1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ০৮:৪৫ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

বিদায় পাগল হাসান

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

বিশেষ প্রতিনিধি ::
মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ব্যক্তিগত এমডি হাসান মতিউর রহমান (পাগল হাসান) আইডি থেকে ভোর ৬টার দিকে বন্ধু-বান্ধব ও ভক্তদের নিয়ে ঘরোয়া পরিবেশে গানের রিল ভিডিও পোস্ট করেন। ভিডিওতে তিনি হাসি হাসি মুখে একতারা বাজিয়েছেন। তার রচিত ও সুরারোপিত ‘জীবন আমার রেলগাড়ির ইঞ্জিন’ গেয়েছেন। এর আগে রাত ২টার দিকে আইডি থেকেই একটি সাদাকালো প্রোফাইল পিকচার দিয়ে স্টেটাস দেন ‘সাদা কালোই প্রথম আলো…পাগল হাসান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ছিল তার সর্বশেষ এক্টিভিটিস। সকাল সাতটার দিকেই ছাতকের সুরমা সেতু সংলগ্ন গোল চত্বরে তাকে বহনকারী সিএনজিকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয় একটি ঘাতক বাস। ঘটনাস্থলেই মারা যান লোকগানের জনপ্রিয় শিল্পী, সুরকার, গীতিকার পাগল হাসান। পিছনে সঙ্গীতের রঙিন ও প্রোজ্জ্বল অবদান রেখে সর্বশেষ স্টেটাস সাদাকালোর মতো ছবি হয়ে গেলেন। তাঁর মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ দেশ-বিদেশের সঙ্গীত পিপাসী লোকজনসহ এই অঞ্চলের মানুষজন। তারা নেট দুনিয়ায় এই উদীয়মান শিল্পীর জন্য মাতম করছেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় শিল্পীর জন্মভিটা ছাতকের কালারুকা ইউনিয়নের শিমুলতলা গ্রামে জানাজার নামাজ শেষে দাফন করা হয়েছে। জানাজায় হাজারো মানুষ অংশ নেন।
পাগল হাসানের বন্ধু সংস্কৃতিকর্মী ও সুনামগঞ্জ কালচারাল ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রিপন চন্দ বলেন, ‘হে হাঁটতে বইতে গান বানতো। আমারে লইয়াও ১৬ এপ্রিল রাইতে লঞ্চঘাটও বইয়া গান বানছে। কইছে আগামী দিনো কুনু স্টেইজো গাইবো। ১ হাজার গান লেখছে, সুর দিছে, গাইছে। গান লেখা আর সুর করাই ছিল তার নেশা। আইজ সকালে তারে মারিলিছে খুনী গাড়ির ড্রাইভার’। এই দেশের গুণী মানুষদের প্রতিদিন সড়কে খুন করছে ঘাতকরা’। এভাবেই বন্ধু ও বিশিষ্ট শিল্পীর মর্মান্তিক মৃত্যুতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন রিপন চন্দ।
ঘটনাস্থলেই পাগল হাসান ও আব্দুস সাত্তার নামের দুইজন মারা যান। আহত হন রোকন মিয়া, কয়েছ মিয়া ও জাহাঙ্গীর আলম নামের আরো তিনজন। তাদেরকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ বাসটিকে আটক করলেও চালক ও হেল্পার পালিয়ে গেছে। পাগল হাসান ছাতক উপজেলার কালারুকা ইউনিয়নের শিমুলতলা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি স্ত্রী, দুই পুত্র ও মাকে নিয়ে ছাতক পৌর শহরে বসবাস করতেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৩৩ বছর।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, বুধবার রাতে দোয়ারাবাজারে একটি অনুষ্ঠানে গান গেয়ে সকালে বাড়ি ফিরছিলেন পাগল হাসান। ফেরার পথে ছাতক গোলচত্বর এলাকায় চা-নাস্তা করে আবারো সিএনজিচালিত অটোরিকসায় ক’জন আত্মীয়কে এগিয়ে দিতে দোয়ারাবাজারের দিকে যাচ্ছিলেন। সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ছাতক-দোয়ারাবাজার সড়কের সুরমা ব্রিজ সংলগ্ন টোল প্লাজা এলাকায় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি বাসের (মৌলভীবাজার -জ- ১১- ০০৪০) সাথে সিএনজিচালিত অটোরিকসার মুখোমুখি সংঘর্ষে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান পাগল হাসান ও সিএনজি’র যাত্রী আব্দুস সাত্তার।
সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত একই গ্রামের লায়েছ মিয়া, রুপন মিয়া ও জাহাঙ্গীর আলমকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। আহতদের মধ্যে দু’জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানাগেছে।
স্থানীয়রা জানান, এসময় বাস চালকের হেলপার বাসটি নিয়ে ছাতক বাসস্টেন্ডের দিকে যাচ্ছিল। গোলচত্বর এলাকায় অটোরিকসার সঙ্গে বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুমড়ে-মুচড়ে যায় অটোরিকসাটি।
এদিকে, সড়ক দুর্ঘটনায় জনপ্রিয় শিল্পী পাগল হাসান মারা গেছেন এই খবর পেয়ে শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। খবর পেয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে ও পরিস্থিতি শান্ত করে। পুলিশ বাসটিকে আটক করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনায় লোকগানের এই জনপ্রিয় শিল্পীর মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশ বিদেশের বিশিষ্টজনরা শোক ও শ্রদ্ধা জানান।
সর্বস্তরের শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা শ্রদ্ধা জানানোর জন্য পাগল হাসানের মরদেহ বেলা সাড়ে ৩টার সুনামগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে নিয়ে আসেন। সেখানে সুনামগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট শামসুল আবেদীনের নেতৃত্বে সংস্কৃতিকর্মীরা ফুলেল শ্রদ্ধা জানান। তারা দুর্ঘটনায় জড়িত বাস চালকের শাস্তির দাবি করেন। পরে জেলা শিল্পকলা একাডেমি তিন দিনের শোক কর্মসূচি ঘোষণা করে। পাগল হাসান মৃত্যুকালে স্ত্রী, দুই পুত্র সন্তান, ২ বোন ও মাকে রেখে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে পরিবারের লোকজন মুষড়ে পড়েছেন। সন্ধ্যা ৭টায় গ্রামের মাঠে তার জানাজার নামাজ শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
পাগল হাসানের বন্ধু শিল্পী সোহেল রানা বলেন, হাসান ছিল একজন স্বভাবজাত কবি ও সুরকার। গান ও সুর তার নেশা ছিল। প্রায় ১ হাজার গান রচনা করেছে। সুর ও কণ্ঠ দিয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, হাওরের উদার প্রকৃতি ও মরমী সাধকদের সৃষ্টি সম্ভার থেকেই সে শিক্ষা নিয়েছিল। সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের এক দশকের জীবনে সে অনেক জনপ্রিয়, শ্রোতাপ্রিয় গান রচনা করেছে, সুর দিয়েছে এবং কণ্ঠও দিয়েছে। তার রচিত গানের সংখ্যা প্রায় হাজারখানেক হবে। ফোকগানের এক ঈর্ষণীয় প্রতিভাধর ছিল হাসান। তার এমন মৃত্যু লোকসংগীতের ভুবনে শূন্যতা সৃষ্টি করবে। তার গানগুলো সংরক্ষণ করা জরুরি।
সুনামগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামসুল আবেদীন বলেন, এই বয়সে সে অনেক বড়ো বড়ো মহাজনের সঙ্গে স্টেইজ মাতিয়েছে। অনেক জনপ্রিয় ফোকগান রচনা, সুর ও কণ্ঠ দিয়েছে। সম্ভাবনাময় এই তরুণশিল্পী সঙ্গীতজীবনের শুরুতেই অনেক উঁচুতে নিয়ে গিয়েছিল নিজেকে। শুধু বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলই নয় তার কয়েকটি গান সারাবিশ্বের বাঙালিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের লোকজনও শুনতেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, লাইকিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে লাখ লাখ শ্রোতা শুনেছেন দেখেছেন। তাঁর মৃত্যুতে প্রমাণ মিলেছে সে কত জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য শিল্পী ছিল।
উল্লেখ্য পাগল হাসান ‘ছাড়িয়া যাইয়োনা বন্ধু মায়া লাগাইয়া’, ‘আসমানে যাইয়োনারে বন্ধু’, ‘আমি এক পাপিষ্ট বান্দা’, ‘রেলগাড়ির ইঞ্জিন’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গান লিখেছেন, সুর করেছেন এবং গেয়েছেন। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। বোদ্ধারাও এই তরুণ শিল্পীর গানে মুগ্ধ ছিলেন। পাগল হাসান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, লালন সাই, হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিম, দুর্বিণ শাহ, ক্বারী আমির উদ্দিনসহ এই অঞ্চলের বিশিষ্টজন ও মরমী সাধকদের নিয়েও গান রচনা করেছেন। এক সময় তিনি ঢাকার শাহবাগে থাকতেন। শাহবাগের সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মসূচিতেও থাকতেন। তবে গত এক দশক ধরে তিনি সুনামগঞ্জ ও সিলেট অঞ্চলেই সপরিবারে বসবাস করে আসছিলেন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com