1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৩৩ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

ঝরাপাতার পান্ডুলিপি : শরর্ণাথী ৭১

  • আপডেট সময় বুধবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৬

সুখেন্দু সেন ::
(পূর্ব প্রকাশের পর)
এমন জটিল টানাপোড়েনের মধ্যেও কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত স্বাধীনতা নামক সোনার হরিণের জন্য আপামর বাঙালি মানসে এক সার্বজনীন বোধ কার্যকর থেকে যায়। তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে ছাত্রসমাজ, অতীত নিয়ে যাদের হীনমন্যতা নেই, বায়ান্ন’র রক্তবীজে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবোধের উন্মেষ থেকে ক্রমে জাতিরাষ্ট্র গঠনের আকাক্সক্ষা যাদের অন্তরে শিকড় গেড়েছিল তারাই স্বায়ত্বশাসন না স্বাধীনতা এই দোলাচল অতিক্রম করে অগ্রবর্তী বাহিনীর মত ২ মার্চ, ৩ মার্চ সম্পন্ন করে ৭ মার্চ পেরিয়ে ২৫ মার্চ অতিবাহিত করে যুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে গেছে। আর রয়েছে অতিসাধারণ খেটেখাওয়া মানুষ, নিরক্ষর কৃষক, শ্রমিক; রাজনীতির জটিল পাক যাদের আবদ্ধ রাখতে পারেনি, বঙ্গবন্ধু সেই আহ্বান “যার যা কিছু আছে তা নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে” এমন নির্দেশনাকে পাথেয় করে মুক্তির উজ্জীবনী মন্ত্র জয়বাংলা হৃদয়ে ধারণ করে প্রস্তুত হয়ে আছেÑ প্রথম প্রতিরোধেই সে প্রত্যয়ের স্বাক্ষর তারা রেখে গেছে। পরবর্তীতে পাকিস্তানি হানাদার এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীদের বর্বরতা, নৃশংসতা, পাশবিকতা, নারীত্বের অবমাননা এবং সারাদেশকে বধ্যভূমিতে পরিণত করে তোলায় স্বাভাবিকভাবেই সাধারণের মনে ভীতি, ঘৃণা ও ক্রোধের সঞ্চার ঘটে। অবরুদ্ধ মানুষ এ থেকে পরিত্রাণের আকাক্সক্ষায় ব্যাকুল হয়ে উঠে।
রেডিওর নব ঘুরিয়ে রাত সাড়ে ১০টায় আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়ের আবেগভরা কণ্ঠে সংবাদ পরিক্রমার শেষ অংশটুকু শুনতে পেলামÑ ‘……শঙ্কাতাড়িত সহায় সম্পদহীন অসংখ্য নর-নারী, শিশু-বৃদ্ধ যাদের অনেকেই গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শারীরিক যন্ত্রণা আবার স্বজন হারানোর মর্মবেদনা নিয়ে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে দিন কাটাচ্ছে, তাদের অন্তহীন দুর্ভোগ ব্যক্ত করার ভাষাও আজ হারিয়ে গেছে। আদিম হিং¯্রতার এমন নগ্নপ্রকাশ, মানবতার এমন বিপর্যয় এর আগে কখনও প্রত্যক্ষ করা যায়নি।’ পরবর্তী সংবাদের পুরোটা জুড়ে পূর্বপাকিস্তান থেকে আগত প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় নানা বীভৎস্য লোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ, বিভিন্ন স্থানে হত্যা, গুলিবর্ষণ, বিমান হামলা, অগ্নিসংযোগ এবং মুক্তিফৌজের পাল্টা জবাব ও সাফল্যের খবর। পূর্ব পাকিস্তানের রক্তক্ষয়ী ঘটনা নিয়ে বিশ্বনেতাদের উদ্বেগ ও মন্তব্য।
ঘুম আর আসতে চাইল না। রাতভর দূরে কোথাও মর্টার শেলের ধুমধাম আওয়াজ সেই সাথে বৈশাখী মেঘের গুরুগম্ভীর ডাকের যুগলবন্দির এক আতঙ্কময় পরিস্থিতিতে ভোরের অপেক্ষা করে বিনিদ্র রাত কাটানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই। শেষ প্রহরে নদী তীরের শতবর্ষী বটগাছের স্থায়ী বাসিন্দা বিরাটাকার হারগিল পাখির মিলিত কণ্ঠের ঘুম ভাঙানিয়া বিকট শব্দের ডাক আজ শোনা গেল না। শেষ রাতে লেগে আসা ঘুম ভেঙে গেল লোকজনের কথাবার্তায়। বাড়ির উঠোনজুড়ে মানুষের জটলা। ছেলে-মেয়ে, বুড়ো-বুড়ি, যুবা-শিশু চোখেমুখে অনিশ্চয়তা আর শঙ্কার ছায়া নিয়ে জড়ো হয়েছে, একসঙ্গে দেশত্যাগের জন্য। স্বাধীনতা কি বস্তু তা অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য। গ্রাম ছেড়ে পাহাড়ে চলে গেলে তবেই নাকি স্বাধীনতা আসবে। পাঞ্জাবি কি সেটাও অনেকে জানে না। পুলিশের সেপাইও দেখেনি অনেক স্ত্রীলোক। দূর থেকে দেখা পাহাড় সম্পর্কে তাদের ধারণাÑ ওখানে তো বাঘ, ভাল্লুক আর ওলাউটার বাস। অন্ধকার রাতে সাদা কাপড়ে আবৃত লম্বা ঘোমটা টেনে তিন মানুষের সমান উঁচু পিছন পায়ে হেঁটে বাড়ির পাশ ঘেঁষে বাঁশঝাড়ের নিচে এসে দাঁড়ায় ওলাউটা। সে রাতেই ওই বাড়ির কেউ না কেউ দাস্ত বমি করতে করতে মরে যায়। ভোর হবার আগেই সেই লম্বু হেঁটে নদী পেরিয়ে উত্তরের ওই পাহাড়ে তার আস্তানায় ফিরে যায়। এখন যাদের পাঞ্জাবি বলা হচ্ছে এগুলি কি সেই ওলাউটার মতোই, নাকি আরো ভয়ংকর কিছু। নানা ধরনের কথাবার্তা, কান্নাকাটিও হচ্ছে। এককোণে দুই বৃদ্ধা উচ্চস্বরে বিলাপ করে কি বলে যাচ্ছে তা ঠিক বুঝা না গেলেও মর্মার্থটি হলÑ স্বামীর চিতা যেখানে জ্বলেছিল, বড় সাধ সেখানে নিজের চিতাও জ্বলবে। তা বুঝি আর হল না। পাহাড় পর্বতে গিয়ে মরার জন্য এতো দিন কেন বেঁচে রইলাম, এই আক্ষেপ এবং খেদের প্রকাশ। বিলাপের ছন্দ আর অঙ্গভঙ্গি একই হওয়ায় দু’জনের বাসনা যে এক ছিল তা বুঝা গেল। এদের কাছাকাছি দুই কিশোরী আপন মনে নিজেদের চুড়ি বদল করে একজন আরেকজনের হাতে পরিয়ে দিচ্ছে। ওরা দুই সই। কে কোথায় থাকবে কে জানে। কেউ যদি মরে যায় তবে এই চুড়ি অন্যজনের হাতে স্মৃতি হয়ে থাকবে। মৃত্যুটা যেন এখন আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার চিন্তা চেতনার একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছে। দশ-বারো বছরের একটি ছেলে খাঁচায় পোষা ময়না সঙ্গে নিয়ে এসেছে। বললাম, ওটাকে বন্দি করে রেখেছিস কেন। ছেড়ে দে। খাঁচাটিকে দু’হাত হাত দিয়ে আরো জোরে আঁকড়ে ধরে বলল, ওটা তো জয়বাংলা বলে। এখন আর ভালো করে উড়তে পারে না। জয়বাংলা বললে নাকি পাঞ্জাবিরা মেরে ফেলে?
তাহলে থাক, সঙ্গে নিয়ে যা। তবে পাখির জন্য তো রেশন দেবে না।
রেশনের অর্থ সে বুঝে না। বলে, রেশন কি?
বললাম, খাবার।
শুষ্ক ম্লান মুখে মৃদু হেসে বললো, ওটা তো রেশন খায় না। ফড়িং খায়, কলা, দুধ-ভাতও খায়।
কথাবার্তার মাঝেই ময়নাটি জয় বাংলা জয় বাংলা বলে উঠলো।
খবর পেয়ে আশেপাশের গ্রাম থেকেও কয়েকজন এসেছে বিদায় জানাতে। জন্ম থেকেই দেখাদেখি, যাওয়া-আসা। ভিন্ন নামের, ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের হলেও মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা সহজাত। চোখের সামনে একটি গ্রাম একদিনেই খালি হয়ে হয়ে যাচ্ছে, কার পরাণে এমনটা সয়। অনেকের চোখই অশ্রুসজল। এর মাঝে কারো ভিতরে আবার অন্য মতলবও আঁটা। কোমরে গুঁজে এনেছে কিছু টাকা-পয়সা। সহানুভূতির ছলে জোরাজুরি করে কারো হাতে গুঁজে দিতে চাইছে দু-তিন কুড়ি। চোখ রাখছে বাইশ-তেইশ কুড়ি টাকার বলদের দিকে। আকারে ইঙ্গিতে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে জায়গা-জমির কথাও বলছে। পূর্বেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল কোন কিছু বিক্রি করা হবে না। ক্ষেতের ধান যেমনি আছে তেমনিই থাকবে। গরুবাছুর ছেড়ে দেয়া হবে। তামা, কাসার বড় বড় বাসনপত্র ভোরবেলাই পুকুরের মাঝখানে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে।
যাত্রার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে আমি সাইকেল নিয়ে সুনামগঞ্জের পথে রওয়ানা হয়েগেছি। নদীর ঘাটে কয়েকটি বারকি নাও অপেক্ষায়। নদীর পাড় ধরে অনেকটা এগিয়ে পেছন ফিরে দেখলাম, এখনও ঘাটে কেউ আসেনি। আরো কিছুদূর এগোনোর পর গ্রামরেখা আড়াল হয়ে গেল।
খালি পড়ে থাকলেও বাসার সবকিছু এমনিতে ঠিকঠাক আছে। তবে অল্প ক’দিনেই মানুষের স্পর্শবিহীন অবস্থায় কেমন যেন পড়ো বাড়ির মত লাগছে। উঠোনের এখানে ওখানে ঝরাপাতা জমে আছে। কিছু আগাছাও মাথা তুলেছে। দরজা খোলার শব্দ এবং নাড়াচাড়া টের পেয়ে কোথা থেকে পোষা বিড়ালটি ছুটে এলো। গৃহপালিত অবলা প্রাণী। মানুষের সংস্পর্শে অভ্যস্ত হয়ে এখনকার একাকিত্বে কেমন অসহায় হয়ে পড়েছে। শুকিয়ে গেছে বেশ। পায়ে পায়ে ঘুরছে। আশেপাশের বাসাগুলিও খালি পড়ে আছে। এক অস্বাভাবিক নির্জনতা যেন গ্রাস করে রেখেছে। উত্তরদিকে রামকৃষ্ণ মিশন থেকে শুরু করে চৌমোহনা পর্যন্ত কেউ নেই। পশ্চিমদিকে ঘনবসতিপূর্ণ মেস্তরিপাড়ায় সুনসান নীরবতা। দক্ষিণের বাসার মোবারক আলী সেনাবাহিনীর সিভিল চাকরিয়ান। ঝুঁকির মুখে ঢাকার কর্মস্থলে। পরিবারের অন্যরা বাসা ছেড়ে নানার বাড়ি মাইজবাড়িতে। আরেক প্রতিবেশী কাজী বশির উদ্দিন। পেশায় মোক্তার হলেও একসময়ের সৈনিক। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঘোরতর সমর্থক ছিলেন। পরিবারসহ বালাটের পথে সীমান্তের কাছাকাছি কোন এক গ্রামে আশ্রয় নিয়ে আছেন। পূর্বদিক এমনিতেই ফাঁকা। মাহমুদপুর পর্যন্ত ধু-ধু মাঠ। জনহীন প্রান্তরের এক স্বাভাবিক রূপ আছে। নির্জনতা প্রকৃতির এই রূপটিকে আরো গভীরতা দেয়, পরিপূর্ণতা দেয় কিন্তু জনশূন্য লোকালয়, দিনের বেলাতেও কেমন গা ছমছম করা ভীতিকর পরিবেশ। কেবল শূন্যতা আর রিক্ততার দীর্ঘশ্বাস যেন জড়িয়ে আছে সবকিছুতে। টিকটিকির ডাকও সচকিত করে তোলে, কাকের ডাকে চমকে যেতে হয়।
