1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৯:১৭ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

কালের সাক্ষী পানাইল জমিদার বাড়ি

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৬

মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী ::
কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দোয়ারাবাজার উপজেলার দোহালিয়া ইউনিয়নের পানাইল জমিদার বাড়ি। প্রায় ৪শ বছরের পুরনো বাড়ির প্রবেশদ্বারটি আজো স্মৃতি বহন করছে অতীত জৌলুসের। ধারণা করা হয়, ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ভয়াবহ এক ভূমিকম্পে জমিদার বাড়ির দু’তলা বিশিষ্ট বসতঘর ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এখনো রয়েগেছে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক এ স্মৃতিচিহ্ন। এ বাড়িতে বসবাস করেছেন জমিদার পরিবারের পূর্বপুরুষ প্রেম নারায়ণ চৌধুরী। যিনি পরবর্তীতে মুসলমান হয়ে মোহাম্মদ ইসলাম নাম ধারণ করেছিলেন। তারই উত্তরসূরি দেওয়ান ছনুবুর রাজা চৌধুরী। পরবর্তী বংশধর এ উপমহাদেশের ইসলামী রেনেসাঁ ও জাতীয়তাবাদী আদর্শের বিপ্লবী সৈনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আহবাব চৌধুরী ও দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ চৌধুরী।
সম্প্রতি অতীত ঐতিহ্যের সন্ধানে গিয়েছিলাম দোয়ারাবাজার উপজেলার দোহালিয়ার পানাইল জমিদার বাড়িতে। এ বাড়িটিকে দেওয়ান বাড়ি বা রাজবাড়ি নামেও ডাকা হয়। আমার সাথে ছিলেন সহকর্মী অনুজ আশিস রহমান। দীর্ঘ সময় এ বাড়ির আশপাশ এলাকা ঘুরলাম, দেখলাম। বিশাল বাড়ির আঙিনা। আঙিনার একেকটি বাড়ির ভিন্ন ভিন্ন নাম। কোথাও লেখা রয়েছে রাজবাড়ি, দেওয়ান বাড়ি অথবা জমিদার বাড়ি। মূলত সবই এক সুতোয় গাঁথা। বাড়িগুলোর আঁকা বাঁকা রাস্তায় হাঁটছিলাম। মনে হলো সেই জমিদার আমলের জৌলুসের বাতাস যেন গায়ে লাগছে আমার।
জনশ্রুতি রয়েছে, জমিদারি আমলে জমিদারদের বাড়ির পাশ দিয়ে জুতো, সেন্ডেল, খরম পায়ে দিয়ে সাধারণ মানুষজন যেতে পারতেন না। আবার জমিদারদের ভাল শাসন ও জনগণের অধিকার আদায়ে সোচ্চার থাকার ইতিহাসও রয়েছে। ইতিহাসকে জানার উৎসাহ থেকেই দোয়ারাবাজার উপজেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও আলোকিত মানুষজনদের নিয়ে ‘আলোকিত দোয়ারাবাজার’ নামে একটি বই প্রকাশের উদ্যোগ নেই। তথ্য উপাত্ত অনুসন্ধানে গত ১৩ অক্টোবর ২০১৬ বৃহস্পতিবার গিয়েছিলাম দোয়ারাবাজার উপজেলার দোহালিয়ার পানাইল জমিদার বাড়িতে। দেখলাম কালের বিবর্তনে জমিদার বাড়ির আগেকার অনেক স্মৃতিচিহ্ন অবশিষ্ট নেই। কিন্তু এখনো বিদ্যমান রয়েছে জমিদার আমলের খননকৃত বেশ কয়েকটি পুকুর। জানাগেছে, যা এক সময় বিশাল আকৃতির একটি পুকুর ছিল জমিদার বাড়িতে। পরবর্তীতে এই পুকুরকে খন্ড খন্ড করা হয়। পুকুরের অদূরেই বহু পুরাতন স্থাপনা ঐতিহ্যবাহী দেওয়ান বাড়ি জামে মসজিদ। প্রায় ৩শ বছর আগে নির্মিত এটি। যা পরে সংস্কার করা হয়েছে। মসজিদের নিকটে দেওয়ান বাড়ির পারিবারিক কবরস্থান অবস্থিত। সেখানে চিরশায়িত আছেন এ অঞ্চলে দেওয়ান বাড়ির পূর্বপুরুষ মোহাম্মদ ইসলাম। যিনি দেওয়ান পরিবারের প্রথম পুরুষও বটে। তার পাশের কবরে রয়েছে তৎকালীন সময়ে সুদূর ইরাকের বাগদাদ থেকে ইসলাম প্রচারে আসা জনৈক আবু তাহের (রহ.)-এর স্ত্রী’র কবর।
জানা যায়, ইসলাম প্রচারক আবু তাহের (রহ.) সুনামগঞ্জে ইসলাম প্রচারে এসেছিলেন। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি দোয়ারাবাজারে আসার পথে পানাইল লঞ্চঘাটে পৌঁছলে তাঁর গর্ভবতী স্ত্রী আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। পরে ইসলাম প্রচারক ওই সাধকের অনুরোধে জমিদার বাড়ির পারিবারিক কবরেই সমাহিত করা হয় তাঁর স্ত্রীকে। এর পাশে কবর রয়েছে দেওয়ান ছনুবুর রাজা চৌধুরী’র। এছাড়া দেওয়ান মোহাম্মদ আহবাব চৌধুরীসহ পরবর্তী প্রয়াত বংশধরদের অনেক কবর রয়েছে। মসজিদের দক্ষিণ দিকের পুকুরের নিকটে শায়িত আছেন জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ চৌধুরী।
নিজের উপজেলায় এমন ঐতিহ্য দেখে সত্যিই আমি অভিভূত হয়েছিলাম। এর আগে বহু বার এসেছি পানাইলে। কিন্তু ইতিহাস অনুসন্ধানের জন্য কখনো আসা হয়নি। আজ মননের চোখে দেখলাম। ইতিহাস ও বাস্তবতার সাথে হিসেব কষতে লাগলাম আমি।
জাতীয় অধ্যাপক, দার্শনিক, ভাষা সৈনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের বসত ভিটায় ঢুকতেই যেন আলাদা সংস্কৃতির আভাস পেলাম। তাঁর স্মৃতি বিজড়িত ভিটায় কেউ না থাকলেও জমিদার আমলের আবহ যেন এখনো বইছে। একটু ভেতরে ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসলাম মূল রাজবাড়িতে। এখানে দেখলাম ভিন্নতার ছোঁয়া। মুসলিম অতীতের অনন্য দৃশ্যপট চোখে পড়ার মতো। ইসলামী রেনেসাঁর জৌলুস যেন বইছে দেওয়ান মোহাম্মদ আহবাব চৌধুরীর বংশধরদের আচার-আচরণে, তাদের চিন্তা-চেতনায়।
দেওয়ান আহবাব চৌধুরীর নাতি দেওয়ান মাসুকুর রাজা চৌধুরী’র সঙ্গে কথা বলছিলাম। তখন আযানের ধ্বনি শোনা গেল। তিনি বললেন, আযান হয়েগেছে। নামাজ পড়ে কথা বলবো।
নামাজ শেষে মাসুকুর রাজা চৌধুরী আবার আমাদের কাছে আসলেন। বিন¤্র ভঙ্গিতে কথা বলছিলেন আমাদের সঙ্গে, জানাচ্ছিলেন তার পূর্বপুরুষদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা। তিনি জানালেন দেওয়ান আহবাব চৌধুরী’র কথা। যাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় আজো লেখা রয়েছে স্বর্ণাক্ষরে। দেওয়ান আহবাব চৌধুরী যখন আসাম উচ্চ পরিষদের সদস্য ছিলেন তখন সকলের মত উপেক্ষা করে তিনি উচ্চ পরিষদ কক্ষেই নিজে আযান দিয়ে নামাজ আদায় করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমি মুসলমানদের প্রতিনিধি। আমাকে নামাজ পড়তে দেয়া না হলে তো ভারতবর্ষের সকল মুসলমানদের নামাজ পড়তে বাধা দেয়া হবে! তাই তিনি তখনই এক তরফা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে নামায আদায় করেছিলেন। সে থেকে উচ্চ পরিষদের একটি কক্ষে নামাজের আলাদা জায়গা করে দেয়া হয়।
কথা বলতে বলতে পড়ন্ত বিকেল। দেওয়ান মাসুকুর রাজা চৌধুরী আমাদের আপ্যায়ন করলেন। তাঁর আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ হলাম। কথা হল দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সম্পর্কে। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের নাতি দেওয়ান মাসুকুর রাজা চৌধুরী। তাঁর কাছ থেকে জানাগেল সৃষ্টিশীল মানুষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সম্পর্কে। দেওয়ান আজরফের সারাটি জীবন কেটেছে সৃষ্টিশীলতা ও গবেষণায়। তিনি আমাদের জন্য রেখেগেছেন জ্ঞানের অফুরন্ত ভান্ডার ও স্মৃতিগাঁথা স্বর্ণোজ্জ্বল গৌরবের ইতিহাস। রেখেগেছেন শিল্প সাহিত্যের বিশাল সম্পদ। তাঁর লেখনি, সাহিত্য ও দর্শন ও সংস্কৃতি আজীবন নতুন প্রজন্মের জন্য জ্ঞানের আলো ছড়াবে। তিনি যে জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী ভাবাদর্শ তথা তাহযীব তামাদ্দুনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তা অক্ষুণœ থাকবে কাল থেকে কালান্তর। আন্দোলন সংগ্রামে ব্রত ইসলামী অনুশাসনের সৃষ্টিশীল এই মহান ব্যক্তি সত্যিই জমিদার বংশের উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ চৌধুরী একাধারে বহুধা গুণে গুণান্বিত ছিলেন। দেশের যে কয়েকজন খ্যাতিমান দার্শনিক ছিলেন তাদেরই একজন তিনি। কালের গর্ভে অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও তাঁর কৃতী এখনো ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। দোয়ারাবাজার উপজেলার দোহালিয়ায় অবস্থিত দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ চৌধুরী ও তার পূর্বপুরুষদের স্মৃতিবিজড়িত জমিদার বাড়িটি এখনো কালের সাক্ষী হয়ে গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে জানান দিচ্ছে। সুষ্ঠু তদারকি ও সংস্কারের অভাবে দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ চৌধুরীর শেষ স্মৃতিটুকুও এখন বিলুপ্তির পথে। একসময় এখানে দেশ-বিদেশের অসংখ্য জ্ঞান অনুসন্ধিৎসুকদের সমাগম ঘটত। দেওয়ান মঞ্জিল, প্রায় ৪শ বছরের পুরনো প্রবেশদ্বার, পুরনো মসজিদ, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ চৌধুরীর কবরস্থান ও তাঁর পারিবারিক লাইব্রেরি পর্যটকদের নজর কাড়ত।
সরেজমিনে জানা যায়, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ চৌধুরী’র পারিবারিক অনেক ভূ-সম্পত্তিই বেদখল রয়েছে। তাঁর উত্তরসূরিরা দেশের বাইরে থাকায় ঐতিহাসিক এই বাড়িটি জৌলুস হারাতে বসেছে। বেশ কয়েকটি মনোরম সুপ্রাচীন ভবন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তাঁর পারিবারিক লাইব্রেরি এখন বিলুপ্তপ্রায়। উল্লেখ্য, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক হিসাবে সম্মানিত হয়েছিলেন। এবং একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও পদকে ভূষিত হয়েছেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন আসাম উচ্চ পরিষদে ছাতক-দোয়ারার এমএল.সি (এম.পি)-১৯৪৬ইং এবং ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠন তমুদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। সরকারিভাবে সংস্কার কাজ ও সুষ্ঠু তদারকির উদ্যোগ নিলে তাঁর পারিবারিক স্থাপনাগুলো সম্ভাবনাময় পর্যটনস্থান হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠবে বলে স্থানীয়দের ধারণা।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com