নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। সেলা থেকে পায়ে হেঁটে বালাট আসছি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রায়ই ভোলাগঞ্জের কাছে সেলা হয়ে ১৮-২০ মাইল পথ সকালে রওয়ানা হয়ে সন্ধ্যার পর পায়ে হেঁটে প্রায়ই বালাট পৌঁছতাম। সেদিন একটু দেরিতে রওয়ানা হওয়ায় চিনাউড়ার কাছে পৌঁছার পর সন্ধ্যা হয়ে যায়। আশ্রয়ের জন্য গ্রামের এক বাড়িতে গিয়ে ডাক দিলে বাড়ির মালিক ঘর হতে বেরিয়ে এসে আমাকে চিনতে পেরে বলেন যে, তোমার মামাতো ভাইয়েরা তাদের বাড়ি বিরামপুর ছেড়ে পাশের রংপুর গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বললে তিনি আমাকে যথাস্থানে নিয়ে যান। একটি টিলার চারদিকে ঘেরা জায়গায় জীর্ণ কয়েকটি ছাপ্টাঘরের একটির সামনে গিয়ে আমার মামাতো ভাই মন্নান ভাইয়ের নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করলে আমার বড় মামী ও পেছনে মন্নান ভাই, আনোয়ার মিয়া ও মইনউদ্দীন বেরিয়ে এসে আমাকে দেখে অবাক হয়ে যান। ঘরে ঢুকে দেখি করুণ অবস্থা। মাটিতে চাটাই বিছিয়ে তার উপর কাঁথা দিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মামীসহ মামাতো ভাইদের কাপড়-চোপড় জীর্ণ অবস্থা। চোখে-মুখে অজানা আশঙ্কার ছাপ। তারা বছরে হাজার মণ ধান বিক্রি করে থাকেন অথচ এখন তাদের না খেয়ে থাকার অবস্থা। বিরামপুর-বালিকান্দি এলাকায় পাকসেনা ও রাজাকাররা অবস্থান গ্রহণ করার পর এমন অত্যাচার শুরু করে বিশেষ করে মা-বোনদের। সম্পূর্ণ এক কাপড়ে মামী মামাতো ভাইদের নিয়ে পাহাড়ের টিলায় আশ্রয় নেন। স্নেহময়ী এই মামীকে গ্রামের কোনো লোক দেখেননি অথচ শত শত মানুষের সামনে এই মামীকে চলাফেরা করতে হচ্ছে। এক কাপড়ে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে সবকিছু ফেলে সীমান্তের নিকটবর্তী এই এলাকায় আশ্রয়গ্রহণ করেন। স্নেহময়ী মামী রাতেই গ্রাম থেকে মোরগ আনিয়ে পরম যতেœর সহিত খেতে দেন। তাদের সাথে আলাপে জানতে পারলাম যে, আমার আরেক মামাতো ভাই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে গিয়েছে। প্রায় দুই মাস হল তার কোনো খবর নেই। অধিক রাত পর্যন্ত তাদের সাথে গল্প করে ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে নাস্তা করে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বালাটের দিকে রওয়ানা করি। বালাট যাওয়ার পথে রংপুর গ্রামের শেষ মাথায় গ্রাম সম্পর্কীয় এক মামার সাথে দেখা, তিনি কয়েকটি গরু নিয়ে ঘাস খাওয়াতে যাচ্ছিলেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, ঐ যে গরু দুটি দেখছ এগুলো তোমার মায়ের। গরুগুলো দেখেই আমি বললাম এখান থেকে একটি গরু যদি বিক্রি করে আমাকে কিছু টাকা দেন তাহলে আমার ভীষণ উপকার হয়। উনাকে আমার বালাটের ঠিকানা দিয়ে আবার বালাটের পথ ধরি। তিন-চার দিন পর হঠাৎ দেখি আমার সেই মামা দুইশত ত্রিশ টাকায় একটি গরু বিক্রি করে টাকা নিয়ে এসেছেন। আমি টাকাগুলো নিয়ে ত্রিশ টাকা উনাকে দিতে চাইলে উনি নিতে রাজী হননি বরং বললেন তোমার বিপদের সময় আমার টাকা নেওয়া উচিত হবেনা। মুক্তিবাহিনীতে যখন যোগ দেই তখন আমার পরনের কাপড় ছাড়া বাড়তি কোনো কাপড় ছিলনা। বহু কষ্ট সহ্য করে দিন কাটাই। ট্রেনিং সেন্টারে যাওয়ার পর ভারত সরকার দুটি শার্ট, দুটি লুঙ্গি ও দুটি গেঞ্জি দেন। এগুলো দিয়ে কোনো মতে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করি। যখন গরু বিক্রি করি তখন মাত্র একখানা লুঙ্গি ও একটি শার্ট ছিল। অনেক কষ্টে এই শীতের দিনে আমরা চলছিলাম। টাকা পেয়ে একজোড়া প্লাস্টিকের সু-জুতা ও ষাট টাকা খরচ করে একটি প্যান্ট ও দুটি শার্ট খরিদ করি। ঐসময় যদি গরু বিক্রির টাকা না পেতাম তাহলে কাপড়ের অভাবে ভীষণ কষ্ট পেতে হত। এত কষ্ট, কত অপ্রিয় ক্ষত, কত ছবি, কত করুণ গান, কত বেদনার সুর আর স্মৃতিমাখা দিনগুলোর কথা যখন মনে হয় তখন স্বাধীনতার স্বপ্ন যাতে বাস্তবায়িত হয় এই কামনায় হয়ে যাই মাঝে মাঝে আনমনা।