‘প্রবৃদ্ধি’ শব্দটি সাধারণত অর্থনীতির ক্ষেত্রেই বেশি ব্যবহার হয়। সাধারণত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বলতে নির্দিষ্ট একটি দেশের অর্থনীতিতে পণ্য ও সেবার উৎপাদন বৃদ্ধি বোঝায়। অর্থাৎ দেশজ মোট উৎপাদনের বর্ধিত অংশের শতকরা মানকে বোঝায়। সে যা-ই হোক, প্রবৃদ্ধি ভালো হলে আমরা যে সমৃদ্ধ হই তা বোঝা কষ্টকর নয়। সুতরাং সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি অর্জনকেই সাংস্কৃতিক প্রবৃদ্ধি ধরে নিয়ে আমাদের বর্তমান আলোচনার অবকাশ। সংস্কৃতিচর্চায় সমৃদ্ধির আকাক্সক্ষা থেকেই মূলত আমাদের এ প্রয়াস। সুস্থ চর্চার মাধ্যমে সংস্কৃতির সুরক্ষা দান এবং বিকাশ সাধনের মধ্য দিয়ে সাধারণের মধ্যে নবজাগরণ সৃষ্টিতে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়কেই স্মার্ট ভূমিকা রাখতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সংস্কৃতি বিষয়ক ‘পেশাগত ক্যাডার’ পদ সৃষ্টি ও দেশের সব শিল্পকলা একাডেমিতে ওই পদে দক্ষ জনবল পদায়নের মাধ্যমে মন্ত্রণালয় নিজেও স্মার্ট হয়ে উঠতে পারে।
ঐতিহাসিকভাবে এমন মতামত সুপ্রতিষ্ঠিত যে, দেশে সংস্কৃতিচর্চার ধারা অব্যাহত রাখতে চাইলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকেই এগিয়ে আসতে হয়। কিন্তু সমসাময়িক নানা বাস্তবতায় মধ্যবিত্তের রূপান্তর ঘটায় দেশে সংস্কৃতিচর্চা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার মতোই এ দেশে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতিচর্চারও একই অবস্থা। অর্থাৎ কোথাও সংস্কৃতি তার আপন ঐতিহ্যিক পথে বাধাহীনভাবে বিকশিত হতে পারছে না। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালি মধ্যবিত্তেরই অবিসংবাদিত নেতা। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ এবং অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে শিল্প-সংস্কৃতিচর্চার গুরুত্ব উপলব্ধি করেই ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বর্তমান সরকার টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কল্যাণে দেশে প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বাজেটের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে গুণিতক হারে। প্রতি বছর ‘থোক বরাদ্দ’ বৃদ্ধি ছাড়া প্রকৃত প্রণোদনা সৃষ্টিকারী বাজেট সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে দেখাই যায়নি! ফলে সংস্কৃতিকর্মী থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যও কম।
প্রায় এক যুগ আগে শোনা গিয়েছিল প্রতিটি উপজেলায় ‘শিল্পকলা কমপ্লেক্স’ গঠনের পরিকল্পনার কথা। সে পরিকল্পনার ভাগ্যে কী ঘটেছে জানি না। তখন এমনও শোনা গিয়েছিল, উপজেলা পর্যায়ের শিল্পকলা একাডেমি পর্যন্ত সংস্কৃতি কর্মকর্তা বা ‘কালচারাল অফিসার’ পদ সৃষ্টি এবং লোকবল নিয়োগের মাধ্যমে দেশব্যাপী শিল্পকলা একাডেমিগুলোয় প্রাণ সঞ্চার করা হবে। বর্ণিত ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে সত্যি সত্যি দেশব্যাপী সংস্কৃতিচর্চা ও অনুশীলনে প্রাণের সঞ্চার ঘটত, সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি ঘটত।
ইতোপূর্বেও ব্যক্ত হয়েছে যে, অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের তুলনায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বাজেট কম। যার সরলীকৃত অর্থ এমন করা যেতেই পারে যে, সংস্কৃতিচর্চায় আমাদের গুরুত্বও কম। প্রসঙ্গত খ্যাতিমান নাট্যকার সেলিম আল দীন এক ধরনের হতাশাবোধ থেকেই ২০০২ সালে একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, “আমাদের রাষ্ট্রনীতি-অর্থনীতি কেবল গায়ে-গতরে প্রবৃদ্ধি খোঁজে। সর্বমানুষের আত্মিক জাগরণের পথটি স¤পর্কে তাদের ন্যূনতম বিচার বিবেচনা নেই। এ দেশের রাষ্ট্রশক্তির কাছে লেখকরা উদ্বাস্তু, একঘরে, অমাত্যবর্গের দাক্ষিণ্যভিখারী।’ সেলিম আল দীন ওপরের বক্তব্যে শুধু লেখকদের প্রসঙ্গই উত্থাপন করেননি, প্রকৃতপক্ষে তিনি দেশের আপামর সংস্কৃতিকর্মীদের প্রতিও ইঙ্গিত করেছিলেন। ইঙ্গিত করেছিলেন দেশের সমকালীন সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে সরকারের মনোভাবের প্রতিও।
যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ায় আমরা বর্তমানে তৎপর রয়েছি তা কখনই পূর্ণতা লাভ করবে না যদি আমরা সব উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের সাংস্কৃতিক উন্নয়নকেও ত্বরান্বিত না করি। বাঙালির হাজার বছরের শাশ্বত সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশে আওয়ামী লীগের কাছেই আমাদের বেশি প্রত্যাশা। আমাদের প্রত্যাশা, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের শিল্পকলা একাডেমিগুলোয় সংস্কৃতি বিষয়ক শিক্ষায় শিক্ষিতদের বিসিএস ক্যাডার অফিসার হিসেবে নিয়োগদানের মাধ্যমে সেখানে সংস্কৃতিচর্চায় প্রাণচঞ্চল্য প্রতিষ্ঠা করা হোক। অনেকে এমনও ভাবতে পারেন, গান-বাজনা, সংগীত-নৃত্য কিংবা নাট্যচর্চার মাধ্যমে কেবল বিনোদন দানই সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে একজন মানুষ জাতির ইতিহাস-ভূগোল, সংস্কার-সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যিক স্মারকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে মুক্ত মন নিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এর সুফল সমাজকে দীর্ঘ স্থায়ীভাবে প্রভাবিতও করতে পারে। সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে একদিকে যেমন অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা সৃষ্টি সম্ভব, অন্যদিকে তেমনি মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার প্রণোদনা দানও সম্ভব। বর্তমান বাস্তবতায় এবং ভবিষ্যৎমুখী সামাজিক প্রবণতা লক্ষ করলে অসাম্প্রদায়িক এবং মানবিক মানুষের যে কত প্রয়োজন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং স্মার্ট সরকারকেই তরুণ প্রজন্মকে রুচিশীল সংস্কৃতি শিক্ষায় গড়ে তোলার অঙ্গীকার করতে হবে। না হলে আমাদের বিশাল বাজেটে নির্মিত বড় বড় অবকাঠামোগত সব উন্নয়নই অর্থহীন হয়ে পড়বে! আমাদের যাবতীয় নির্মাণ, আমাদের সব উন্নয়ন ও সৃষ্টিকর্ম যুগের পর যুগ নতুন নতুন প্রজন্মের হাত ধরে সার্থকরূপে টিকে থাকুক এটাই প্রত্যাশা।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ সামগ্রিক উন্নয়ন সফল ও টেকসই করার লক্ষ্যে দীর্ঘদিনের প্রচলিত বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের অন্তর্গত পদগুলোয়ও বৈচিত্র্য সৃষ্টির প্রয়োজন। বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে স্থল ও জলসীমান্তের সব বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে বৈচিত্র্যপূর্ণ স্থলজ ও জলজ সম্পদের স্বত্বাধিকারী হওয়া সম্ভব হয়েছে। মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণের মাধ্যমে তা থেকেও সুবিধাভোগ সম্ভব হয়েছে। এছাড়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বহুমাত্রিক উন্নয়ন যখন বিশ্ববাসীর সম্মুখে দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রাহ্য তখন তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন সম্ভাবনাময় দিগন্তের পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতির লালন-পালন ও প্রসারের লক্ষ্যে প্রয়োজন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘পেশাগত’ বা ‘কারিগরি’ শ্রেণীতে সংস্কৃতি ক্যাডার সার্ভিস প্রবর্তন। বাঙালির অগ্রযাত্রা ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতির বিকাশে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে স্মার্টনেস বা চৌকসত্ব অর্জন করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংস্কৃতি বিষয়ে ¯œাতকদের সমন্বয়ে কর্মী বাহিনী গঠনের বিকল্প নেই। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে আমাদের দীর্ঘদিনের এ দাবি যে, সংস্কৃতির সুরক্ষা ও বিকাশের জন্যই বিসিএস অর্থনীতি, আনসার, ডাক, পরিকল্পনা, পররাষ্ট্র, পুলিশ, সমবায়, তথ্য ইত্যাদি ক্যাডারের মতো সংস্কৃতি বিষয়েও স্বতন্ত্র ক্যাডার পদ প্রবর্তন করা হোক। আমরা মনে করি এটা এখন সময়েরই দাবি, সময়েরই প্রয়োজন।
বাঙালি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধকরণসহ দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে সুরক্ষা দান ও বিকশিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সব পর্যায়ের শাখাকে সক্রিয় করা প্রয়োজন। বাঙালিসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি সুরক্ষা ও বিকাশের দাবি উত্থাপনের প্রথমেই শিল্পকলা একাডেমিগুলোকে যোগ্য ও মেধাবী কর্মীদের মাধ্যমে সক্রিয় করে তোলা জরুরি। বাংলাদেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক, সংগীত, নৃত্য, চারুকলা, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে। শিল্পকলার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত এসব শাখা থেকে প্রতি বছর মেধাবী শিক্ষার্থী বের হয়ে আসছেন। জনপ্রশাসনের অধীনে ‘সংস্কৃতি বিষয়ক ক্যাডার’ পদ প্রবর্তনের মাধ্যমে ওই শিক্ষা-শৃঙ্খলা থেকে ¯œাতক ও ¯œাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার বিবেচনায় নিয়োগ সম্ভব হলে তাদের অধীত জ্ঞান ও দক্ষতার মাধ্যমে দেশীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধি ঘটানো কষ্টসাধ্য কিছু নয়।
সংস্কৃতিচর্চাই তরুণ সমাজকে উগ্রতা ও মাদকাসক্তি থেকে সুরক্ষা দেবে। স্ব-দেশ ও স্ব-ভূমির সংস্কার-সংস্কৃতির প্রতি যখন আবেগ জাগ্রত হয় তখন তার মধ্যে গভীর দেশপ্রেমেরও সঞ্চার ঘটে। আমরা মনে করি, দেশব্যাপী সাংস্কৃতিক আবহ তৈরি হলে দুর্দমনীয় কিশোর গ্যাং, ভয়ংকর মাদকাসক্তি ও জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসী কর্মকা-সহ সামাজিক নানা উপদ্রব বন্ধ হয়ে যাবে।
আমরা চাই ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী’ আদর্শের সংস্কৃতিচর্চার পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নিজ নিজ সংস্কৃতিচর্চারও স্বাধীনতা। আর এ কাজে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি’ অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
জনপ্রশাসনে ক্যাডার সার্ভিসের আওতায় ‘সংস্কৃতি বিষয়ক ক্যাডার’ ও তৎসংশ্লিষ্ট পদ সৃষ্টি এবং পদায়ন নিশ্চিত হলে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ দেশব্যাপী শিল্পকলা একাডেমিগুলোয় প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হবে। ‘এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের’ গতিকে আরো বেগবান করার লক্ষ্যে সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, প্রতিযোগিতামূলক বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও চাকরি গ্রহণের মাধ্যমে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা, সংগীত, নৃত্যকলা, চারুকলা এবং টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র বিষয়ে ¯œাতকরা পেশাগত জীবনে নিজেদের একাডেমিক শৃঙ্খলায় অধীত বিষয়ের প্রয়োগ যেমন করতে পারবেন তেমনি পারবেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়েও প্রকৃত প্রাণশক্তি প্রতিষ্ঠা করতে। এটি সম্ভব হলে বাঙালি সংস্কৃতিচর্চাসহ দেশের বিভিন্ন জাতিসত্তার সংস্কৃতিচর্চাও তুলনাহীন অগ্রগতির লক্ষ্যে ধাবিত হবে। তথাকথিত কিশোর গ্যাং, জঙ্গিবাদ ও মাদকের প্রতি নেশাগ্রস্ত বিকলাঙ্গ প্রজন্মের বদলে বাংলাদেশে সৃষ্টি হবে সংস্কৃতিসচেতন ও দেশপ্রেমিক প্রজন্ম, যারা প্রত্যেকেই হবেন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার অদম্য কারিগর।
[আহমেদ আমিনুল ইসলাম: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]