1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ১১:১৬ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

গল্প – পোস্টমর্টেম : মনিরুল হাসান (শিমুল)

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৩ জুন, ২০১৭

ঘটনাটা ঘটার মত এমন রাত আর হয় না। বাইরে কবর কালো অন্ধকার। পৃথিবী কাঁপিয়ে প্রচ- ঝড় হচ্ছে। সাথে দমকা বর্ষণ। গুড়–ম শব্দে কাছে কোথাও বাজ পড়ে। ডা. গৌতম মিত্র সে শব্দে কেঁপে উঠে। আর তখনি প্রচ- শব্দে জানালার কপাট ভেঙ্গে যায়। বিদ্যুতের চোখ ধাঁধানো আলোতে সে ভাঙা জানালা দিয়ে তাকিয়ে ডা. মিত্র দেখে উঠোনের বটগাছটা মাঝখানে ভেঙে গিয়ে মাটিতে পড়ে আছে। ঝড়ো হাওয়া জানালা দিয়ে ঢুকে ঘরটাকে শূন্যে তুলে ঝাঁকুনি দেয় বার কয়েক। গৌতম মিত্র ছিটকে পড়ে টাইলস করা ঠা-া ভেজা মেঝেতে। তারপর হঠাৎ কেমন স্তব্ধ হয়ে যায় চারপাশ।
জানালার ভাঙা কপাটটা বার দুই দুলে উঠে স্থির হয়ে যায়। এমনকি বাতাসটাও থেমে যায় একেবারে হঠাৎ করে। ডা. মিত্র উঠে বসে। সে বিড়বিড় করে। একটা অজানা ভয় এসে তাঁকে কাঁপিয়ে দেয়। কেউ আসছে? ভয়ংকর কিছু। সে জন্য সবকিছু হঠাৎ এমন স্তব্ধ হয়ে গেছে। ডা. মিত্রের পঞ্চাশ বছর কেটেছে চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে। সে ভূত বিশ্বাস করেনা। একেবারেই না। তবে এই মুহূর্তে তাঁর মনে হয় ভূত থাকুক বা না থাকুক অশরীরি কিছু নিশ্চয় আছে। বৃষ্টির পানিতে তাঁর থপ থপ হেঁটে আসার শব্দ আসে। ¯পষ্ট। কেউ বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে আসে দরজার ওপারে। এমনকি তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কে? কে ওখানে? গৌতম মিত্র চিৎকার করে উঠে। ঠক ঠক শব্দ হয় দরজায়। কে? ফ্যাসফ্যাসে গলায় জিজ্ঞেস করে আবারো ডা. মিত্র। কথা বলছেনা, কেন? কে ওখানে? আর তখনই শব্দটা হয়। বাতাসের। সমুদ্রের গর্জনের চেয়ে আরো পাঁচগুণ শক্তি আর শব্দ নিয়ে বাতাস আসছে দূর থেকে। বৃষ্টির প্রকোপ বেড়ে যায় হঠাৎ করে। জানালার ভাঙা কপাটের যেন পাখা গজিয়েছে। বাতাসের ধাক্কায় জানালা থেকে উড়ে গিয়ে আকাশের দিকে উঠতে থাকে প্রচ- বেগে। বাতাসের শব্দ আরো বেড়ে যায়। তারপর উঠোনের মৃত বটগাছটাকে অনায়াসে বগলদাবা করে তাঁর প্রচ- শক্তি নিয়ে আছড়ে পড়ে ডা. গৌতম মিত্রের দরজার উপর। মুহূর্তখানেক তাঁর মনে হয় সে আর বেঁচে নেই। বাতাসের এ প্রচ- ধাক্কায় সেতো দূরের কথা দৈত্য দানবের মরে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করে সে দিব্যি বেঁচে আছে। বাতাসের ধাক্কায় দরজাটা খুলে যায়।
সে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে ডা. মিত্র আতঙ্কে বোবা হয়ে যায়। প্রচ- শক্তি দিয়ে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে সে। কিন্তু পা যেন পৃথিবীর সমান ভর নিয়ে তাঁর পায়ে আটকে যায়। বিস্ময়ে তাঁর কোটর থেকে বের হওয়া চোখ দিয়ে আবারো তাকায় দরজার দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা লাশ। পোস্টমর্টেমের জন্য যাকে কাটা-ছেঁড়া করে আজ বিকেলে মর্গে রেখে এসেছেন তিনি।
*******
চারদিকে তাকিয়ে ডা. মিত্র বুঝতে পারেন না তিনি কোথায় রয়েছেন। বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে বাইরে। তবে ঝড় কমে গেছে। তিনি শুয়ে আছেন বেডরুমে। কিন্তু তাঁর তো এখানে আসার কথা না। জ্ঞান হারানোর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সে ছিল দরজার কাছে? আর সে লাশটা? তাকে বিছানায় কে আনলো? লাশটা? তাঁর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠা-া ¯্রােত নেমে এলো। সেটা কিভাবে হয়? নাড়ি ভুরি আলাদা করে ফেলা পাঁচদিনের একটা পচা লাশ জীবিত হয় কি করে? তাহলে কি সে মরে গেছে? নাকি সবটায় দুঃস্বপ্ন?
