1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১০:৪৫ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী : এই দীনতা ক্ষমা করো

  • আপডেট সময় শনিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৮

সুখেন্দু সেন ::
‘দিনে দিনে দিন ক্ষয়, কিছু দিন থাকে অমলিন।
কিছু স্মৃতি জেগে রয়, মনে হয় এইতো সেদিন।’
আগস্ট মাস বাংলার প্রকৃতিতে বরাবরই একটা শোকের আবহ তৈরি করে রাখে। বৃষ্টি ঝরে কান্নার প্রতিধ্বনি হয়ে। সাত বছর আগে ২০১১’র ১৫ আগস্টের শোকাহত দিনের আরেকটি মনভাঙ্গা ক্ষণে ঢাকা থেকে একমিনিটের একটি মোবাইল ফোনের তীব্র আঘাতে আশৈশব বন্ধুত্বের বন্ধন এক মুহূর্তেই ছিন্ন করে মৃদুল চলে গেল লক্ষ-যোজন দূরে- সেই অজানা দেশে। যেখান থেকে আর ফেরা যায় না। সকাল বেলা সংবাদটা শুনে হৃদস্পন্দনের একটা বিট যেন মিসড করেছিল। প্রকৃতিস্থ হতে ক্ষাণিক সময় লেগেছিল হয়তো। তারপর টিভি চ্যানেলগুলোর ব্রেকিং নিউজ আর কয়েকটি টেলিফোন কলে একটি নিষ্ঠুর দুঃসংবাদের আমোঘ বাস্তবতা মেনে নিতে হল। মৃদুলের আকস্মিক মৃত্যু শ্রাবণের কান্নায় একাত্ম হয়ে মিশে গিয়েছিল স্বজন, অনুরাগী, গুণগ্রাহী, ভক্ত, ছাত্রছাত্রী আর অগণিত বন্ধু হৃদয়ে।
দিনে দিনে সাত বছর। প্রতিবছরই কেন যেন মনে হয় এবারও মৃদুল পুজোর ছুটিতে আসবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডায় মাতবো, নৌকা করে খরচার হাওরের ঢেউয়ে ভাসবো, নাওয়ের গলুইয়ে হাঁটুভেঙে বসে গলা ছেড়ে সে গাইবে- ‘নাতিন আমার চন্দ্রবদন রসের কমলা, ফুল তুলিতে যাইনগো নাতিন বিয়াইন্না বেলা’। আমরাও সুরে-বেসুরে চিৎকার করে গলা মিলাবো – ‘আরে সাবাস সাবাস হেইও।’ দুপুরে হাওর তলের শ্যাওলা দেখা স্বচ্ছ জলে দাপিয়ে সাঁতার। ক্ষণিকের ফিরে পাওয়া উত্তাল কৈশোর। দাপাদাপি-মাতামাতিতে হাওর তোলপাড়। ভাসা নাওয়ে তৃপ্তির মধ্যাহ্ন ভোজ। অনভ্যস্ত সাঁতারের ক্লান্তিতে ঝিরঝিরে খোলা হাওয়ায় ক্ষণিকের ভাতঘুম। -এ সবই এখন স্মৃতি, সাত বছরের পুরনো। তবু মনে হয় এইতো সেদিন।
স্কুল বেলার সহপাঠি এবং আবাল্য বন্ধু। ১৯৬১’র এক সুন্দর সকালে জুবিলী স্কুলে ৩য় শ্রেনিতে ভর্তি হয়েছিলাম আমরা, একই সঙ্গে। ’৬৯-এ এসএসসি। উচ্চ মাধ্যমিক সুনামগঞ্জ কলেজে। তারপর উচ্চশিক্ষার্থে বিভিন্ন জন ভিন্নমুখী। একসময় মৃদুলের গন্তব্য যে শান্তিনিকেতন তা জেনেছিলাম পরে। সেখান থেকে সঙ্গীতে মাস্টার্স এবং ডক্টরেট করে ফিরে আসে দেশে। সেটা ’৬৮ সাল। গবেষণার বিষয়- রবীন্দ্রনাথ টেগোরস মিউজিক ইন ওয়েস্টার্ন মিউজিক। কিছুদিন ছায়ানটের সাথে যুক্ত থেকে ’৯৩ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু।
ড. মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত ও নাট্যকলা বিভাগে যোগ দেবার পর তাঁকে প্রধান করেই সংগীত বিভাগ নামে নতুন বিভাগ খোলা হয়। মূলত অধ্যাপক ড. মৃদুল চক্রবর্তীই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা। সংগীতকে বিদ্যায়তনে প্রতিষ্ঠানিকীকরণে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। অধ্যাপনা, রবীন্দ্র সংগীত এবং লোকসংগীতের গবেষণায় অধ্যাপক ড. মৃদুল চক্রবর্তী তখন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ভূবনের এক উজ্বল জ্যোতিষ্ক। আমাদের ঐতিহ্য সংশ্লিষ্ট সংগীত গবেষণায় তাঁর শেকড় সন্ধনী কর্মের ফসল একুশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে বঙ্গ সংস্কৃতি ও সংগীতের এক নূতন দিগন্ত উন্মোচিত ও প্রসারিত করেছে। সর্বশেষ গ্রন্থ “রবীন্দ্র নাথ-পূর্ববঙ্গে লেখা গান” তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর অনেক গুরুত্ব পূর্ণ প্রবন্ধ, বক্তৃতায়, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের নিয়মিত অনুষ্ঠানে বারবার উঠে এসেছে হাছনরাজা, রাধারমণ, শাহ আব্দুল করিম, দূরবীন শাহের নাম ও গান।
সুনামগঞ্জের যে ক’জন কৃতীসন্তান এই ভাটিবাংলার সুনাম এবং গৌরব দেশেবিদেশে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন বা দিচ্ছেন ড. মৃদুল ছিলেন তাদের অন্যতম। ৫৭ বছর বয়সে যখন জ্ঞানের ভান্ডার পরিপূর্ণ, অভিজ্ঞতায় যখন ঋদ্ধ, আরো উচ্চতর ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা যখন সংগত তখনই সকলকে ব্যথিত ও বঞ্চিত করে তাঁর এই অকাল প্রয়াণ।
সংগীত আমার প্রিয় হলেও সংগীতের সাথে তেমন সম্পৃক্ততা নেই। মৃদুল চক্রবর্তীর সংগীত সাধনা, গবেষণা, তাঁর সৃষ্টি, তাঁর কর্ম, পাণ্ডিত্য নিয়ে আলোচনা আমার কাজ নয়। সেজন্য অনেক পণ্ডিত, জ্ঞানী গুণী রয়েছেন। রয়েছেন সঙ্গীত বোদ্ধা, সংস্কৃতির চর্চাকারীরা। এক সময় হয়তো তাঁর কাজ নিয়েই গবেষণা হবে, সেটা তোলা থাক ভবিষ্যতের হাতে। কিন্তু ব্যথিত হই এই ভেবে সংস্কৃতির পিঠস্থান পরিচয়ে গর্বঅনুভব করা নিজ জন্মশহর সুনামগঞ্জে এই গুণী সংগীতজ্ঞ কতটা আলোচিত। সংস্কৃতি চর্চাকারী নবীনদের কাছে তিনি কতটা পরিচিত। সংস্কৃতির নামে সময় অসময়ে কতনা আয়োজন এ শহরে প্রতিনিয়ত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মৃদুল চক্রবর্তীর কর্ম, সাধনার সাথে পরিচয় ও সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কোন আয়োজন বা উল্লেখযোগ্য আলোচনায় উৎসাহী হতে কোন সংগঠনকে দেখা যায় না। এ আমাদের দীনতা। জ্ঞানীর গুণের কদর সংস্কৃতিরই আরেক পরিচায়ক। আর সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে সুনামগঞ্জের পরিচয় প্রতিষ্ঠার পিছনে মৃদুল চক্রবর্তীর অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা কেবল উচিতই নয়- কর্তব্য।
মৃদুল চক্রবর্তীর কাছে আমাদের অনেক দায় রয়েছে। চিকিৎসায় অবহেলা, সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতা আমাদেরকে অনেক দোষে দোষী করে রেখেছে। মৃত্যুবার্ষিকীতে দু’চার কথা লিখতে গিয়েও তিনদিনের বিলম্বে নিজেও আরেক দোষে দোষী হলাম। ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়া আর কোন পথ নেই।
স্মৃতিময় বেদনার এই দিনে হে অধ্যাপক ড. মৃদুল চক্রবর্তী- তোমাকে বিনম্র শ্রদ্ধা। হে সঙ্গীতজ্ঞ – তোমায় প্রণতি। হে গবেষক – তোমার পা-ত্যের প্রতি বিস্ময়াভূত সমীহ। হে বন্ধু– তোমার নিখাদ বন্ধুবাৎসল্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা। হে উদার নিরহংকারী– তোমার কাছে আমাদের এই দীনতায় ক্ষমা প্রার্থনা।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com