দুধওয়ালা আসায় কথাবলার একটা ভর পেলাম। অনেকদিন ধরে বাসায় দুধ দেয়। পৈতৃক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন অর্ধেক দুধই বিক্রি হয় না। বাঁধা বাসাগুলিতে কেউ নেই। ফেরার পথে অর্ধেক দাম দু’আনা সের দরে যা পারে বিক্রি করে যায়। বিড়ালটির জন্য আধ সের দুধ নিলাম। ব্যবসা মন্দা তবুও দাম নিতে চাইল না। অনেক কথা বললো। বললো শঙ্কা ও প্রস্তুতির কথাও। তাদের পুরো এলাকাটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। মুজিবুরের কথায় একজোটে নৌকায় ভোট দিয়েছে। ডাকবাংলায় পাঞ্জাবিদের ঘেরাও করতে তারাইতো ছুটে এসেছিল সবার আগে। যুদ্ধ যদি বাঁধে তবে তারাও যুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। এমনি এমনি মার খাবে না। যাবার সময় আরো কিছু দুধ ঢেলে দিয়ে গেল। বললোÑ খেয়ে যাবেন, পাহাড়ে দুধ পাবেন কোথায়? যদি বেঁচে থাকি আর দেশ স্বাধীন হলে আপনারাও যদি ফিরে আসেন তখন দাম দিয়েন। সকাল বেলা বাড়ি থেকেও দুধ খেয়ে এসেছি। এতে আর প্রবৃত্তি নেই। পুরো বাটি বিড়ালটির দিকে বাড়িয়ে দিলাম। ক্ষুধার্ত হলেও তেমন আগ্রহ দেখাল না। হাত দিয়ে ধরে মুখটি বাটিতে লাগিয়ে দিলাম। চুকচুক করে কিছু খেল। পিঠে হাত বুলিয়ে বললাম ক্ষিধে লাগলে খেয়ে নিস্। দারুণ এক অভিমান এসে যেন দেহমনে ভর করলো। বাটি খেকে মুখ তুলে গা এলিয়ে দিল। আগে অনেক দরকারি জিনিসপত্রই নেয়া হয়নি। স্কুল-কলেজের সার্টিফিকেট, দলিলপত্র আরো কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস দ্রুত একটা ট্রাংকে পুরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। বিড়ালটি যেমনি বসেছিল, নির্বিকার তেমনি বসে রইল। আসার পর যেভাবে পায়েপায়ে ঘুরছিল, এখন আর পিছু নিল না। এমন নীরবতার রহস্য ভেদ করতে পারলাম না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস পশুপক্ষীরা না কি বুঝতে পারে। এখনকার মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের কি আর বুঝবে। তবে মানুষ নামের কিছু প্রাণীর আচরণ যে পাশবিক হয়ে গেছে তা হয়তো তাদের কোন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আগাম জানা হয়ে গেছে।
প্রথমবার যখন সবাই মিলে বাসা ছেড়েছিলাম তখন এতটা খারাপ লাগেনি। একটা অভিযাত্রার মত ভাব ছিল। অনিশ্চয়তা থাকলেও ছিল উত্তেজনা। ছিল বেরিয়ে পড়ার একটা টান। কিন্তু আজকের এই নির্জনতা এবং নিঃসঙ্গ যাত্রায় মন খারাপ করা এক অনুভূতি যেন আচ্ছন্ন করে রাখলো। (চলবে)

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com