গৌতম মিত্র বিছানায় উঠার চেষ্টা করে। আর তখনি তাঁর চোখ পড়ে মেয়েটার উপর। সারা শরীরে কুৎসিত ব্যান্ডেজ বেঁধে লাল চোখে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে অপলক। দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। কি নাম যেন মেয়েটার? ডা. মিত্র স্মরণ করার চেষ্টা করেন। মনে পড়ে মেয়েটার নাম তাঁর। বিথী। মেয়েটার নাম বিথী। তিনি বার বার কয়েক বিড় বিড় করে নামটা পড়েন। “বীথি, তুমি? তিনি ধীরে ধীরে বলেন। মেয়েটি আড়ষ্ট হয় প্রথমে। হাত দিয়ে চোখের রক্ত মুছে। তারপর কর্কশ কণ্ঠে বলে “আমার নাম বিথী নয়।” তাহলে? ডাক্তারের মুখ থেকে কথাটা এমনি বেরিয়ে আসে। তিনি অবাক হন। তাঁর মনে আছে মেয়েটির নাম বীথি ছোমার? “কি নাম তোমার?” ডাক্তার জিজ্ঞেস করে। “আমার নাম শ্যামা”। “না”………। কেঁপে উঠে ডাক্তার। তা কিভাবে হয়। শ্যামা তাঁর মেয়ের নাম।
এই মেয়েটির নাম বীথি। কিন্তু মেয়েটা তাঁর সাথে মিথ্যা কথা বলছে। তিনি বিরক্ত হন। “তুমি শ্যামা নও। তোমার নাম বীথি। তুমি মরে গেছ। মেয়েটি কোন কথা বলেনা। বাতাসের শব্দ শুনা যাচ্ছে। তাঁর মানে আবার ঝড় আসবে। চার্জ লাইটের মৃদু আলোয় মেয়েটির দিকে তাকান গৌতম মিত্র। বাচ্চা একটা মেয়ে। অথচ সারা শরীর সাদা ব্যান্ডেজে ঢাকা যেন সাদা কাফন পরে মেয়েটি বসে আছে। “তুমি কেন এসেছ? মৃদু, ক্লান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে ডাক্তার।
– আমার পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা নিতে?
– কি নিতে? আঁতকে উঠে ডাক্তার।
– আমার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট। মেয়েটি আবার বলে।
ডাক্তার ঘামতে থাকে ভিতর থেকে। মেয়েটা মারা গেছে ১২০ ঘণ্টা আগে। কয়েকজন মিলে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। তারপর তাকে খুন করে লাশ ফেলে রাখে একটা ড্রেনে। কিন্তু একি দেখছে সে। মেয়েটা দিব্যি বেঁচে আছে। কথা বলছে তাঁর সাথে। অথচ সে এসেছে তাঁর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিতে। “তুমি বেঁচে আছ নাকি মরে গেছ? এবার ডাক্তার জিজ্ঞেস করে।
– কেন আপনি জানেন না?
– “আহ, যা বলছি তাঁর উত্তর দাও”, বিরক্ত হয় ডাক্তার। তুমি বেঁচে আছ?
– না, আমি মরে গেছি। কান্নার মত শোনায় মেয়েটির গলা।
– আমি বেঁচে আছি? নিরস কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে ডাক্তার
– ওমা, আপনি জানেন না?

********
– রিপোর্ট দিয়ে তুমি কি করবে?
– পুড়িয়ে ফেলব?
– কেন?
– কারণ ওটা মিথ্যা রিপোর্ট। আপনি মিথ্যা করে রিপোর্ট সাজিয়েছেন।
ডাক্তার বেশ অবাক হন মেয়েটির কথা শুনে। তিনি যে মিথ্যা রিপোর্ট সাজিয়েছেন এটা মেয়েটির জানার কথা না। রিপোর্টটা অবশ্য সে ইচ্ছা করে মিথ্যাভাবে সাজায়নি। উপর থেকে নির্দেশ আসার পরই কেবল তাকে কেসটা এভাবে সাজাতে হয়েছে। যারা মেয়েটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করে ড্রেনে ফেলেছে তারা উপরের শ্রেণির লোক। রিপোর্টটা মিথ্যাভাবে সাজাতে তাকে হুমকি দেয়া হয়েছে এবং ডাক্তার জানে তাকে হুমকিদাতারা মিথ্যা হুমকি দিচ্ছেনা। তাঁর নিজেরও একটা মেয়ে আছে। নিতান্ত বাধ্য হয়েই কাজটা করছেন উনি। কিন্তু মেয়েটির এসব জানার কথা নয়। তাছাড়া তাঁর মেয়ের নামও এর জানার কথা নয়। তাহলে কি মৃতরা সব জানে? তাইবা সে জানবে কিভাবে? সে কি মরে গেছে? মরে গেলে তো সেও মেয়েটির মত সবজানতা হয়ে যেত। ডা. মিত্র গলাটা একটু পরিষ্কার করে নেয়। তারপর নিজেকে প্রস্তুত করে। তাঁর সবকিছু পরিষ্কার হওয়া উচিত। সে খুব ঠা-া গলায় একেবারে শিক্ষকদের মত বলে “শোন, বীথি। তুমি একজন মৃত মানুষ। তুমিÑ
– আমাকে খুন করা হয়েছে।
– ঠিক আছে। তোমাকে খুন করা হয়েছে। তারপর?
– অপমৃত্যু বলে চালিয়ে দেয়।
– কিন্তু?
– আমার শরীরে খুনের চিহ্ন রয়েছে। এই দেখুন।
মেয়েটি শাড়ির আঁচল নামিয়ে দেয়। তারপর তাঁর ব্লাউজে হাত দেয়। “দেখুন”। ব্লাউজের বোতাম খুলতে থাকে সে।
– না…. ডাক্তার চিৎকার করেন।
– কেন? মেয়েটি নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে ডাক্তারের দিকে। “লজ্জা পাচ্ছেন? বিকালে যখন আমাকে কাটাছেঁড়া করেন তখন তো লজ্জা পাননি। তাছাড়া আমি তো শ্যামা। আপনার মে…
– সাবধান আমার মেয়ের কথা বলবে না। তুমি শ্যামা নও। তুমি বীথি। বুঝতে পেরেছ? তুমি বীথি।
তুমি একটা লাশ। খুন হয়ে যাওয়া লাশ।
– তাহলে রিপোর্টে তা লিখেননি কেন? কেন লিখেছেন আমি আত্মহত্যা করেছি?
– আমি যা করেছি বাধ্য হয়ে করেছি। এবার তুমি যাও।
– না
– না?
– রিপোর্ট না নিয়ে আমি যাব না।
– রিপোর্ট দিয়ে তুমি কি করবে বলো। তুমি তো মৃত।
– আপনাকে বলেছি ওই মিথ্যা রিপোর্ট আমি পুড়িয়ে ফেলব।
– রিপোর্ট তুমি পাবে না।
– পাব। আমি রিপোর্ট নিয়ে যাব।
– জোর করে?
– হ্যাঁ
– বীথি, শোন
– আমি শ্যামা।

******
ডাক্তার গৌতম মিত্র অনড় বসে থাকেন। ঝড়ের বেগ আরো বেড়েছে। শনশন শব্দে বাতাস হচ্ছে বাইরে। তীব্র বাতাসে বৃষ্টির ফোটা জানালা গলে ঘরের ভিতর এসে ঢুকছে। এ দুর্যোগ আর কতক্ষণ থাকবে? কতক্ষণ ধরে ধরিত্রী এ তা-ব লীলা চালাবে? মুহূর্তের জন্য ডা. মিত্র অতীতে চলে যান যেখানে একই রকম ঝড় তাঁর জীবনটাকে তছনছ করে দিয়েছে। সে ঝড়ে জীবনের শুরুতেই ভেঙ্গে গেছে তাঁর ঘর। বিয়ের এক বছরের মাথায় তাঁর স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে চলে যায় আমেরিকা। সাথে নিয়ে যায় তাঁদের একমাত্র সন্তান শ্যামাকে। তারপর থেকে একা আছেন ডা. গৌতম মিত্র। গত বিশ বছর ধরে। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয় শ্যামার সাথে। মেয়েটাকে সে জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। কিন্তু মেয়েটা আছে কত দূরে। ডাক্তারের মুখ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। এখন তাঁর মনে হয় তাঁর বিছানায় যে মেয়েটা বসে আছে সে শ্যামাই। মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তিনি গাঢ় কণ্ঠে ডাকেন “শ্যামা– কি বাবা?
– কাঁদছিস কেন?
– এমনি।
– এমনি কেউ কাঁদে? মা বকেছে?
– না
তিনি অবাক হন। তাহলে মেয়েটা কাঁদছে কেন। তিনি উঠে গিয়ে মেয়েটার কাছে যান। কী আশ্চর্য ! বিছানায় কেউ নেই। ঝড় কমে গেছে বাইরে। চার্জলাইটের আলো কমতে কমতে ধপ করে নিবে যায়। তিনি অন্ধকারে বিছানা হাতড়ান। কেউ নেই সেখানে। “শ্যামা, মা, তুই কই গেলি”। তাঁর চোখ বেয়ে পানি পড়ে। তিনি চিৎকার করে ডাকেন “শ্যামা”। দৌড়ে বাইরে আসেন। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। তিনি আবার ডাকেন “শ্যামা……. শ্যামা…… বৃষ্টির জল আর চোখের জল তখন আলাদা করে চেনা যায়নি। অবিরাম কেঁদে চলে ঝড় জল রাত।

********
পরদিন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট জমা দিয়ে আসার পনের মিনিট পর ডিরেক্টর মি. মাহতাব উদ্দিনের রুমে ডাক পড়ে তাঁর। রুমে ঢোকার সাথে সাথেই বসতে না বলেই মাহতাব উদ্দিন বলেন, “এটা কি করলেন আপনি? কি রিপোর্ট দিলেন? আপনি জানেনে আপনি কত বিপদে পড়তে যাচ্ছেন?” একদমে কথাগুলো বলে ডা. গৌতম মিত্রের নি¯পৃহ চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলেন। “আমি যা দেখেছি তাই লিখেছি।” শীতল গলায় যেন কোন মৃত কথা বলছে এমন ভাবে কথা বলে ডা. মিত্র। মাহতাব উদ্দিন কেমন ভয় পায়। “বসুন”, মি. মিত্র হাত বাড়িয়ে দেয়। হাতে হাত পড়াতে বিদ্যুৎ শক খায় মাহতাব উদ্দিন। মৃত মানুষের মত ঠা-া হাত। ভয়ে ডাক্তার মিত্রের চোখের দিকে তাকান মাহতাব উদ্দিন। পলকহীন শীতল চাহনি। অজানা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায় মাহতাব উদ্দিন। তাড়াতাড়ি বিদায় জানানোর জন্য বলে মাহতাব উদ্দিন বলে “ঠিক আছে, ভালোই করেছেন। যা দেখছেন তাইতো লিখবেন। হা হা হা” পান খাওয়া মুখে তাঁর সামনের নকল দাঁতটি ঝিলিক দিয়ে উঠে। “যান তাহলে, তবে শুনছেন কি? মেয়েটা মানে লাশটার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে কাল রাতে?
– কি বললেন ? কি হয়েছে? শীতল চোখের পাপড়ি একবার মাত্র নড়ে উঠে ডা. মিত্রের।
– লাশটার। আজ সকালে দেখা যায় দু’চোখ বেয়ে রক্ত পড়ছে এর। মনে হয় কেউ একটু আগে কোটর থেকে চোখ দুটি তুলে ফেলেছে তাঁর। অথচ লাশটা ছ’দিনের পঁচা লাশ। তাছাড়া—-
– তাছাড়া?—-এমন জোরে বলে ডা. মিত্র যে মাহতাব উদ্দিন চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে। তারপর ডা. মিত্রের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে “লাশটার পুরো শরীর ভেজা। রাত্রে ঝড়ে মর্গের ভিতর পানি ঢুকে যায়। সারারাত পানিতে ভেসেছে।
– এমনকি হতে পারে লাশটা কালকে বাইরে চলে যায় কোনভাবে। ওই যে চোখ দু’টির কথা বললেন।
আস্তে আস্তে একেবারে অস্ফুট স্বরে বলে ডা. মিত্র।
– কি যে বলেন? আপনি পাগল হলেন মি. মিত্র। লাশ আবার হাঁটতে পারে। চোখ দুটির কথা বললেন? হতে পারে বৃষ্টির পানির সাথে দু একটা রাক্ষুসে মাছ ঢুকে যায় মর্গে। এরাই খেয়ে নিয়েছে চোখ দুটি।”
ডা. মিত্র বলতে যায় তাহলে চোখে রক্ত এল কিভাবে। পাঁচ দিনের মৃতের তো চোখ বেয়ে রক্ত পড়তে পারে না। কিন্তু উনি কিছু বলেন না। নীরবে ঘুরে চলেন নিজের রুমের দিকে।
“ডা. মিত্র” পিছন থেকে ডাকেন মাহতাব উদ্দিন “আপনি কি অসুস্থ?”। “না, আমি ঠিক আছি” বলে রুম ছেড়ে চলে যায় ডা. মিত্র। এসি রুমের দরজা বন্ধ হয়ে যায় নীরবে। মাহতাব উদ্দিন চেয়ারে বসেন আবার।
তিনি চিন্তায় মগ্ন হন। কি হল ডা. মিত্রের? এমন ঠা-া হাত। কেবল মৃতেরই হয়। তারপর সেই শীতল চাহনি? পলক না পড়া চোখ। নাহ! চোখে আবার কি পড়ল? মাহতাব উদ্দিন চোখে হাত দেন। তাজা লাল রক্তে ভিজে যায় তাঁর হাত।

***********
ডা. মিত্র রুমে আসার সাথে সাথে রাখির ফোন পান। তিনে স্ক্রিনে তাকিয়েই উদাসী হন। বিশ বছর।
রাখি এখন অন্যের স্ত্রী। মাঝে মাঝে মেয়েকে চাইবার সময় কেবল এক-আধটু কথা হয় তাঁর সাথে। সেই একই কণ্ঠ। একই স্বর। একই রকম মমতা। ডা. মিত্র যেন অতীতের সবকটা দরজা খুলে দেন। কিন্তু মোবাইলের বাজতে থাকা রিংটোন তাঁকে বর্তমানে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। “হ্যালো?” সে ভেজা গলায় বলে।
– হ্যালো, গৌতম। শ্যামার এক্সিডেন্ট হয়েছে।
– হোয়াট? গৌতম মিত্র চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠেন।
– কাল রাতে। আটলান্টিক স্ট্রিটে।
– এখন কেমন? পায়ের নিচের মাটি যেন সরে যায় ডা. মিত্রের। সে অসুস্থ বোধ করে। কাঁপতে থাকে থরথর করে।
– হাসপাতালে আছে। সারারাত কোমায় ছিল। এখন কেবিনে আছে। চোখ দুটিতে….
– কি বললে? ডাক্তার এমন জোরে চিৎকার দেয় যে ওপাশ থেকে রাখির হাত থেকে ফোন পড়ে যায়।
– চোখ দু’টিতে রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছে না। ডাক্তার বলছে—-
দু’হাত দু’চোখের কোটরে ঢুকিয়ে দিয়ে দলা দলা রক্তে হাত ভিজিয়ে ডা. গৌতম মিত্র যেন নিজেকেই শুনিয়ে অস্ফুট শব্দে বলে “আমি জানতাম।”
************
[মনিরুল হাসান (শিমুল), সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, সুনামগঞ্জ]

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com