কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষি নির্ভর সংস্কৃতি ও লোকাচারের সাথে বাংলা সন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। জমিতে চাষ দেয়া, বীজ বোনা, ফসল তোলা, খাজনা দেয়া, সামাজিক ক্রিয়া-কর্ম, জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, সাদি, বাংলা সন-তারিখ নির্ভর। হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে গ্রামীণ জীবনধারায় বাংলা সন-তারিখের দীর্ঘ প্রচলন থাকলেও গ্রামীণ সংস্কৃতিতে হালখাতা ব্যতীত বর্ষবরণ বা নববর্ষের কোন অনুষ্ঠান নিকট অতীতেও লক্ষ করা যায়নি। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে বাঙালির অনিরুদ্ধ আবেগ, সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় সৃষ্টিশীল বিকাশ সম্ভব করে তুলেছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে পুষ্টি লাভ করে প্রতিনিধিত্বশীল পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বার মাসে তের পার্বণের এই দেশে ঐতিহ্য আনুগত্যে স্থানীয় মেলা বা উৎসব নতুন পরিসরে যুক্ত হয়ে বঙ্গ সংস্কৃতির পরিধি বিস্তৃত করে চলেছে। পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ উদ্যাপন মূলত লোকজ ঐতিহ্যর নাগরিক আগ্রহ থেকেই সৃষ্ট। তাই এর আবেদন নাগরিক জীবনে যেটুকু গ্রামীণ জনজীবনে তেমটি হয়ে উঠতে পারেনি।
ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লোকাচার ও জীবন ধারারও তারতম্য রয়েছে। অফুরন্ত কৃষি ও জলজ স¤পদে ভরপুর হাওর অঞ্চলের ছয় মাস শুষ্ক ও ছয় মাস জলাশ্রয়ী জীবনধারা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা ভিন্ন। এখানে বৈশাখ বর্ষবরণের আনন্দ নিয়ে আসে না। আসে ফসল তোলার সংগ্রামী আহ্বান নিয়ে। বৈশাখের রুদ্র রূপকেই বরণ করতে অভ্যস্ত তারা। প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে লড়াই করেই হাওর পাড়ের মানুষ বেঁচে থাকে। কখনও প্রকৃতির উদার সহনীয় আচরণে স্বস্তি বোধ করে, গোলায় ফসল তুলে তৃপ্তি পায় কিন্তু ফুসরত পায় না রঙে ভরা বৈশাখের রঙ উপভোগের। হাওরজুড়ে তখন অন্য এক উৎসব। ফসল কাটা, তোলা, মাড়াই, শুকানোর মহাযজ্ঞ। তার রূপ-রঙ ভিন্ন। আর যে বছর অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, প্লাবনে নদীর জল ফুলে-ফেঁপে উঠে হাওরে ঢোকার ফাঁক-ফোঁকড় খোঁজতে থাকে, ঠুনকো বাঁধ যখন কোন প্রতিরোধ ছাড়াই বালির বাঁধের মতো ভেসে যায়, চোখের সামনে তলিয়ে যায় ঘাম, শ্রম, যতœ পরিচর্যায় ফলানো কাচাপাকা ধান। সেই সাথে তলিয়ে যায় কৃষকের স্বপ্ন। তাদের বছরই শুরু হয় হতাশা আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে।
এবারও সেই একই অনিশ্চয়তার মাঝে হাওর পাড়ের লক্ষ-লক্ষ মানুষ লড়েছে ফসল রক্ষায়। শুধু প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা নয়, হাওর রক্ষায় নিয়োজিতদের লোভ-দুর্নীতি আর খামখেয়ালির কাছেও পরাজিত হয়েছে প্রকৃতির যোদ্ধা কৃষক। একে একে পতন হয়ে গেছে এক একটি হাওর। কৃষকের চোখে বৈশাখের এখন শুধু একটি মাত্র রঙ, সেটি অন্ধকার।
পহেলা বৈশাখ চিরন্তন। বর্ষবরণের অনুষ্ঠানÑ সে তো প্রতিবাদ, প্রতিরোধের দীপ্ত প্রত্যয়ে সংহত। হাওর ঘনিষ্ঠ সুনামগঞ্জে এবারের পহেলা বৈশাখ পালিত হোক ফসল রক্ষায় নিয়োজিত সংগ্রামী যোদ্ধাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে। প্রতিটি অনুষ্ঠানস্থল থেকে উচ্চারিত হোক ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রতিবাদ। যারা কৃষক-জনতার পক্ষে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে রাজপথে আন্দোলন করছেন তাদের প্রত্যেকে জানাই সংগ্রামী অভিবাদন। হাওর বাঁচাও কৃষক বাঁচাও আন্দোলন সফল হোক, সার্থক হোক।