1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ০৩:৩০ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

বিস্মৃত এক ভাষা সংগ্রামী আবদুস সামাদ আজাদ

  • আপডেট সময় শনিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

:: স্বদেশ রায় ::
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারার মধ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে ছাত্রদের মিছিল আসার ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দশ হাজারের মতো ছাত্র জড়ো হয়। এ সময়ে সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে প্রথমে আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা শামসুল হক বক্তৃতা করেন এবং তিনি ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে বলেন। ছাত্ররা এতে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। সকলে ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে। ছাত্ররা শামসুল হকের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। এই অবস্থায় অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভাঙা শুরুর পথে নিয়ে যান, তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র, আবদুস সামাদ। তিনি তখনও অনেকের কাছে সিলেটের আবদুস সামাদ নামে পরিচিত। চিন্তা চেতনায় বামপন্থি এই ছাত্রনেতা বলেন, চারজনের বেশি হলে ১৪৪ ধারা ভাঙা হয়।
পুলিশের ব্যারিকেড দিয়ে চারজন, চারজন করে বের হবে। তারপরে দশজনের মিছিল নিয়ে- এক একটি মিছিল এগিয়ে যাবে। যখন চারজন করে বের হওয়া শুরু করে তারা দশজনি মিছিল করতে যান- তখন তাদেরকে গ্রেপ্তার করা শুরু হয়। তারা তখন ১৪৪ ধারা ভাঙার পথে স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার হতে থাকেন। আর এই গ্রেপ্তারের বা সত্যাগ্রহের দ্বিতীয় মিছিলেই ছিলেন আবদুস সামাদ। সেদিনের এই ভাষা সংগ্রামী, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র’র জীবনের সব থেকে উজ্জ্বল সময় ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্বে এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন। খোন্দকার মোশতাক যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের চেষ্টা করছিলেন, সেই সংকটকালে তরুণ আবদুস সামাদ বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। মোশতাককে অলিখিতভাবে কাজ থেকে বিরত রাখা হয়। সে সময়ে তার বাড়ির স্বজনদের কথা চিন্তা করে তিনি নামে কিছুটা পরিবর্তন আনেন। আবদুস সামাদ এর সঙ্গে আজাদ জুড়ে দেন। আর সেই থেকে আবদুস সামাদ আজাদ নামেই আমৃত্যু পরিচিত ছিলেন। আর আমৃত্যু ছিলেন একজন সফল রাজনীতিক। তার বিশাল বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন। কিন্তু তিনি ওই অর্থে কোনো জীবনী লিখে রেখে যাননি। কয়েকটি মাত্র বড় বড় সাক্ষাৎকারেই তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। সামাদ আজাদ, বাংলাদেশের ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যে মাপের বিশেষজ্ঞ ছিলেন এ মাপের রাজনীতিক এখন নেই বললেই খুব অসত্য বলা হবে না। ১৯৮৩ সালে শেখ হাসিনার সঙ্গে তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। ছাড়া পাবার পরে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে কিছু রাজনৈতিক আলোচনা হয়েছিলো। তখন রাজনীতিকে যে খুব গভীরভাবে বুঝতাম- তা নয়। তাছাড়া আবদুস সামাদ আজাদের মতো রাজনীতিকের সব কথাই যে একজন রিপোর্টারের নোটবুকে রাখা উচিত ওই ট্রেনিং তখনও পুরোপুরি হয়নি। এটা বুঝেছি, সাংবাদিক আতাউস সামাদ ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে। বুঝেছি, সাংবাদিক মানেই তার নোটবুক। আর নোট নেবার ক্ষমতা। ওইদিন বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে অনেক কথার মধ্যে সামাদ আজাদ বলেছিলেন, দেখো, আমাদের বাংলাদেশের সমস্যা হচ্ছে তিনটি। মিলিটারি, ফ্লাড এবং পপুলেশান। আমাদের রাজনীতির এখন মূল উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হওয়া উচিত এই তিন সমস্যার সমাধান করা। এ তিন সমস্যাও খুব জটিল। সমাধান করার মতো ক্ষমতা আমাদের কমে যাচ্ছে দিন দিন। আমাদের তখন চিন্তা ছিল এরশাদকে ফেলে দিতে পারলেই তো মিলিটারি শাসনের সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আর বন্যা সমস্যা তো বাঁধ দিয়ে প্রতিনিয়ত সমাধান করার কাজ চলছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সরকারি উদ্যোগ ও শিক্ষা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাধান হয়ে যাবে। ঠিক এমনটি সামাদ আজাদের বক্তব্যের উত্তরে বলতে- তিনি মৃদু মাথা নেড়ে বলেন, অত সহজ কি? কত বিপ্লবের পথ পাড়ি দিয়ে এলাম, এগোলাম কতটুকু! আবার সেই পাকিস্তানি কায়দায় সামরিক শাসন। সামরিক শাসন তো কোনো ব্যক্তি নয়, এটা একটা কালচার। এ আমাদের রাজনীতি ও সমাজ জীবনে ঢুকে গেছে। সামাদ আজাদের কথা সেদিন পুরোপুরি বুঝিনি, কিন্তু এরশাদ পতনের পর থেকে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়- আসলে সামরিক শাসন বা সামরিকায়ন বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজনীতির একটা অনিবার্য কালচার হিসেবে অনেকদূর শেকড় গেড়েছে। সব থেকে বেশি শেকড় গেড়েছে মানুষের মনোজগতে। সিভিল সমাজ ও সামরিক সমাজকে যেভাবে মিশিয়ে ফেলা হচ্ছে তার ফলে ইউরোপে নতুন রাজনীতির ধারায় পাঁচশত বছর আগে যে সিভিল শাসন শুরু হয় তা থেকে ক্রমেই আমরা দূরে চলে যাচ্ছি। সত্যি অর্থে সিভিলিয়ানরা ক্ষমতায় থাকলেও রাজনীতি ও রাষ্ট্রশাসনের কালচার সামরিক কালচার দ্বারাই বেশি প্রভাবিত থাকে এখনো। এমনকি সিভিল আমলাদের মানসিকতাও সামরিক কালচারে আচ্ছন্ন। তাদের ভেতর সেই এক সময়ের রুশ ও ইউরোপীয় সমাজের এমনকি জাপানের সামুরাই যুগের সেই সোর্ড বা তরবারি কালচারই কাজ করে। তারা সব সময়ই মনে করে যে তার সামনে সে তরবারিহীন। আর তার কোমরে দু’ধারের তরবারি।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আবদুস সামাদ আজাদের সেই হতাশার কারণ এখন বুঝতে পারি। এখন হাওরের বুকজুড়ে বড় রাস্তা বেয়ে জাগুয়ার, মার্সেডিস গাড়ি চলছে। পানি থাকে না অনেক জায়গায়। এমনকি জোয়ারের বন্যা এসে এখন আর সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলকে তলিয়ে নিতে পারে না। কিন্তু এ তো সত্য, সমুদ্র অঞ্চল থেকে শুরু করে হাওর অঞ্চল সবখানেই বন উজাড় হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে প্রতিদিন। এই বন ছাড়া ভূমি কতদিন ফসল দেবে? আমাদের পরবর্তী জেনারেশনের জন্য আমরা কি রেখে যাচ্ছি? নদীর চারপাশে যেভাবে বাঁধ হয়েছে তাতে শুধু ড্রেজিং করে কী শেষ অবধি নদী বাঁচবে? সামাদ আজাদ তখন ভাবতে পারতেন, আমাদের ভাবার ক্ষমতা ছিল না প্রতিটি মরুভূমির নিচে একটি সাগরের কল্লোলের ইতিহাস আছে।
ঠিক তেমনি পপুলেশান। পপুলেশান আমরা কমাতে পারিনি নানান কারণে। একদলকে বাধা দিয়েছে ধর্ম, আরেক দল চিন্তা করেছে সস্তা শ্রম। মাঝখান দিয়ে পপুলেশান ডেমোগ্রাফি যেখানে যাচ্ছে তা চিন্তা করলে কি উদ্বিগ্ন হতে হয় না? বিশ বছর পরে এই স¤পদহীন শরীর নির্ভর অর্থনীতির দেশ কীভাবে বিপুল সংখ্যক সিনিয়র সিটিজেনের ভার বইবে? যেখানে জাপান হিমশিম খাচ্ছে, চায়না এখনই ভয়ে উদ্বিগ্ন। ১৯৮৩ সালে আমাদের পপুলেশান নিয়ে আবদুস সামাদ আজাদ এমনই উদ্বিগ্ন ছিলেন। সেদিন তার মুখের ভাষা পড়তে পারিনি। তবে আজ যতটুকু সেই ষাট ওয়াটের বাল্বের নিচে বসা স্বল্প আলোয় দেখা মুখটির কথা মনে পড়ে -তখন বুঝতে পারি, তিনি কোন ভবিষ্যৎ দেখেছিলেন?
তেমনি ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের পরে একদিন নানান কথার ভেতর তিনি বলেছিলেন, দেখো আমি ঢাকা শহরের অনেকগুলো মসজিদ কমিটির চেয়ারম্যান। বায়তুল মোকাররমের খতিব সাহেবের সঙ্গেও আমার গভীর স¤পর্ক। কিন্তু মসজিদের কমিটিতে এখন ভিন্ন ধরনের মানুষেরা আসছে। বলে তিনি সরাসরি জামায়াতে ইসলামের কথা উল্লেখ করেছিলেন। অনেকটা বোকার মতো বলেছিলাম, মসজিদ কমিটিতে জামায়াতে ইসলামীরা আসছে, তাতে আপনাদের সমস্যা কোথায়?
তিনি তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে বলেছিলেন, সমস্যা অনেক গভীরে ভাতিজা। অনেক গভীরে। এরা সমগ্র রাজনীতি শুধু নয়, সমাজটাকে বদলে দেবে। বিশেষ করে রাজনীতি ও সমাজ থেকে বাঙালিত্বকে এরা দূরে ঠেলে ফেলার সব কাজ করবে। আর এই বাঙালি ও বাঙালিত্ব যখন সমাজে আর রাজনীতিতে থাকবে না, তখন আমাদের হাতে অবশিষ্ট কিছুই থাকবে না।
একুশে ফেব্রুয়ারি গেল। জানি না, ক’জন মানুষ আবদুস সামাদ আজাদকে স্মরণ করেছে; আর নতুন প্রজন্মের ক’জনই বা তাকে জানে। কিন্তু আজ চরম সত্য হলো, আমাদের দিবস হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি আছে। কিন্তু বাঙালি ও বাঙালিত্বর কতটুকু অবশিষ্ট আছে আমাদের হাতে?

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com