আদর্শ শিক্ষক হিসাবে এক নামে শুধু শহরজুড়ে নয় জেলাব্যাপী যাঁর খ্যাতি ছিল তিনি মানিক লাল রায় (মানিক স্যার)। বাদলদা (এন.ডি.এফ. সভাপতি) সপ্তাহে দু’তিন বার ফোন দেন হোটেল শ্রমিকদের কাছে যাওয়ার জন্য। কিন্তু শুক্রবার ২৬ জুলাই ২০১৯ সকাল বেলা ফোন দিয়ে বললেন, ‘কিছু শুনেছ?’
– জানতে চাইলাম, ‘কেন কি হয়েছে?’
– ‘মানিক স্যার মারা গেছেন।’
কথাটা শোনার পর আর আমার গলা দিয়ে কথা আসছিল না। নীরব হয়ে গেলাম। আস্তে আস্তে গেলাম স্যারের রায়পাড়াস্থ বাসায়। এরই মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন সুখেন্দুদা, নিরঞ্জনদা, জহরদা। কারো সাথে কোন আলাপ ছাড়াই ঘরের ভিতর প্রবেশ করে দেখলাম মেঝেতে শোয়ানো দাদার মরদেহের পাশে বসে বৌদি গুমরে গুমরে কাঁদছেন। সাদা চাদর দিয়ে স্যারের লাশ ঢেকে রাখা হয়েছে। দেখার পর চোখের পানি সংবরণ করতে পারছিলাম না। তাই আস্তে করে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। সবার পাশে নীরব বসে রইলাম অনেকক্ষণ। পাশে বসা নিরঞ্জনদা, স্যারের পুরনো কৃষক আন্দোলনের কথা বলছিলেন। কৃষকদের সংগঠিত করায় কী অসাধারণ দক্ষতা ছিল তাঁর। এই অসাধারণ গুণ সবার হয় না, বলছিলেন দাদা। কেউ কেউ আলাপ করছিলেন স্যারের শিক্ষকতার দিক নিয়ে। স্মৃতিগুলো আয়নার মতো ভাসছিল আমার মনে। দিশাহীন ছাত্রদের এসএসসি’র গণ্ডি পার হওয়ার একমাত্র কাণ্ডারী ছিলেন মানিক স্যার। শহরের সকল ‘গাধা’ ছাত্রদের আশ্রয়স্থল ছিলেন তিনি। ভাল ছাত্ররাও আসত বেশি নাম্বার পাওয়ার আশায়। আর আমার মতো ছাত্ররা আসত কীভাবে এসএসসি পাস করা যায়। স্যার সবাইকে আপন গুণে বন্ধুর মত করে কাছে নিতেন। তারপর ছাত্রের সমস্যাগুলো নির্ণয় করে শিক্ষা দিতেন বলেই আমার মতো গাধা ছাত্ররাও এসএসসি পাস করতো। ভাল শিক্ষক হিসেবে স্যারের খ্যাতি ছিল জেলাজুড়ে। সকাল হতে সন্ধ্যা অবধি পড়াতেন। প্রায়ই বাজার করার পয়সা থাকত না, বৌদি তাগিদ দিচ্ছেন বাজার নেই, বাজার করতে হবে। কিন্তু কোনো ছাত্রকে বলতেন না টাকা দাও। বেশিরভাগ গরিব ছাত্র, ফ্রি পড়াতেন। স্যারের মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষিত জাতি গঠন, টাকা রোজগার নয়। অঙ্ক, ইংরেজি বেশি পড়াতেন। পাঠ্যবইয়ের বাইরে স্যার সবাইকে একটা বিষয় শিক্ষা দিতেন, তা হচ্ছে শৃঙ্খলিত জীবন থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি। অষ্টম শ্রেণি হতে আমি স্যারের ছাত্র ছিলাম বলে জেনেছিলাম, একাত্তর সালে স্যার দেশমুক্তির জন্য পাকসেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলেন। অনেক দিন স্যারের সান্নিধ্যে থাকার দরুণ আরও জানলাম, সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের প্রথম বি.এ. পাস মানুষটি রতারগাঁও নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন। স্যারের কণ্ঠে বহুদিন শুনেছি, ‘আমি বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত/ যবে উৎপিড়িতের ক্রন্দন রুল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না।’
