদ্ধাবস্থায় নিজেদের টিকে থাকাকে নিশ্চিত করতে গিয়ে। রাষ্ট্রিক অস্তিত্ব সংহত করার নিরিখে সামরিক শিক্ষাকে তারা বাধ্যতামূলক করেছে সকল নাগরিকের জন্য। উদ্ভূত সার্বিক পরিস্থিতি বলছে, ইসরাইলে এখনও পর্যন্ত বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা অসঙ্গত নয়।
বাংলাদেশের বিদ্যমান আর্থমামাজিক ব্যবস্থাটিকে বিবেচনা করা দরকার। এখানকার শিক্ষাব্যবস্থাকে কোনও অর্থেই আধুনিক বলা যায় না। আধুনিক শিক্ষার লক্ষণ একমুখিনতা। সকল নাগরিক একই শিক্ষাধারায় শিক্ষিত হয়ে উঠবে। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা একাধিক ধারায় বিভক্ত। সরকারি, বেসরকারি, মাদ্রাসা, ইংরেজি, বাংলা ইত্যাদি নানা ধারা-উপধারায় বিভক্ত। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকার পরে আবার কেন কেজি (‘কিলোগ্রাম’ নয়, ‘কিন্ডারগার্টেন’) স্কুল থাকবে, বোধগম্য নয়। সমাজে শ্রেণিবৈষম্যকে প্রতিভাত করা ছাড়া এর অন্য কোনও সামাজিক প্রয়োজনীয়তা আছে বলে তো মনে হয় না। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ দেশে ১৩ রকমের শিক্ষাধারার খোঁজ পেয়েছেন। বিশেষ করে অভিযোগ আছে, মাদ্রাসাশিক্ষা উৎপাদনকর্মে নিয়োজিত-হয়-না-নাগরিক তৈরি করছে। এমন শিক্ষাধারা উৎপাদনকর্মের সঙ্গে শিক্ষার সংযোগহীনতাকেই প্রতিভাত করে। এতে এই সত্য প্রমাণিত হয় যে, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রকরা দেশের শিক্ষার সঙ্গে উৎপাদন কর্মের সমন্বয় ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রকারান্তরে দেশ কাক্সিক্ষত আর্থনীতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে পিছিয়ে পড়ছে।
বিদেশে বাংলাদেশের দেড় কোটি মানুষ কাজ করছে, তারা কারিগরি শিক্ষাহীনতার কারণে নি¤œ মজুরিতে নি¤œমানের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। তা ছাড়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন : কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত বিদেশি লোকেরা বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ কর যে-বেতন তোলে নিচ্ছে তার পরিমাণ বিদেশে চাকরি করে শ্রমিকরা দেশে যে – টাকা পাঠান তার ৪ গুণ। দেশের লোককে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোললে ‘বিদেশে চাকরি করে শ্রমিকরা দেশে যে-টাকা পাঠান তার ৪ গুণ’ টাকা বিদেশিদের হাতে তোলে দিতে হয় না। এই সহজ হিসাবটা বুঝতে বিশেষ ধরনের বুদ্ধি থাকতে হয় না।
আর একটি বিষয় কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে। সেটি হলো দেশের ভেতরে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব। দেশে কারিগরি শিক্ষার অভাবে বেকারত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভুলে গেলে চলবে না, ছাত্ররা আন্দোলন করছে কোটা প্রথার বিরুদ্ধে, তাদের চাকরির নিশ্চয়তা চাই। এই বেকারত্বকে প্রশমিত করতে চাইলেও কারিগরি শিক্ষার কোনও বিকল্প নেই।
ইসরাইলে মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধাবস্থার প্রেক্ষিতে সকল নাগরিকের জন্য সামরিক শিক্ষা যেমন বাধ্যতামূলক, তেমনি আমাদের দেশে বেকারত্ব, দারিদ্র্য নির্মূল ও আর্থনীতিক দৃঢ়তা-স্থিরতা অর্জনের জন্য কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলক করার কোনও বিকল্প নেই। ‘বাধ্যতামূলক হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা’ দেশবান্ধব হাসিনা সরকারের এই সদিচ্ছাকে স্বাগত জানাই।