1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ০৭:২৫ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

হাওরে হাহাকার-১ : বাজছেনা বিয়ের বাদ্যি

  • আপডেট সময় বুধবার, ২১ জুন, ২০১৭

শামস শামীম, হাওরাঞ্চল ঘুরে এসে ::
একচালা টিনের ভাঙ্গাচোরা ঘর। পরনে ময়লা ছাপার কাপড় পরে বারান্দায় বসে আছেন শাল্লা উপজেলার বাহারা গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ কিষাণী সবিতা রায়। বিয়ের সোমত্ত দুই মেয়ে ঘরের ভেতর শতচ্ছিন্ন জামা গায়ে উকিঝুকি দিচ্ছে। বৈশাখি ফসল গোলায় উঠলে জ্যৈষ্ঠ মাসে বড় মেয়ে টপি রায়ের বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। বিয়ের উপযুক্ত বড় সন্তান সুজন রায়কেও বিয়ে করানোর কথা ছিল। কিন্তু জীবন চলার একমাত্র অবলম্বন হাওরের বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ায় স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে তাঁর। ভেঙে গেছে মেয়ে টপি রাণী রায়ের বিয়ে। শুধু টপি রায় ও সুজন রায়ই নয় হাওরের হাজার হাজার ছেলে-মেয়ের ধুমধাম বিয়ে হচ্ছেনা এবার। বিয়ের ঢাক-ঢোল বাদ্যি এবার বাজছেনা হাওরে। ফসল ডুবে যাওয়ায় এখন বেঁচে থাকাই দায় তাদের।
খাদ্য উদ্ধৃত্ত জেলা সুনামগঞ্জের কৃষকের ভাড়ার এবার খাদ্যশূন্য। অ্যামোনিয়া গ্যাসে মাছ মারা গেছে। খাদ্যাভাবে গোয়ালের গরু বিক্রি করে দিচ্ছে কৃষক। গরু বিক্রির টাকায় খাদ্য কেনার পর মজুদ ফুরিয়ে আসায় স্ত্রীর কানের স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করে খাদ্য কিনছেন অনেকে। খাদ্যহীন সচ্ছল কৃষক লজ্জার মাথা খেয়ে এখন লাইনে দাঁড়িয়ে ওএমএসের চাল কিনছে। ছেলে-মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ। ঋণের তাড়ায় কেউ দেশ ছেড়ে, কেউ এলাকা ছেড়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে এসে এক অনিশ্চিত জীবন বেছে নিয়েছে। এখন কিছুটা সামাল দেওয়া গেলেও সামনে ভয়াবহ অভাবের কথা ভেবে অস্থির তারা।
কৃষকরা জানান, হাওরের ধান গোলায় উঠার পর উৎসবের আমেজ বিরাজ করে হাওরের গ্রামে গ্রামে। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে শুরু হয় বিয়ের ধুমধাম। ধান বিক্রির টাকায় ঘটা করে ছেলে-মেয়েকে বিয়ে দেন তারা। এই সুযোগে স্বজনদের নাইওর আনা হয়। কলাগাছের তোরণে রঙিন কাগজে সাজানো হয় বিয়ে বাড়ি। কাগজের আল্পনা টাঙ্গায় তরুণ-তরুণী। সাজানো হয় বিয়ের নৌকা। বিয়েকে কেন্দ্র করে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে হিন্দু-মুসলমান কৃষকের মধ্যে। তাছাড়া হিন্দুরাও বৈশাখ শেষে নতুন ধানে কর্মাদি (জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তি) পালন করেন। এবার ফসল তোলার পরবর্তী সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবের চিরচেনা দৃশ্য হাওরে দেখা যাচ্ছেনা।
সবিতা রায় বলেন, ‘২০ কেয়ার পরের জমিন খরছিলাম। পাইন্যে আগল নিছেগা’। (৬ একর জমিতে চাষ করেছিলাম, আগাম পানিতে ধান ডুবে গেছে)। সবিতা জানান, তার বড় মেয়ে টপি রাণীর বিয়ের কথা-বার্তা ঠিক ছিল। স্থানীয় মেম্বার রঞ্জু দাস বিয়ের আলাপ নিয়ে এসেছিলেন। ফসল উঠার পর দিনপঞ্জি ঠিক করে মেয়েকে বরের হাতে তুলে দেওয়ার কথা। মেয়ে বিয়ে দেবার পর ছেলে সুজনকেও পাশের গ্রামে বিয়ে করানোর কথা। কিন্তু কোনটাই হলো না। ফসল তলিয়ে যাওয়ায় এখন খাবারের চিন্তায়ই অস্থির থাকতে হয় তাকে। এবার ছেলে-মেয়ের বিয়ে কোনভাবেই দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিয়ের উপযুক্ত মেয়েকে কোন নতুন জামা-কাপড়ও কিনে দিতে পারেননি তিনি। মলিন কাপড়ে চোখ মুছে এসব যন্ত্রণার কথা বলছিলেন তিনি।
দিরাই উপজেলার তাড়ল গ্রামের আনহার মিয়া চৌধুরী (৩৫)। আগের মতো অঢেল সম্পত্তি না থাকলেও ঘরের খেয়ে বছর পার করতে পারেন। হাওরের ফসল গোলায় ওঠার পর আষাঢ় মাসে তার বিয়ের কথা ছিল। কনেও টিক করা ছিল। বিয়ের সকল আলাপ-আলোচনা শেষ ছিল। ফসল তলিয়ে যাওয়ায় বিয়ে হচ্ছেনা তার।
আনহার মিয়া এখন পারিবারিক নৌকা নিয়ে হাওরে যাত্রী পরিবহন করে পরিবারকে সহায়তা করছেন। আনহার মিয়া বলেন, ‘আষাঢ় মাসে দিন তারিখ দেখে বিয়ের কথা ছিল। দেড় ভরি স্বর্ণ, কাপড়-চোপড়সহ আনুষঙ্গিক সকল আলাপ শেষ ছিল। ধান তলিয়ে যাওয়ায় বিয়ের স্বপ্ন শেষ। স্বর্ণালঙ্কার ও কাপড়-চোপড় কেনা এবং বিয়ের ধুমধাম খরচ করার কোন সামর্থ্য নেই বলে জানা তিনি। তাই এবার বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে আগামী বছর বিয়ের স্বপ্ন দেখছেন আনহার মিয়া। তবে আগামী বছরও নিরাপদে ফসল উঠবে কি না জানেন না তিনি।
শাল্লা উপজেলার ছব্বিশা গ্রামের সচ্ছল কৃষক সিরাজ মিয়া। প্রতি বছর হাজার মণ ধান পেতেন। এবার এক মুঠো ধানও গোলায় তোলতে পারেননি। সিরাজ মিয়া গরু বিক্রি করে মাস দেড়েক চলার পর সম্প্রতি স্ত্রীর কানের স্বর্ণ বিক্রি করে দিয়েছেন। স্বর্ণ বিক্রির টাকায় এখন সংসার চলছে। এর থেকে দুই সন্তানের পড়ালেখার খরচ, চিকিৎসা খরচ চালাতে গিয়ে টাকা ফুরিয়ে যাচ্ছে তার। এবার রমজানে ইফতার ও সেহরি এক খাবারেই সারতে হচ্ছে তাকে।
সিরাজ মিয়া বলেন, আমার চেয়ে বড় কৃষক এই তল্লাটে নেই। এখন আমার ঘরেই ভাত নেই। গরু বিক্রি, স্বর্ণ বিক্রি করে খাচ্ছি। তিনি বলেন, গরিব-ধনীসহ হাওরের সবারই এখন এক অবস্থা। মৌসুমের আগে দিন তারিখ ঠিক করে রাখা এলাকার অনেকের বিয়েও ভেঙে গেছে অভাবের কারণে। এবার হাওরে বিয়ের বাদ্যি বাজছেনা। আরো কয়েক দিন গেলে হাওরের অভাব আরো ভয়াবহ হবে বলে জানান এই কৃষক।
শাল্লা উপজেলা সদর ইউনিয়নের বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রার মো. আব্দুর রশিদ বলেন, অন্যান্য বছর জ্যৈষ্ঠ মাস শুরুর পরই বিয়ের ধুম পড়ে। ফসল ডুবে যাওয়ায় এবার বিয়ে-শাদি হচ্ছেনা। এই সময়ে এসে প্রতিদিন গড়ে ৫-৭টি বিয়ে পড়াতাম। এখন একটি বিয়েও পড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। একমাত্র হাওরের ফসল গোলায় ওঠার উপরই হাওরের বিয়ে-শাদি-সামাজিক-ধর্মীয় উৎসব পালন হয় বলে তিনি জানান।
শাল্লা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাছুম বিল্লাহ বলেন, ধনি গরিব সকল কৃষকের একই অবস্থা। সবার ফসল মার গেছে। নানা ধরনের সমস্যায় আছেন তারা। উপজেলার কৃষকদের সহায়তা বৃদ্ধির জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট দফতরে আবেদন জানিয়েছি। তাছাড়া সরকার কৃষকদের সহায়তায় আরো নানা ধরনের প্রণোদনার চিন্তা করছে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com