পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং অসাধু ঠিকাদারদের কারণে বাঁধ ভেঙে ফসলহানির ঘটনা এ বিষয়টি এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে পাউবো’র কর্মকর্তারা তা স্বীকার করেছেন। ফসলহানি পরবর্তী বিপর্যয়ের জন্য ওই দুর্নীতিবাজরাই দায়ী। তাদের জন্যই আজ হাওরবাসীর এতো দুর্ভোগ, এতো দুর্দশা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে হাওরের বাঁধের কাজের জন্য প্রতি বছর যে সরকারি বরাদ্দ আসে। এ বরাদ্দের সকল টাকা অসাধু কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা নিজস্ব সম্পদ মনে করে কোনো কাজ না করেই তা বাগিয়ে নেয়। প্রভাবশালী ঠিকাদারদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েন পাউবো কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
সুনামগঞ্জে হাওরে বাঁধ ভেঙে ফসলহানি বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দৈনিক প্রথম আলো। গত ৬ মে শনিবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়- প্রভাবশালী ঠিকাদারের কাছে পাউবো কর্মকর্তারা ছিলেন অসহায়। প্রতিবেদনে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজে নানা অনিয়মের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, সুনামগঞ্জে হাওরের ফসলহানির পর যে ঠিকাদারের নামটি বেশি আলোচিত হচ্ছে, তা হলো খন্দকার শাহীন আহমদ। ফরিদপুর জেলার গোয়ালচামট এলাকার বাসিন্দা তিনি। এই ঠিকাদার সুনামগঞ্জের আটটি হাওরের নয়টি ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ পেয়েছিলেন। তাঁর জন্য বরাদ্দ ছিল প্রায় নয় কোটি টাকা। কিন্তু তিনি পাঁচটি বাঁধের কোনো কাজই করেননি। অন্য চারটি বাঁধের মধ্যে দুটির কাজ হয়েছে ২০ শতাংশ, অপর দুটির ৪০ শতাংশ। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধ নির্মাণসংক্রান্ত সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
শুধু খন্দকার শাহীন নন, সুনামগঞ্জে ফসলহানির পর আলোচিত-সমালোচিত ঠিকাদারদের মধ্যে আরও আছে মেসার্স গুডম্যান এন্টারপ্রাইজ, সজীব রঞ্জন দাস, মেসার্স নুনা টেড্রার্স, মেসার্স নূর ট্রেডিং, ম্যাম কন্সট্রাকশন, মেসার্স ইব্রাহিম ট্রেডার্স অ্যান্ড মো. শামীম আহসান। এসব প্রভাবশালী ঠিকাদারের কাছে পাউবো কর্মকর্তারা ছিলেন অসহায়। তাঁদের কাছ থেকে কোনো কাজই আদায় করতে পারেনি পাউবো। আবার কোনো কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাউবোর কর্মকর্তাদের যোগসাজশও ছিল। এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজ পাওয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জেলার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন বলছেন, পাউবো এবং ঠিকাদারদের দুর্নীতির কারণেই হাওরবাসী বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বাঁধ নির্মাণ নিয়ে দুর্নীতি এবার প্রথম নয়, প্রতি বছরই হয়ে থাকে। তবে এবার দুর্নীতি অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন সুনামগঞ্জের আপামর জনগণ।
জানা যায়, সুনামগঞ্জে হাওরের ফসলরক্ষায় প্রতিবছরই পাউবোর অধীনে বাঁধ নির্মাণের কাজ করে ঠিকাদার এবং স্থানীয়ভাবে গঠিত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)। এবার ৭৬টি বাঁধ নির্মাণে ঠিকাদারদের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। পিআইসি পায় ২০ কোটি ৮০ লাখ টাকার কাজ। ঠিকাদারের কাজ ছিল নতুন বাঁধ নির্মাণ ও উঁচুকরণ। আর পিআইসির কাজ ছিল ভাঙা বাঁধের সংস্কার।
আরো জানাগেছে, ৭৬টি বাঁধের কাজ পেয়েছে ২৮ জন ঠিকাদার বা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু শুরু থেকে সুনামগঞ্জ জেলার বাইরের কয়েকজন ঠিকাদারকে নিয়ে লুকোচুরি শুরু করেন পাউবো কর্মকর্তারা। তাঁরা ওই ঠিকাদারদের স¤পর্কে তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তাঁদের দাবি ছিল, অনলাইনের মাধ্যমে দেশের যেকোনো স্থান থেকে দরপত্রে অংশ নেওয়া যায়। তাই সুনামগঞ্জ কার্যালয়ে ওই ঠিকাদারদের কোনো তথ্য নেই।
পাউবো’র সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঠিকাদারদের ৭৬টি কাজের মধ্যে ৯টির কোনো কাজ হয়নি। ১০ থেকে ৩০ শতাংশ কাজ হয়েছে ১৪টির, ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ হয়েছে ১৫টির, ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ হয়েছে ১৬টির, ৯০ শতাংশ কাজ হয়েছে ১৬টির। এ পর্যন্ত ৩৯টি বাঁধের কাজের আংশিক বিল হিসেবে ঠিকাদারেরা ৯ কোটি ৩৭ লাখ ৯৭ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার মেসার্স নুনা ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান তাদের দুটি কাজের ৪ কোটি ৩৭ লাখ ৭২ হাজার টাকার মধ্যে তুলে নিয়েছে ২ কোটি ১৫ লাখ ৭ হাজার। অন্য ৩৭টি প্রতিষ্ঠান ৪ থেকে সর্বোচ্চ ২৬ লাখ টাকা করে বিল পেয়েছে। বাকি ৩৭টি কাজের কোনো বিল এখনো দেওয়া হয়নি।
সুনামগঞ্জে এবার ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল। জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬১২ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ১৮৮ কৃষক পরিবার। তবে স্থানীয় কৃষক-জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, ৯০ শতাংশ ফসলই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, বাঁধের কাজে বরাদ্দকৃত অর্থ নিয়ে প্রতি বছরই লুটপাট হয়। এবছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ‘দুর্নীতি উন্নয়ন বোর্ডে’ পরিণত করেছিলেন অসাধু কর্মকর্তারা। সাথে ছিল প্রভাবশালী ঠিকাদার। এই দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই।