বিশেষ প্রতিনিধি ::
দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অভাবে ‘অবহেলায় পতিত’ সুনামগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অমর একুশের ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিয়েছেন সর্বস্তরের জনতা। ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রহরে এবং ভোরে প্রভাতফেরি করে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের লোকজন শহীদদের শ্রদ্ধা জানান। তবে ভোরে প্রভাতফেরি করে বেদীতে ফুল দিতে আসা জনতা শহীদ মিনার ক্যাম্পাস অপরিচ্ছন্ন ও জলাবদ্ধ দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা জলাবদ্ধ শহীদ মিনারে ফুলেল শ্রদ্ধা জানালেও কোমলমতি শিশুরা ফুল দিতে এসে বিপাকে পড়ে। শহীদ মিনারের প্রতি এমন অবহেলায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন শ্রদ্ধা জানাতে আসা লোকজন।
সংস্কৃতিকর্মী রাজীব বলেন, ২১শে ফেব্রুয়ারি সকালে প্রভাতফেরি করে সুনামগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে দেখি হাঁটুজল। ফুল হাতে প্রভাতফেরিতে আসা ছোট্ট সোনামণিরা জল দেখে ভড়কে যায়। দ্রুত শাবল এনে দেয়াল ফুটো করে পানি বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি আমরা।
সুনামগঞ্জ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য রইসুজ্জামান বলেন, সকালে ফুল দিতে এসে দেখি শহীদ মিনার বেদীর চারদিকে থৈ থৈ পানি। দ্রুত আমরা পানি অপসারণে নামি। ধীরে ধীরে পানি সরে যাওয়ায় জনতা শহীদ বেদীতে তাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেন। তিনি বলেন, এখান থেকেই আমরা প্রতিবাদের ভাষা রপ্ত করেছি। মানবতার কথা শিখেছি। অশুভ শক্তিকে প্রতিরোধের ডাক দেই এখান থেকেই। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে আমাদের চেতনার বাতিঘর শহীদ মিনারকে অবহেলায় রেখে সংশ্লিষ্টরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অন্যত্র সরানোর ষড়যন্ত্র করছেন।
ভাষাশহীদদের স্মরণ করতে এসে সুনামগঞ্জ জেলা সিপিবির সভাপতি শিক্ষাবিদ চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, সুনামগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নিয়ে তিনটি প্রতিষ্ঠান নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে নেমেছে। সবাই ৪৫ বছরের স্মৃতিকে মুছে দিয়ে শহীদ মিনারকে অস্বীকার করতে চায়। চারদিকে সরকারি পতিত জায়গা থাকলেও সুনামগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সম্প্রসারণ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছেনা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারকে অস্বীকারের প্রবণতার কারণে একটি মহল সেটা দখলের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র করছে। তাই কৌশলে শহীদ মিনারকে অবহেলায় রেখে সংস্কার না করে পরিত্যক্ত দেখাতেই এই উদাসীনতা। তিনি বলেন, এই ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদেই হাজারো জনতা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় শহীদ মিনারকে ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিয়েছেন। তিনি জানান, প্রায় দুই শতাধিক সংগঠন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। শহীদ মিনার নিয়ে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদেই শ্রদ্ধায় মানুষের ঢল নেমেছে বলে মনে করেন তিনি।
সকালে শ্রদ্ধা জানাতে আসা বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু বলেন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের প্রতি এমন অবহেলাই প্রমাণ করে এটাকে নিয়ে কেমন ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি সবাইকে আবেগ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার এই শহীদ মিনার সংস্কার ও সম্প্রসারণে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার ভোরেই বিভিন্ন পাড়া মহল্লা থেকে সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, সংস্কৃতিকর্মীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় শহীদ মিনার চত্বরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তবে রাতে একুশের প্রথম প্রহরে জেলা প্রশাসনসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শ্রদ্ধা জানায়।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সংস্কার না হওয়ায় গত বছর নাগরিক সমাজ পৌর মেয়র আয়ূব বখ্ত জগলুলকে শহীদ মিনার সংস্কারের দাবি জানান। জনদাবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি গত বছর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের চত্বরে পাকাকরণের কাজ করেছিলেন। এরপর আর কেউ সংস্কারে আসেনি।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা-জনতা নিজ হাতে ডিএস রোড এলাকায় সুনামগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। এরপর থেকেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হিসেবে সর্বস্তরের জনতা এটিকে অধিকার আদায়ের কেন্দ্রে পরিণত করেছেন। তারা অশুভশক্তি প্রতিরোধে এই শহীদ মিনারকেই অধিকার আদায়ের কেন্দ্র হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করার পাশাপাশি মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথাও বলছেন।