1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ১০:১০ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

শিশু মনে লক্ষ্মীদি, কিশোর মনে আহাদ ভাই : বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৩ জুন, ২০১৭

১.
শিশুমনে অনেক কিছু ধরে থাকে আবার বড় হওয়ার সাথে সাথে সেগুলো মন থেকে মুছে যায়। কিছু কিছু ঘটনা বা কিছু মানুষকে আবার মন থেকে মুছা যায় না। এগুলো আবার ভীষণভবে মানুষকে তাড়িত করে। এ ধরনের তাড়না আমার মাঝেও আছে। সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘর পাড়ায় আমার জন্ম। সেটা ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের বছর ছিল। আমি তো তখন মায়ের পেটে। যখন পৃথিবীতে আসলাম তখন শহীদের খাতায় নাম লিখিয়েছেন বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার। এঁরাইতো আমাদের পথ দেখিয়েছেন সংগ্রাম, আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের। তাঁদের পথ ধরেই মুক্তিযুদ্ধে আমরা অংশগ্রহণ করতে পেরে আজো গর্ব অনুভব করি। আমার মনে এখনও ধরে আছে প্রথম স্কুলের কথা। ষোলঘরের পূর্ব পাড়ায় মরহুম ইউনুস আলী পীর সাহেবের ছোট বাংলাঘরে একটি পাঠশালা ছিল। সম্ভবত পাঠশালাটি পীর সাহেবই করেছিলেন। শহরে তখন হাতেগোণা কয়েকটি পাঠশালা ছিল। আমাদের ষোলঘরে বা তার আশেপাশে আর কোন পাঠশালা বা স্কুল ছিল না। ইউনুস আলী পীর সাহেব সরকারি জুবিলী স্কুলের সহকারী (করণিক পদ মর্যাদার হলেও তিনি মাঝে মাঝে ক্লাস নিতেন) ছিলেন। তাঁর বড় ছেলে ডাক্তার আর বাকি দু’জনই শিক্ষক হয়েছিলেন। এদের সবাই না ফেরার দেশে চলে গেছেন। পীর সাহেবের বাংলা ঘরেই আমার প্রথম পাঠ। ষোলঘরের সেন বাড়ির মগ্নলতা সেন সেখানে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে আমাদের পড়াতেন। এই মগ্নলতা সেনই আমার প্রথম শিক্ষক। মগ্নলতা সেনের পিতা দুলাল চন্দ্র সেন প্রায় একশত বছর আগে এই এলাকায় শিক্ষা প্রসারে এক উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। সুনামগঞ্জ শহরে তখন নারী শিক্ষার প্রচলন খুব কম ছিল। সে সময় দুলাল চন্দ্র মহাশয়ের স্ত্রী বিশ্বেশ্বরী দেবী বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রী সংগ্রহ করে পুরাতন পৌরভবনে পাঠশালা খুলে নারীদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন। শহর থেকে প্রায় মাইল তিনেক দূরে ব্রাহ্মণগাঁও গ্রামে ছিল তাঁদের বাড়ি। শিক্ষকতা করার জন্য দুলাল সেন মহাশয় তাঁর স্ত্রী বিশ্বেশ্বরী দেবীকে নিয়ে পুরাতন পৌরভবনের পাশে একটি বাসায় থাকতেন। দুলাল সেন মহাশয়ের পরবর্তী বংশধরেরা স্থায়ীভাবে ষোলঘরে বসবাস শুরু করেন। উনার পুত্র, ভ্রাতুষ্পুত্র, কন্যা একযোগে শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। নরেন্দ্রনাথ সেন, দ্বিজেন্দ্র লাল সেন, ধীরেন্দ্র লাল সেন এবং মগ্নলতা সেন এই শহরে অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কৃতিত্বের সাথে শিক্ষকতা করে গেছেন।
