একজন হাসান হামিদ ‘আগুন শুধু পুড়ায় না, কিছু বিষয় আঙ্গুল দিয়ে দেখায়ও’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। একটি স্থানীয় পত্রিকায় সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে এই লেখাটি ছাপা হয়েছে। বাংলাদেশে আগুন অগ্নিকাণ্ড হয়ে মাঝেমাঝেই অনেক কীছুই পুড়ায় আর অনেক কীছুই দেখায়, তার একটি বিবরণ প্রস্তুত করা যেতে পারে, এমন কি যে-কেউ ইচ্ছে হলে গবেষণা করতে পারেন বিষয়টি নিয়ে।
অগ্নিকাণ্ড টেংরাটিলার গ্যাসভাণ্ডার (অনুমিত হয় ভাণ্ডারটি ছিল একশত বছরের চাহিদা মেটানোর মতো বৃহৎ) পুড়িয়ে দিয়েছে, সে-ক্ষতি ভুলবার নয়। সম্পাদকীয়তে তেমন গভীর ও দীর্ঘ বিবরণ বা গবেষণাপ্রসূত ফিরিস্তি প্রদানের কোনও অবকাশ নেই। আগুনের অগ্নিকাণ্ড হয়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে অনেক কীছু দেখানোর মতো করে অন্যান্য ছোট বড় অনেক সামাজিক, রাজনীতিক, আর্থনীতিক কর্মকাণ্ড লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে যত্রতত্র যখন তখন এবং প্রতিনিয়ত আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে অনেক কীছু। এই অনেক কীছুর আছে অনেক মাত্রা, অনেক রহস্য।
গত মঙ্গলবারের (৭ জুন ২০২২ খ্রি.) স্থানীয় গণমাধ্যমে ছাপা হওয়া কয়েকটি সংবাদ নিয়ে একটু বিবেচনা করার বাসনায় ‘কিছু বিষয় আঙ্গুল দিয়ে দেখায়’ এরকম সংবাদপ্রতিবেদনের শিরোনাম তুলে দিচ্ছি। দৈনিক সুনামকণ্ঠে ছাপা হয়েছে : ‘সুনামগঞ্জ পৌর কলেজ ॥ অস্ত্রের মুখে নৈশপ্রহরীকে জিম্মি করে লক্ষাধিক টাকার মালামাল লুট’, ‘পোনামাছ নিধনের দায়ে জরিমানা ॥ অবৈধ জাল ধ্বংস’, ‘দেশে অসংক্রামক রোগে ৬৭ শতাংশ মানুষের মৃত্যু’ এবং ‘জোট-মহাজোটের বাইরে বিকল্প শক্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে – কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।’
অন্যদিকে আরেকটি দৈনিকে ছাপা হয়েছে, ‘ভোগান্তি বেড়েছে চলাচলে ॥ চাপ নিতে পারছে না সুনামগঞ্জ শহরের প্রবেশ সড়ক’, ‘শাল্লায় ভোরে পুলিশকে ঠকালেও বিকালে পাকড়াও হলো দুই চোর’, ‘জগদল হাসপাতাল ॥ বকেয়া বিলের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন’, ‘মে মাসে ৫২৮ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৬৪১’, ‘ছোট হয়ে আসছে তাহিরপুরের মানচিত্র ॥ যাদুকাটা নদীর তীর কেটে বালু উত্তোলন’, ‘ইয়াবা বিক্রির অপরাধে যুবকের এক বছরের কারাদণ্ড’, ‘দেশ এখন মুক্তিযুদ্ধের ধারায় নেই – সেলিম’, এবং ‘আগুন শুধু পোড়ায় না, কিছু বিষয় আঙ্গুল দিয়ে দেখায়ও’।
শিরোনামোক্ত এই অনেক কীছুকে আমরা সমাজের সাধারণ মানুষ, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সকল পক্ষ থেকেই দেখেও না দেখার ভান করছি এবং সচেতন হচ্ছি না। হুঁশিয়ারি যে উচ্চারণ হচ্ছে না তাও নয়। ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে গেছে চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনীর মতো। আপাতত ব্যাপক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শিকেয় তোলে রাখা ছাড়া কোনও গত্যান্তর নেই। আর সম্পাদকীয় দপ্তরেরও এমন বিশাল ব্যাপার নিয়ে গবেষণায় নিয়ত হবারও অবকাশ নেই। কেবল বলে রাখা যায় যে, সমাজটার বদল চাই। ‘এই অনেক কীছু’র মধ্যে যে-সব সামাজিক-রাজনীতিক-আর্থনীতিক অনৈতিকতা, অমানবিকতা, দায়িত্বহীনতা, আইনকে না মানা, ক্ষমতার অপব্যবহার, শোষণাশ্রয়ী অর্থ লালসা ইত্যাদির মতো অসঙ্গতি বিদ্যমানÑ সে-গুলোকে নির্মূল করা না গেলে সমাজ-রাষ্ট্রের দুর্গতি বাড়বে বই কমবে না, মানুষের জীবনে সুখ শান্তি সুদূরপরাহতই থেকে যাবে। বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা কিংবা সমাজকাঠামোর বিপরীতে একটা বিকল্প ব্যবস্থা কিংবা কাঠামো চাই। সে-জন্য চাই সামাজিক-রাজনীতিক পরিবর্তন অর্থাৎ মুনাফালোভী প্রচলিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন। এই তাগিদটা দেওয়াই বোধ করি বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ক্রান্তিকাল অতিক্রমী সমাজের জন্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও শুভঙ্কর বার্তা। অনিবার্য এই পরিবর্তনের জন্যে জাতি অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশ আর একটা শ্রীলঙ্কা অথবা ইউক্রেন হতে চায় না।