আমাদের দেশের শত বছরের বদ্বীপ পরিকল্পনায় সহযোগী হিসেবে কাজ করছে আরেক বদ্বীপ দেশ নেদারল্যান্ডস। তারা তাদের বদ্বীপ পরিকল্পনায় নিজেদের দেশকে পাল্টে নিয়েছে, তৈরি হয়েছে বিশ্বের অন্যতম কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশ হিসেবে। তাই বছর দুই আগে আন্তর্জাতিক বদ্বীপ সম্মেলনের আগে নেদারল্যান্ডসের বদ্বীপ পরিকল্পনার কৌশল ও অর্জন খুব কাছ থেকে দেখার ইচ্ছা থেকে ঘুরে আসি নেদারল্যান্ডস থেকে। সেখানে বদ্বীপ পরিকল্পনা ও পানি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলি। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার চেয়ে নিচে অবস্থান করছে গোটা নেদারল্যান্ডস। তারা মূলত সমুদ্র বা নদী শাসন করেছে অর্থাৎ দেশের সব পানি ব্যবস্থাপনা সাজিয়ে তুলেছে বিভিন্ন পদক্ষেপে। ফলে সমৃদ্ধ হয়েছে কৃষি, পর্যটন ও শিল্প খাত, নিরাপদ হয়েছে দেশটির অর্থনৈতিক ভিত এবং অতি অবশ্যই স্থায়িত্ব পেয়েছে ভৌগোলিক অবস্থান। নেদারল্যান্ডসের একপাশের সীমায় বেলজিয়াম ও জার্মানি।
অন্যপাশের পুরোটাই হচ্ছে সাগর, নর্থ সি। ১৯৫৩ সালে নেদারল্যান্ডস ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়। তখন দেশটির বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। ক্ষতির পরিমাণ ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ইউরো। প্রায় দুই হাজার মানুষ মারা যায়। এত বড় ক্ষতি সামলে নিয়ে নেদারল্যান্ডস চিন্তা করল কীভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ওই বছরেই তথা ১৯৫৩ সালেই তারা শুরু করল ডেল্টা প্ল্যান। এর উদ্দেশ্য ছিল কীভাবে নেদারল্যান্ডসকে প্রটেক্ট করা যেতে পারে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস বা প্রাকৃতিক ক্ষয়ক্ষতি থেকে। নর্থ সি-তীর ধরে পুরো বাঁধ নির্মাণ করে দিল। এ কারণে আমরা জানি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা থেকে নেদারল্যান্ডস নিচে থাকার পরও বন্যা বা জলোচ্ছ্বাস তারা চমৎকারভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। নেদারল্যান্ডস তার ডেল্টা প্ল্যানের অভিজ্ঞতায় ভিয়েতনাম ডেল্টা প্ল্যান ও বাংলাদেশের ডেল্টা প্ল্যানে সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। ডেল্টা প্ল্যানের মাধ্যমেই নেদারল্যান্ডসে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এসেছে। আমরা জানি, নেদারল্যান্ডস পৃথিবীতে কৃষিতে সবচেয়ে এগিয়ে। শুধু উৎপাদন নয়, কৃষি প্রযুক্তি ও গবেষণায় দেশটি এগিয়ে আছে বহু পথ। এসবই ডেল্টা প্ল্যানের কল্যাণে হয়েছে। জেনে অবাক হতে হয়, নেদারল্যান্ডস আমাদের দেশের এক-চতুর্থাংশ আয়তন নিয়েও বছরে ১০৫ বিলিয়ন ইউরোর মতো কৃষিপণ্য রপ্তানি করে। সেখানে আমরা বছরে এক বিলিয়ন ইউরোর কৃষিপণ্য রপ্তানি করতে পারি।
শুধু কৃষি উৎপাদন ও কৃষিপ্রযুক্তির জন্যই নয়। বিশ্বের পর্যটকদের দারুণ এক আকর্ষণ নেদারল্যান্ডস। সেখানে জলেভাসা এক গ্রামে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয় আমার। নেদারল্যান্ডসের ওভারাইজেল প্রভিন্সের খিটহর্ন গ্রামটিতে প্রবেশ করতে হয় নৌকা করে কিংবা পায়ে হেঁটে; বড় জোর সাইকেলে। গাড়ির কোনোভাবেই প্রবেশাধিকার নেই। পানির কলকল ধ্বনি আর পাখির গুঞ্জন যেন আর কোনো শব্দে তলিয়ে না যায়! ইতিহাস থেকে জেনেছি, খিটহর্ন শব্দটি এসেছে গোটহর্ন মানে ছাগলের শিং থেকে। ১১৭০ সালে নেদারল্যান্ডসে প্রচ- বন্যা হয়েছিল, আর তাতে প্রায় সমস্ত নেদারল্যান্ডসই তলিয়ে যায়। তারও প্রায় ১০০ বছর পর অর্থাৎ ১৩০০ শতাব্দীতে এ অঞ্চলে বসবাস করতে আসে একদল মানুষ। যাদের পেশা ছিল মাছধরা আর কাদামাটি দিয়ে রাস্তা বানানো। তারা আবিষ্কার করে- এ অঞ্চলে অসংখ্য বুনোছাগলের শিং পড়ে আছে। সেই থেকে এ অঞ্চলের নাম হয় গোটহর্ন; যা কালক্রমে হয়েছে খিটহর্ন। ১৯৫৩ সালে নেদারল্যান্ডস ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হওয়ার পর তাদের নেওয়া শত বছরের ডেল্টা প্ল্যানে এই খিটহর্ন এখন নিরাপদ। এ এলাকাটির কথা আগে অনেকেরই জানা ছিল না। ১৯৫৮ সালে মুক্তি পায় ডা” চলচ্চিত্রকার বের্ট হান্সট্রা নির্মিত চলচ্চিত্র ‘ফানফেয়ার’। জনপ্রিয় এ কমেডি চলচ্চিত্রটির চিত্রধারণ করা হয় এখানে। এ সিনেমার কল্যাণে ‘খিটহর্ন’-এর কথা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। এরপর পৃথিবীর নানান দেশ থেকে পর্যটকরা আসতে শুরু করেন। পর্যটনসমৃদ্ধ একটি গ্রামে পরিণত হয় খিটহর্ন। পর্যটনই হয়ে ওঠে এখানকার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস। পর্যটকদের জন্য নৌকা ভাড়ার সুযোগ আছে। নৌকা নিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরে আসা যায়। সারা গ্রামজুড়ে ঘরবাড়ি থাকলেও চলাচলের জন্য ব্যবহার করা হয় নৌকা। খালের ওপর শত-শত নৌকা চলে। এখানকার মানুষের প্রধান যানবাহনই হলো নৌকা। এই গ্রামটিকে লিটল ভেনিস বলা হয় আবার ভেনিস অব দ্য নেদারল্যান্ডস বা নেদারল্যান্ডসের ভেনিস বলা হয়। পানিকে ঘিরেই যেখানে চলে জীবন। এখানে চলাচলের জন্য নৌকাটির নাম হুইসপার বোট। এটি ইলেকট্রিক এবং পরিবেশবান্ধব। ঘটঘট ভটভট শব্দ হয় না। বড় খালের পাশাপাশি অনেক ছোট-ছোট খালও রয়েছে। দ্বীপের ওপর যেমন মানুষ বাড়ি করে থাকছে তেমনি অনেক ফার্মহাউসও রয়েছে। খিটহর্নে গ্রামবাসী রয়েছে প্রায় ২৪০০ জনের মতো। এখানে দুটো মিউজিয়ামও আছে। সেখানে গেলে জানা যায় প্রাচীন খিটহর্ন কেমন ছিল।
আমরা ছিলাম ছয়জন। আমার সহকর্মী আদিত্য শাহীন, তৌফিক আহমেদ, তানভীর আশিক, বাংলাদেশে নেদারল্যান্ডস অ্যাম্বাসির কর্মকর্তা ওসমান হারুনি এবং ডেল্টা প্ল্যান গবেষক মারটাইন। আমরা ২ ঘণ্টার জন্য বোট ভাড়া করলাম। হুইসপার বোট। মারটাইন বোট চালানো শুরু করলেন। ভিনদেশি প্রচুর মানুষ দেখা গেল জলে ও স্থলে। আমাদের যারাই ক্রস করছে বা আমরা যাদেরকেই ক্রস করছি না কেন তারা হাত নেড়ে বা কথা বলে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে আমাদের। খালের কিছুদূর পরপরই রয়েছে ছোট ছোট পুল বা কাঠের সেতু। পর্যটকদের জন্য খাল নির্ধারিত। এখানে ব্যক্তিগত বাড়িঘরের খালে প্রবেশ নিষেধের সাইন লাগানো আছে। মারটাইন নৌকা চালানোতে খুব দক্ষ না হলেও খুব যে খারাপ চালাচ্ছে তা না। পাঠক বলে রাখি, নৌকার নিরাপত্তার খাতিরে ৫০ ইউরো জামানত হিসেবে রেখে আসতে হয়েছে। অক্ষত অবস্থায় নৌকা ফেরত দিতে পারলে তারা আমাদের ৫০ ইউরো ফেরত দেবে।
খালের দুই পাশে বাড়িঘর। ফুলের বাগান। সবুজ লন। শিশুরা খেলছে। খালে ঘুরে বেড়াচ্ছে হাঁসের দল। অপরূপ দৃশ্য। এই দৃশ্য দেখতে পৃথিবী থেকে হাজার হাজার পর্যটক ভিড় জমায় এখানে। নৌকায় ভেসে চলেছে একদল মেয়ে। তারা এই নৈসর্গিক পরিবেশ উপভোগ করতে এসেছে ব্যাচেলার পার্টি। এক চমৎকার বৃদ্ধ দ¤পতির বাড়ির পাশে আমাদের নৌকা দাঁড় করানো হলো। আমরা তাদের বাড়ির লনে গেলাম। হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন আমাদের। স্বামীর নাম ফ্রেড রাইসিংক এবং স্ত্রীর নাম তিলি রাইসিংক। অন্য শহরেও তাদের বাড়ি আছে। খিটহর্নে এই বাড়িটি কিনে রেখেছেন অবসর কাটানোর জন্য। মাঝেমধ্যেই বেড়াতে আসেন। আবার দীর্ঘদিন থেকেও যান। এবার তাদের সঙ্গে এসেছে তাদের ছোট নাতিরা। আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে তারা তাদের নাতির একটি টি-শার্ট দেখালেন যার পেছনের লেবেলে লেখা মেড ইন বাংলাদেশ। খুব ভালো লাগলো বিষয়টি আমাদের সবার। ফ্রেড রাইসিংক জানালেন, এটি কৃত্রিম লেক। সহজে পিট কয়লা বহনের জন্য শত বছর আগে এটি তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তীতে এর সৌন্দর্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
তাদের সঙ্গে কথা শেষে আমরা আবার রওনা করলাম। হাসিমুখে বিদায় জানালেন ওরা। একটি রাজহাঁস আমাদের নৌকা ঘেঁষে চলল কিছুক্ষণ। ক্যানেল পার হয়ে আমরা পড়লাম একটা বিস্তৃত জলাধারে। অনেকটা আমাদের দেশের হাওরের মতোই। জলাধারের একপাশে একটি দ্বীপবাড়ি। সেখানে একদল কিশোর কিশোরীকে দেখলাম। জানা গেল তারা ছুটি কাটাতে এসেছে। আয়োজন চলছে উৎসবের। আমরা আবার আর একটি ক্যানেলে ঢুকে পড়লাম। নৌকা চলছে। তীর ঘেঁষে হেঁটে চলছেন অনেকে। তাদের মধ্যে একজন দৌড়ে এলেন আমাদের নৌকার পাশে। ‘স্যার, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আপনি কেমন আছেন?’ এখানেও দেখা মিলল বাংলাদেশির। বললেন, তিনি নেদারল্যান্ডসে পড়াশোনা করছেন। তার স্ত্রী পড়ছেন জার্মানিতে। ছুটিতে দুজনই বেড়াতে এসেছেন এখানে। পর্যটনকে কেন্দ্র করেই এখানকার অধিবাসীরা তাদের গ্রামটিকে সাজিয়েছে। খালসংলগ্ন বাড়িগুলো সারি সারি সাজানো। কৃত্রিম খালকে ঘিরে তাদের এই আয়োজন দেখে মনে হলো আমাদের হাওর অঞ্চলে এই রকম পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা যায়। আমাদের হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য ঠিকঠাক মতো তুলে ধরলে, আর একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে পারলে সেটি হতে পারে অনন্য এক পর্যটন এলাকা।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব