আমার জন্ম সুনামগঞ্জ জেলার এক গ্রামে। ওখানেই কেটেছে আমার শৈশব। কৈশোর থেকেই পরবাসী। তবু এখনো যখনই নিজেকে একটু আলাদা করে যাচাই করে দেখার চেষ্টা করি, মনে হয় আমি সুনামগঞ্জের-সুনামগঞ্জ আমার। সোজা কথায় অস্তিত্বের সঙ্গে সুনামগঞ্জের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য! আজকের এই আমি যেন সুনামগঞ্জের কাদামাটি আর আলো-হাওয়ারই সৃষ্টি। বাইরের হাওয়া যদি কিছু পুষ্টি জুগিয়ে থাকে, জুগিয়েছে অবশ্যই, তার অবলম্বনটুকু সুনামগঞ্জ থেকেই পাওয়া।
পরবাসী শব্দটার একটু ব্যাখ্যা দরকার। পরবাস বা প্রবাস বলতে এখন ভিন দেশে বসবাসকেই বোঝায়। শব্দটির আভিধানিক অর্থও তাই। আমাদের ছোটবেলা কিন্তু বাড়ি তথা গ্রামের বাইরে এক আধ দিনের দূরন্তে পা বাড়ালেই তাকে প্রবাস যাত্রা বলা হতো। এই সীমিত অর্থেই শব্দটির ব্যবহার।
কৈশোরের শুরুতেই মৌলভীবাজার। ওখান থেকে সিলেট, লাহোর (পাকিস্তান) হয়ে ঢাকায় স্থিতু হওয়া। সেই থেকে এখানেই আছি। মাঝে মধ্যে, তাও বেশ দীর্ঘ বিরতিতে, নিজ গ্রামে গেলেও তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ। তবু দেশের উত্তর-পূর্ব কোণে মেঘ জমতে দেখলে মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সময় বুঝে মাঠের ফসলের কথা ভেবে মন ব্যাকুল হয়ে পড়ে। যত দূরেই থাকি শিকড়ের টান কাটাতে পারি না। এই টান যে কাটাতে চাই তাও না। এই আবেগটুকু লালন করে মনের প্রসন্নতা উপভোগ করি। আমি সুনামগঞ্জের, সুনামগঞ্জ আমার এই অনুভূতির তুলনা হয় না। এর ব্যাখ্যাও অসম্ভব।
এটুকু ভনিতা থেকে মনে হতে পারে, আমি বুঝি সুনামগঞ্জ নিয়েই মগ্ন হয়ে আছি। অকপটে স্বীকার করছি, আমার জীবনে তেমন কিছু ঘটেনি। সব অর্থেই আমার অবস্থান সুনামগঞ্জ থেকে অনেক অনেক দূরে। সুনামগঞ্জ থেকে কেবল নিয়েছি, তাকে কিছু দেয়ার সামর্থ্য আমার কখনো হয়নি। কেবল ওখানে জন্ম নিয়েছি তাই নয়, বড় হয়ে ওঠার তাবৎ রসদও জুগিয়েছে সুনামগঞ্জের সেই ছোট গ্রাম। মনের দিকে ফিরে তাকালেও দেখি, মানসিকতার যেটুকু ভালো তার সব কিছুই ওখান থেকে পাওয়া। জগত আর জীবনকে দেখার দিশাও সেই দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে একটা উদাহরণই উল্লেখ করি। ধর্ম ও বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে কেবল মানুষ হিসেবে দেখা, এ যুগের ভাষা যাকে ধর্মনিরপেক্ষতা বলি, তার শিক্ষাও পেয়েছি শৈশবেই, সুনামগঞ্জের গ্রামে বসবাস কালে। সুনামগঞ্জ মুসলিম প্রধান হলেও হিন্দুদের সংখ্যাও নগণ্য ছিল না। এখনও নয়। আমার শৈশব থেকেই দেখে আসছি, ধর্মকর্ম পালনের বাইরে এদের মধ্যে তেমন কোনো বিভেদ নাই। দুই ধর্মের পেশাজীবীরাই মিলে মিশে, অনেক সময়ই একে অন্যের সহযোগিতায়, নিজেদের কাজ তথা বৈষয়িক জীবন অতিবাহিত করছেন। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের উদাহরণ হিসেবে মনে পড়ছে, ভাটি এলাকা বিধায় যাতায়াতের অবলম্বন ছিল নৌকা। দূরের পথে চলতে চলতে দিশা নিয়ে দ্বিধা দেখা দিলে মাঝিরা দেখতেন আশেপাশে কাউকে দেখা যায় কি-না। কারো দেখা পেলেই হাঁক দিতেনÑ ও দাদা না ভাই, অমুক গ্রামে যাবো পথটা কোন দিকে? যাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে সে হিন্দু না মুসলিম সে পরিচয় তো তার চেহারায় লেখা নাই। তাই সম্বোধনে ‘দাদা না ভাই’ ব্যবহার। উদ্দিষ্ট ব্যক্তির এতে আহতবোধ করার কোনো কারণ থাকলো না। পারস্পরিক শ্রদ্ধা-সম্ভ্রমের কল্যাণেই জনজীবন ছিল শান্তি আর কল্যাণের আকর। আমি আজো এই জীবনের বিকাশেরই স্বপ্ন দেখি।
এভাবে পাওয়ার আমার শেষ নাই। দুঃখ কেবল দিতে পারিনি কিছুই। উনিশ শ একাত্তর একটা সুযোগ করে দিল। তার কিছু ব্যবহার করতে পেরেছি, এই আমার সন্তোষ। এটুকুই আমার অস্তিত্বের অহংকার।
সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়ায় ঢাকাতেই স্থায়ী আস্তানা পাততে হয়। দীর্ঘ সময়ের জন্য ঢাকা ছাড়তে হবে, এমন ধারণা স্বপ্নেও ছিল না। ২৫ মার্চ হঠাৎ করে কালরাত নেমে এলো। বুঝলাম এবার ঢাকা ছাড়তে হবে। নিতে হবে মুক্তিযুদ্ধ তৎপরতার সাধ্যমতো অংশ। এতে বিকল্প ছিল দুটি। এক, আগরতলা হয়ে মুজিবনগর তথা কলকাতা চলে যাওয়া। লেখালেখির মাধ্যমে দায়িত্ব পালন। দুই, নিজ এলাকা সুনামগঞ্জে গিয়ে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানো। সম্ভব হলে অস্ত্র নিয়ে হানাদারদের মোকাবেলা করা।
প্রথম বিকল্পটি তুলনায় সহজ ছিল, অন্তত আমার জন্য। তবে শিকড়ের টানে আমি দ্বিতীয় পথটাই বেছে নিলাম। ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি পৌঁছানো (মাইল দশ/পনেরো ব্যতিক্রম বাদে। মোড়াপাড়া থেকে টুক, এটুকু পথ লঞ্চে পাড়ি দিয়েছিলাম।) যেমন ছিল কষ্টকর তেমনি অন্যদিক থেকে তৃপ্তিকরও কম ছিল না। এর ফলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা স্পষ্টতর হয়।
একাত্তরের আগে নিজ গ্রাম এবং আশাপাশের কয়েকটি গ্রাম ও থানা সদরের কিছু মানুষ ছাড়া এলাকার সঙ্গে আমার পরিচয় বলতে কিছু ছিল না। একাত্তর সুযোগ করে দেয় ব্যাপক পরিচিতির। সম্ভব করে তোলে হিন্দু-মুসলিম সকল শ্রেণির মানুষের সহযোগিতায় ভাটি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ তৎপরতা জোরদার করে তোলা। আমার পক্ষে কিছু করা যদি সম্ভব হয়ে থাকে, সে কৃতিত্বের গৌরব সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষেরই প্রাপ্য। কৃতজ্ঞ চিত্তে আমি আজো স্মরণ করি। এখানেও দেয়ার চেয়ে পাওয়াই ছিল বড়। অশেষ তৃপ্তি আর সম্মান দিয়ে সুনামগঞ্জের মানুষ আমার পাওয়ার ঝুলি ভারি করেছেন।
মনে পড়ছে জগন্নাথপুর থানা নিরস্ত্র করার কথা। যদ্দুর মনে পড়ে ২২ জুলাই ভোরে জগন্নাথপুর থানায় হামলা চালাই। তখন ব্যাপারটাকে ভয়ংকর আর ঝুঁকিপূর্ণ মনে করলেও আদতে ঘুমের মাঝেই পুলিশদের ধরে থানা তছনছ করে দেয়া ছিল ডাল-ভাতের মতো সহজ কাজ। কাজটা সম্পন্ন করে অস্ত্রপাতি নৌকায় তুলতে তুলতে বেশ বেলা হয়ে গেল। থানার পাশে খাল আর খালের ওপারে বাজার। বাজার থেকে চা-নাস্তা পাওয়া যায় কি না, জানতে চাইতেই এগিয়ে এলেন ব্যারিস্টার মীর্জা আবদুল মতিন (প্রয়াত)। তিনি ব্যবস্থা করেছেন জানাতেই বলে দিলাম, যাই দেয়া হোক, তার দাম নিতে হবে। দাম দিয়েই কিছু সিগারেটও সংগ্রহ করেছিলাম।
আমাদের অভিযানের প্রতিক্রিয়া জানতে পরে লোক পাঠালে শুনলাম, বাজার আর আশপাশের লোকেরা বলছেন, কোনো যোদ্ধা নয়, একজন দরবেশ তাদের থানায় এসেছিলেন। কোন হিন্দু গ্রামে উঠলে অনেকে ‘দেবতা’ বলে ভক্তি দিতে আসতেন। শ্রদ্ধা দেখানোর এসব বাড়ি বাড়ি সাধ্যমতো নিরুৎসাহিত করেছি। এসব স্মৃতি কিন্তু এখন বেশ আনন্দ দেয়।
একাত্তরই সুনামগঞ্জের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করেছে। নিজের গ্রামে না গেলেও বছরে দু’একবার অন্তত সুনামগঞ্জ শহরে যেতে হয়। যেতে হয় কোনো কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। আর সেই থেকে প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের সময় মাসখানেক নিজ এলাকায় কাটানো নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। আমি যা ভালো মনে করি এলাকার মানুষকে তা জানানো কর্তব্য গণ্য করি।
সুনামগঞ্জকে কিছু দেয়া প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক একটা ছোট কাজের কথা উল্লেখ করতে ইচ্ছে করছে। সুনামগঞ্জের একজন কবি ছিলেন প্রজেশ কুমার রায় (১৯০৯-১৯৬২)। আঞ্চলিক কবি নন। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবি হিসেবে সাম্প্রদায়িকতার ছুরিকাঘাতে নিহত হন তিনি। পাকিস্তানি আমলে নিহত, তাই কেউ তখন এ নিয়ে কথা বলার সাহস করেননি। প্রজেশ কুমার রায় হারিয়ে যান বিস্মৃতির অতলে। তার কোনো বইও এখন আর পাওয়ার উপায় নাই।
আমি তাই নিজের একটি নিবন্ধ এবং প্রজেশ কুমার রায়ের কিছু বাছাই কবিতা দিয়ে ‘প্রজেশ কুমার রায় : কবি ও কবিতা’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছি। আমি এই বইটিকে সুনামগঞ্জ তথা আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির কাছে নিজের দায় শোধের এক ক্ষীণ প্রচেষ্টা বলেই মনে করি।
জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে কোনো কোনো ব্যক্তির প্রতি যেমন তেমনি এলাকা-বিশেষের প্রতিও ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে। যাঁরা নিজ কর্মে সে ঋণ শেষ করে যান তাঁরা অবশ্যই শ্রদ্ধেয়। আমি তা পারিনি। নতুন করে কিছু করার মতো সময়ও আর আমার কাছে নাই। সুনামগঞ্জের কাছে ঋণ স্বীকার করেই আমাকে বিদায় নিতে হবে। যদি শেষ মুহূর্তে উচ্চকণ্ঠে কিছু বলার শক্তি থাকে, অবশ্যই বলবো, ‘আমি সুনামগঞ্জের, সুনামগঞ্জ আমার’।
[সালেহ চৌধুরী, দৈনিক বাংলার বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক, মুক্তিযোদ্ধা।]