পাঠশালায় যাওয়া-আসার মাঝে যাকে আমি মনে ধরে রেখেছি তিনি হচ্ছেন লক্ষ্মীদি। লক্ষ্মীদি নামটি আমি অনেক পরে জানতে পেরেছি আমার বড় বোন আর তাঁদের বান্ধবীদের কাছ থেকে। পীর সাহেবের পাঠশালায় যিনি আমাকে আদর করে কান্না থামাতেন, হাতে ধরে অ আ লিখতে সাহায্য করতেন তিনি লক্ষ্মীদি। আমি তখন পাঁচ বছরের শিশু। আমার চাইতে লক্ষ্মীদি বছর পাঁচেক বড় হতে পারেন। লক্ষ্মীদির স্মৃতি ছাড়া আর কোন স্মৃতি আমার মস্তিষ্ক কম্পিউটারে ধরে রাখতে পারেনি। যখন বড় হয়ে লক্ষ্মীদিকে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছি তখন তাঁর বিয়ে হয়ে গেছে। তারপরে আর এগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করিনি। এখন বয়স ভাটির সময়ে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে। সুনামগঞ্জ পৌর বিপণির মধ্যবিত্ত নামে রুচিশীল দোকানে আমি মাঝে মাঝে যাই। সেখান থেকে বই, ম্যাগাজিন, জামা কিনি। এটার মালিক মানবেন্দ্র করের পিসি হচ্ছেন আমার শিশুমনের লক্ষ্মীদি। জানতে চেয়েছিলাম লক্ষ্মীদির কথা। তাঁর কাছ থেকে শুনে প্রচ- আঘাত পেয়েছি। আমাকে দেখা না দিয়েই লক্ষ্মীদি না ফেরার দেশে চলে গেছেন। কতদিন এই পাঠশালায় পড়েছিলাম সেটা মনে নেই। তবে আমার শিশু মনের লক্ষ্মীদি আমার কাছে এখনও জীবন্ত হয়ে আছেন।
২.
ষোলঘরের প্রাথমিক পাঠ শেষ করে চলে এলাম মাদ্রাসায়। এখন যেটা এইচএমপি হাইস্কুল এন্ড কলেজ। সেটাই ছিল একসময় হাজী মকবুল পুরকায়স্থ এম.ই. মাদ্রাসা। সেখান ক্লাস টু অবধি পড়েছিলাম। মনে পড়ে টিনের ছাউনিযুক্ত ছোট্ট মাদ্রাসায় যাওয়ার পথে সবসময় পানি লেগে থাকত। এই পানিতে থাকত জোঁক। এই জোঁকগুলোকে আমি যমের মতো ভয় পেতাম। কেউ আমাকে এই জায়গাটুকু কোলে করে পার না করলে স্কুলে যাওয়া আমি বাদ দিয়ে দিতাম। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বুলেট, রাইফেলকে এতো ভয় করতাম না যতটুকু ছিল জোঁকের ভীতি। হাইড ক্যাম্পে পায়ে কলাপাতা মুড়িয়ে ঘুম দিলেও রাতে উঠে দেখতাম জোঁক আছে কি-না।
১৯৫৯ সালে সরকারি জুবিলী স্কুলে ভর্তির আশায় নির্বাচনী পরীক্ষা দেই। কৃতকার্য হয়ে ভর্তি হয়ে যাই জুবিলী স্কুলে। জুবিলী স্কুলে ক্লাস করতে গেলে ক্লাসটিচার বলেছিলেন এখনও দেখি এন্ডাই আছিস। এখনতো তোর মায়ের কোলে থাকার কথা। সেই থেকেই সহপাঠীরা এন্ডা বলেই খেপাত আর আমি ভীষণভাবে খেপতাম। ক্লাসটিচার স্যারের (স্যারের নামটা ভুলে গেছি) ওপর ভীষণ রাগ ছিল আমার। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করে জুবিলিয়ান হওয়ার সম্মান অর্জন করি। এই স্কুলে পড়াশোনার সময় আমার কিশোর মনে আরেকটি জিনিস আটকে আছে। সেটা হচ্ছে প্রধান শিক্ষকের রুমের সামনে একজন স্কাউটের প্রতিকৃতি। সেটা ছিল টিন দিয়ে তৈরি। স্কাউটের পোশাক পরিহিত এই প্রতিকৃতি কার সেটা জানার সৌভাগ্য হয়েছে অনেক বছর পরে। আমাদের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তোফাজ্জল হোসেন স্যার। বেটে-খাটো ধরনের এই ব্যক্তিত্ববান শিক্ষক এখনকার সময় খুব একটা পাওয়া যায় না। একবার নাকি মহকুমা প্রশাসক স্কুল কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়েই স্কুলে আসতে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হন। হেডমাস্টার সাহেবের আদেশে স্কুলের পিয়ন কালা দা মহকুমা প্রশাসকের নাকের ডগায় সদর গেইট বন্ধ করে দিয়েছিল। স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন মোহাম্মদ আলী স্যার। অত্যন্ত ব্যক্তিত্ববান এই শিক্ষক স্থানীয় হওয়ায় তিনি অভিভাবকগণের পরিচিত ছিলেন। তাঁদের শক্ত হাতে স্কুল পরিচালনায় প্রতি বছর ঈর্ষণীয় ফলাফল হত। স্কাউটের প্রতিকৃতিটি কার সেটা জানার ইচ্ছা ছিল কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার মতো কোন পরিচিতজন আমার ছিল না। সহপাঠী যারা তারা আমার মতোই। একসময় স্কাউটিং আন্দোলনের সাথে জড়িত হলাম। আমরা প্রথম হলাম কাব। স্কাউট হতে তো অনেক দেরি। আগে কাব হয়ে অনেক কিছু শিখতে হয়। আমাদের স্কাউটিংয়ের শিক্ষক ছিলেন জনাব কামরুল ইসলাম স্যার। শহরতলির জুনিগাঁও গ্রাম থেকে প্রতিদিন স্কুলে আসতেন। স্কাউট শিক্ষক হিসেবে কামরুল ইসলাম স্যারের জুড়ি মেলানো কঠিন। সব সময় তিনি লেফট-রাইট করে হাত নাড়িয়ে হাঁটতেন। এই কামরুল ইসলাম স্যারের মুখ থেকেই প্রথম শুনি এটা হচ্ছে একজন আদর্শ স্কাউট আব্দুল আহাদ চৌধুরীর প্রতিকৃতি। আমার জানা এই পর্যন্তই। এই আব্দুল আহাদ চৌধুরী কে বা কি তাঁর পরিচয় কিছুই জানতে পারিনি। আমার কিশোর মনে সবসময়ই এটা জানার জন্য উঁকি দিত। একসময় আমাদের সাথে পড়তে আসে জগন্নাথপুর থানার বেতাউকা গ্রামের ফজলুল হক চৌধুরী। সচ্ছল পরিবারের সন্তান। পরিবারের অপর সদস্যরা থাকেন ইংল্যান্ডে। ধূপদুরস্ত কাপড়-চোপড় পরে থাকে সবসময়। ইস্ত্রি করা কাপড় পরে যে ক’জন ছাত্র স্কুলে আসত তাদের মাঝে সেও একজন। ফজলুল হক ছাড়া পাগলা বাজারের আনোয়ার বেগ আর আফজল একইভাবে ইস্ত্রি করা কাপড় পরিধান করত। ফজলুল হকের কাছ থেকে জানলাম আহাদ চৌধুরী তাঁর ভাই। এ রকম একজন ব্যক্তির ভাই হওয়ায় ফজলুল হককে আমি আলাদাভাবে বিবেচনা করতাম। আমার শিশু মনের লক্ষ্মীদি আর কিশোর মনের আহাদ চৌধুরী দু’জনেই না ফেরার দেশে চলে গেছেন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com