সাহিত্যাঙ্গনেও মানিক স্যারের পদচারণা ছিল। পশ্চিমবাজারে গড়ে তোলেছিলেন সুরমা লাইব্রেরি ও পাঠাগার। মুক্তির নেশায় সংগঠিত করতেন কৃষক শ্রমিক জেলে বারকি শ্রমিক, ক্ষৌরকারসহ সকল শ্রেণিপেশার মানুষদের। অনেক মিছিল-সমাবেশে স্যারের সাথে ছিলাম বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, ধর্মপাশা, বাদশাগঞ্জ ইত্যাদি বিভিন্ন এলাকায়। কৃষকদের সংগঠিত করার জন্য গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন। সাধারণ মানুষের সমস্যার কথা শোনলে ছুটে যেতেন পাগলের মত। অর্থাৎ যেখানে মুক্তিসংগ্রাম, আন্দোলন সেখানেই মানিক লাল রায়। ব্যক্তিগত সুখ আরাম আয়েশ তাঁর কীছু ছিল বলে মনে হয় না। একটা স্বপ্ন আজীবন লালন করেছেন, সে-স্বপ্নটা মানুষের মুক্তি।
ভাসানপানি আন্দোলন তখন জেলাব্যাপী তুঙ্গে। রাতদিন গ্রামে গ্রামে কৃষকদের সংগঠিত করে ডাক দিলেন জেলা শহরে কৃষক সমাবেশের। চারদিক হতে লাল ঝাণ্ডা হাতে কৃষক জনতার মিছিল এলো, জেলা শহর পরিণত হল মিছিলের শহরে। সম্ভবত ৯০/৯১ সাল। সুনামগঞ্জের সাপ্তাহিক পত্রিকা স্বজন-এ (তখন কোন দৈনিক ছিল না) ছাপা হল স্মরণকালের বৃহত্তর কৃষক সমাবেশের খবর। এ যেন গল্পের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার ডাকে কৃষকরা শহরে নেমে এলো। আন্দোলনের ফলে অনেক জায়গায় মানুষের সফলতা এসেছে। প্রায়ই আমাদের বলতেন, সাধারণ মানুষের সংগঠিত শক্তির কাছে যুগে যুগে সকল অশুভ শক্তির যেভাবে পরাজয় হয়েছে আমাদের সংগঠিত আন্দোলনের ফলে তেমনি কৃষকের জয় হয়েছে আর পরাজিত হয়েছে রক্তচোষা ইজারাদারের দল। কথাগুলো বলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতেন, মনে সুখ অনুভব করতেন, এতো আনন্দ আর কোন কিছুতে হতেন না।
আজ আমরা সবাই বলি অন্যায়-অত্যাচারে দেশ ভরে গেছে। যেদিকে তাকাই কেবল দেখি খুন, গুম, হত্যা, ধর্ষণ, ক্রসফায়ারে হত্যা। এখন নেই মানুষের বাক স্বাধীনতা, জনজীবন অতিষ্ঠ, কৃষক পায় না তার কষ্টার্জিত ধানের ন্যায্য মূল্য, শ্রমিক পায় না বাঁচার মতো বেতন। এসব বলে হতাশা ব্যক্ত করি আর মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতায় ছুটে চলে সবাই, এদিকে একা একা শামুকের মত মুখ লুকিয়ে বসে আছি। আমরা কেন স্যারের শেখানো পথ ধরে সংগঠিত হতে পারি না। স্যার সবাইকে শিখিয়েছেন সংগঠিত হতে হবে তবেই শৃঙ্খলিত জনতার মুক্তি। যে অপূর্ণ স্বপ্ন নিয়ে স্যার বিদায় নিলেন সে স্বপ্নপূরণের এখন উপযুক্ত সময়। জনতার মনের যে চাহিদা তা জানতে হবে, সংঠিত হতে হবে, তবেই মুক্তি।