প্রফেসর দিলীপ কুমার মজুমদার ::
মহাত্মা গান্ধীর একটি বক্তব্য দিয়েই লেখাটি শুরু কলাম। গান্ধী বিশ্বাস করতেন যে, ভোগের প্রলোভন মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনার অবক্ষয় ঘটায়, তাইতো ভো-সুখ মানুষের সকল সুকুমার বৃত্তিকে গ্রাস করতে চলেছে। বিশ্বব্যাপী বিরাজ করছে অস্থিরতা। দুর্গোৎসবের বর্ণাঢ্য আয়োজনের মাধ্যমে জাতি ধর্ম বর্ণের বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে এক সঙ্গে ধ্বনিত হোক সাম্য ও মৈত্রির গান। পূজায় এ হোক আমাদের প্রার্থনা।
সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে সাম্যের বাণীÑ ‘গাহী সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’ চৌদ্দ শতকে আমাদের সাধক কবি চন্ডীদাস যখন বললেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ এ কথার মর্ম কী? মানুষই তো শ্রেষ্ঠ সে যেমনই হোক। মানুষ অমৃতের সন্তান, সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ এ কথা সবারই জানা। তবে কেন আবার নতুন করে কথা বলা! ঠাকুর রামকৃষ্ণ আরও এক ধাপ অগ্রগামী হয়ে বললেন, ‘শিবজ্ঞানে জীব সেবো’ মানুষতো ছাড়।
বিশ্বের আর্থ মানবতার সেবায় জীবন উৎসর্গকারী এক মহীয়সী নারী মাদার তেরেসা বলেছিলেনÑ ধর্ম শুধুমাত্র আধ্যাত্ম্য সাধনার সোপান হবে না, তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের ভালোমন্দকে মিশিয়ে দিতে হবে, তবেই আমরা সত্যিকারের ধার্মিক হয়ে উঠতে পারব।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ভ্রাতুস্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন ‘আমার বোধ হয় সকল ধর্মের শ্রেষ্ঠ সর্বজীবে দয়া। প্রেম হচ্ছে সমস্ত ধর্মের মূল ভিত্তি। জগতে আমা হতে যেন দুঃখের সৃজন না হয়ে সুখের বিস্তার হতে থাকে। আমি যেন সকল প্রাণির সুখ, দুঃখ, বেদনা বুঝে নিজের স্বার্থের জন্য কাউকে আঘাত না করি এই মমার্থ ধর্ম।’
দেবী দুর্গা প্রতি বৎসর ধরাধামে আশীর্বাদের বার্তা নিয়ে আসেন। মহাশক্তি দুর্গা হলেন বাঙালির আদরিণী কন্যা তিনি পুত্রকন্যা লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশকে সঙ্গে নিয়ে পতিগৃহ কৈলাস থেকে আসেন কিছুদিনের জন্য পিতৃগৃহ বঙ্গভূমিতে প্রতি শরতে। বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ষোড়শ শতকে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ, তাহিরপুর (রাজশাহী) রাজা কংস নারায়ণ সর্বপ্রথম আধুনিক রীতিতে জাঁকজমকপূর্ণ দুর্গোৎসব পালন করেছিলেন। দুর্গাপূজা পারিবারিক থেকে বারোয়ারি, তারপর সর্বজনীন। আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও উদ্যাপিত হচ্ছে পূজা। আমাদের বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এবং পৃথিবীর অনেক দেশের সেই শহরগুলোতে যেখানে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস করেছে। সবাই বছরের এই সময়টা নানাভাবে উদ্যাপন করে উৎসবের এই দিনগুলো। বর্ণিল মাত্রায় আনন্দ উৎসবের আন্তরিক ও বর্ণাঢ্য আনন্দে মেতে ওঠে তাঁরা। হিন্দু ধর্মে অনেক দেবীর পূর্জা প্রচলন রয়েছে। দেবীগণকে আমরা মা বলে সম্বোধন করি। ভারতীয় উপমহাদেশে জননী সর্বদা পূজিতা। সে জন্যই জীবের হৃদয়ে মাতৃভাবই সর্বাগ্রে প্রস্ফূটিত হয়। হিন্দুরা বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসনা করলেও তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, সকল দেবতাই এক অদ্বিতীয় মহাশক্তির বিভিন্ন প্রকাশ মাত্র।
পূজা উৎসবকে কেন্দ্র করে সকল ধর্মের লোকদের এক মহামিলন ঘটে। এটা বাংলাদেশের বহুদিনের ঐতিহ্য। পূজা উৎসবটি শুধু একটি মাত্র সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি তখন বাংলা সর্বজনীন উৎসবে রূপ নেয়। শ্রীশ্রী দুর্গা দেবী বোধন, ষষ্ঠ্যাদি কম্পারম্ভ, মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী, মহানবমী বিহিত পূজা এবং দশমী বিহিত পূজা সমাপান্তে বিসর্জনের মাধ্যমে শেষ হয় পাঁচ দিনের বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ পূজা উৎসব। শুরু হয় বিজয়ার শুভেচ্ছা। এ উৎসবের মাধ্যমে সুযোগ হয়ে উঠে পরস্পরের সান্নিধ্যে আসার, ভাববিনিময়ের, শোক দুঃখের কথা বলার। সবাই যেন মিলেমিশে এক হয়ে যাই। তাইতো রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেনÑ ‘দেশের ছেলে বুড়ো সকলেই হঠাৎ দিন কতকের মতো ছেলেমানুষ হয়ে ওঠে।’ দেবী মাটিতে আসেন সর্বজনীন উৎসবের বার্তা নিয়ে। শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য আসেন। দেবী দুর্গার আগমনে সবার জীবন শান্তিময় হোক। সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা।