1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ১১:৪৫ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

দুর্গাপূজার ইতিবৃত্ত

  • আপডেট সময় সোমবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৬

ড. অসীম সরকার ::
দুর্গা পৌরাণিক দেবতা। তিনি আদ্যাশক্তি, মহামায়া, শিবানী, ভবানী, দশভুজা, চন্ডী, নারায়ণী প্রভৃতি নামে ও বিশেষণে অভিহিত। পুরাণে কথিত আছে, আদ্যাশক্তি মহামায়া দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের লক্ষ্যে এবং সমগ্র জীবের কল্যাণার্থে যুগে যুগে ও কালে কালে বিভিন্নরূপে ভিন্ন ভিন্ন নামে আবির্ভূত হয়েছেন। দেবী দুর্গা তাঁরই বিশেষ সময়ের, বিশেষ যুগের এক বিশেষ রূপ। ‘শব্দক¤পদ্রুম’ গ্রন্থ অনুসারে দুর্গ (বা দুর্গম) নামক অসুরকে যিনি বধ করেন তিনিই দুর্গা। দেবী দুর্গম অসুরকে বধ করে জীবের দুর্গতি নাশ করেন বলেও তাঁকে দুর্গা (দুর্গতিনাশিনী) বলা হয়।
‘শ্রীশ্রীচন্ডী’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, প্রাচীনকালে ব্রহ্মার বরে পুরুষের দ্বারা অবধ্য মহিষাসুর দেবগণকে যুদ্ধে পরাস্ত করে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নিয়ে স্বর্গ থেকে দেবতাদের বিতাড়িত করে দেয়। স্বর্গ থেকে বিতাড়িত দেবগণ মহিষাসুরকে হত্যা করে স্বর্গরাজ্য উদ্ধার করার জন্য প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং পরে তাঁকে মুখপাত্র করে বিষ্ণু (নারায়ণ) এবং শিবের সমীপে উপস্থিত হন। মহিষাসুরের কাহিনী শুনে তাঁরা উভয়েই অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হন। সেই ক্রোধে তাঁদের মুখমন্ডল ভীষণাকার ধারণ করে। প্রথমে বিষ্ণুর, পরে শিব ও ব্রহ্মার মুখমন্ডল থেকে এক মহাতেজ নির্গত হয়। দেবরাজ ইন্দ্রসহ অন্যান্য দেবতার দেহ থেকেও সুবিপুল তেজ নির্গত হয়ে মহাতেজের সঙ্গে মিলিত হয়। সেই বিরাট পর্বতপ্রমাণ ও উজ্জ্বল তেজঃপুঞ্জ একত্রিত ও ঘনীভূত হয়ে অগ্নিবর্ণা, মহাতেজস্বিনী, পরমরূপবতী এক দেবীমূর্তি ধারণ করে। দেবগণের সম্মিলিত শক্তির সংহত বা মিলিত রূপ থেকে আবির্ভূত মহাশক্তির অধিষ্ঠাত্রী এই দেবী হলেন দুর্গা। সমুদ্র ও বিশ্বকর্মা দেবীকে বহু রকম অলংকার দান করেন। দেবগণও বিভিন্ন প্রকার অলংকার দিয়ে দেবীকে সজ্জিত করেন। তারপর দেবগণ প্রত্যেকে তাঁদের নিজ নিজ অস্ত্র দেবীকে দান করেন। হিমালয় দেবীকে বাহন হিসেবে সিংহকে দান করেন। দেবতাদের শক্তিতে শক্তিময়ী এবং বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেন (মহিষাসুরকে বধ করেন বলে দুর্গা দেবীর এক নাম মহিষাসুরমর্দিনী)। দেবী দুর্গা কর্তৃক দুরাত্মা মহিষাসুর নিধন বর্তমানে প্রচলিত দুর্গাপূজার দৃশ্যপট। কালীবিলাসতন্ত্র, কালিকাপুরাণ, দেবীভাগবত, মহাভাগবত, বৃহন্নন্দিকেশ্বরপুরাণ, দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী, দুর্গোৎসববিবেক, দুর্গোৎসবতত্ত্ব প্রভৃতি গ্রন্থে দেবী দুর্গা স¤পর্কে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
দুর্গাপূজার প্রচলন স¤পর্কে যতগুলো পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে, তার মধ্যে সবচেয় জনপ্রিয় কাহিনী শ্রীশ্রীচন্ডী বা দেবীমাহাত্ম্যমে পাওয়া যায়। চন্ডীতে বর্ণিত হয়েছে, সত্যযুগে রাজা সুরথ দ্বিতীয় মনু স্বরোচিষের পুত্র চৈত্র বংশীয় রাজা ছিলেন। সুশাসক ও যোদ্ধা হিসেবে তাঁর প্রভূত খ্যাতি ছিল। কিন্তু একবার এক জবন জাতির সঙ্গে যুদ্ধে তাঁর পরাজয় ঘটে। তখন তাঁর মন্ত্রী ও সভাসদরা তাঁর রাজ্য দখল করে নেন। রাজা সুরথ মনের দুঃখে বনে চলে যান। বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে তিনি মেধস মুনির আশ্রমে এসে উপস্থিত হন। মেধস মুনি রাজাকে সমাদর করে নিজের আশ্রমে আশ্রয় দেন। অন্যদিকে স্বজনপ্রতারিত সমাধি বৈশ্য নামক এক বণিকও মেধস মুনির আশ্রমে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
পরিচয়সূত্রে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য তাঁদের দুর্ভাগ্যের কথা পর¯পরকে বর্ণনা করেন এবং তাঁদের দুর্ভাগ্য থেকে পরিত্রাণের জন্য মেধস মুনির কাছে পরামর্শ প্রার্থনা করেন। মেধস মুনি পরমেশ্বরী মহামায়ার শরণাগত হও মর্মে উপদেশ দেন। মুনির পরামর্শে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য নদীতীরে মৃন্ময়ী (মাটির) প্রতিমা নির্মাণ করে পু®প, ধূপ, দীপ (বা হোম) ও নৈবেদ্যাদি দিয়ে কখনো নিরাহার হয়ে, কখনো বা অনাহারী ও সমাহিত হয়ে তিন বছর সংযত চিত্তে দেবীর পূজা করেন। আরাধনায় দেবী তুষ্ট হয়ে সুরথ রাজাকে হারানো রাজ্য ফিরিয়ে দেন এবং সমাধি বৈশ্যকে তত্ত্বজ্ঞান দান করেন। এই পূজা বসন্তকালে হয়েছিল বলে এর নাম বাসন্তী পূজা।
কবি কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণে উল্লিখিত হয়েছে যে ত্রেতা যুগে শ্রীরামচন্দ্র রাবণকে বধ করার জন্য দেবী দুর্গার পূজা করেন (তবে বাল্মীকির রামায়ণে রাম কর্তৃক দুর্গাপূজার কোনো বিবরণ নেই)।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ অনুসারে রাবণ ছিলেন শিবভক্ত। শিব তাঁকে রক্ষা করতেন। রাবণ দেবী দুর্গারও আরাধনা করতেন। তাই ব্রহ্মা রামকে দুর্গা দেবীর পূজা করার পরামর্শ দেন। ব্রহ্মার পরামর্শে রাম শরৎকালে (নিরাকার) দেবী দুর্গার পূজা করেন (‘কালিকাপুরাণ’ ও ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ অনুসারে রামকে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মা দুর্গার বোধন ও পূজা করেন। কিন্তু কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর রামায়ণে উল্লেখ করেন, রাম স্বয়ং দুর্গার বোধন ও পূজা করেন)। রাম শরৎকালে দুর্গার পূজা করেন। পূজায় তুষ্ট হয়ে দেবী দুর্গা রামকে কাক্সিক্ষত বর দেন এবং রাবণকে ত্যাগ করেন। দুর্গার বরে যুদ্ধে রাম রাবণকে বধ করতে সমর্থ হন।
দুর্গাপূজা বসন্তকালের উৎসব হলেও নির্দিষ্ট সময়ের আগে অকালে অর্থাৎ বসন্তকালের পরিবর্তে শরৎকালে শ্রীরামচন্দ্র দুর্গাপূজার আয়োজন করেন বলে শারদীয় দুর্গোৎসবকে অকালবোধন বা অকালপূজা বলা হয় (তবে কোনো কোনো মতে, শরৎকালেই দুর্গাপূজার উৎপত্তি। বসন্তকালে দেবীপূজায় বোধনের কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ তখন দেবী জাগ্রত থাকেন)। শ্রাবণ থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত এই ছয় মাসকে বলা হয় দক্ষিণায়ন এবং মাঘ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত এই ছয় মাসকে বলা হয় উত্তরায়ণ।
অতএব, শরৎকাল হলো দেবতাদের দক্ষিণায়ন বা রাত্রিকাল। সময়টি দেবতাদের পূজার যথাযথ সময় নয়। অকালের পূজা বলে এই পূজার নাম অকালবোধন। রাম কর্তৃক অনুষ্ঠিত শারদীয় দুর্গাপূজা থেকে দুর্গাপূজার নতুন মাত্রাযুক্ত পথচলা শুরু হয়।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কৃষ্ণকে দুর্গাপূজার প্রবর্তক বলা হয়েছে। বিভিন্ন দেব-দেবী কিভাবে দুর্গাপূজা করেছিলেন, তার একটি বিবরণ এই পুরাণে পাওয়া যায়। বলা হয়েছে, সৃষ্টির প্রথম যুগে পরমাত্মা কৃষ্ণ বৈকুণ্ঠের আদি বৃন্দাবনের মহারাসমন্ডলে প্রথম দুর্গাপূজা করেন। এরপর মধু ও কৈটভ নামে দুই অসুরের ভয়ে ব্রহ্মা দ্বিতীয় দুর্গাপূজা করেন। ত্রিপুর নামে এক অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে শিব বিপদে পড়ে তৃতীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। দুর্বাসা মুনির অভিশাপে লক্ষ্মীকে হারিয়ে ইন্দ্র যে পূজার আয়োজন করেন, সেটি ছিল চতুর্থ দুর্গাপূজা। এর পর থেকেই পৃথিবীতে মুনি-ঋষি, সিদ্ধপুরুষ, দেবতা ও মানুষ নানা দেশে নানা সময়ে দুর্গাপূজা করে আসছেন।
শাক্তধর্মের অন্যতম প্রধান ধর্মগ্রন্থ দেবীভাগবত পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু পৃথিবীর শাসক হয়ে ক্ষীরোদসাগরের তীরে দুর্গার মাটির মূর্তি তৈরি করে পূজা করেন। এ সময় তিনি ‘বাগভব’ বীজ জপ করতেন এবং আহার ও শ্বাস গ্রহণ ত্যাগ করে এক পায়ে দাঁড়িয়ে ১০০ বছর ধরে ঘোর তপস্যা করেন। এর ফলে তিনি শীর্ণ হয়ে পড়লেও কাম ও ক্রোধ জয় করতে সক্ষম হন এবং দুর্গানাম চিন্তা করতে করতে সমাধির প্রভাবে স্থাবরে পরিণত হন। তখন দেবী দুর্গা প্রীত হয়ে তাঁকে পুত্রলাভের বর দেন এবং তাঁর রাজ্য শাসনের পথ নিষ্কণ্টক করেন।
দ্বাপর যুগে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্মপর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনসহ পান্ডবদের যুদ্ধজয়ের লক্ষ্যে দুর্গাপূজার আয়োজন করতে বলেন। এভাবে যুগে যুগে অসুরবিনাশিনী দেবী দুর্গা যুগের প্রয়োজনে বিভিন্ন নামে পূজিত হয়েছেন। ভাগবতে যোগমায়া দেবী দুর্গার আবির্ভাব ও তাঁর পূজার কথা বলেছেন স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু।
বলা হয়ে থাকে, বঙ্গদেশে প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন করেন স¤্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) রাজত্বকালে রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ, মতান্তরে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮২)। কিন্তু জীমূতবাহনের (আনু. ১০৫০-১১৫০) ‘দুর্গোৎসবনির্ণয়’, বিদ্যাপতির (১৩৭৪-১৪৬০) ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী’ শূলপাণির (১৩৭৫-১৪৬০) ‘দুর্গোৎসববিবেক’, কৃত্তিবাস ওঝার (আনু. ১৩৮১-১৪৬১) ‘রামায়ণ’, বাচ¯পতি মিশ্রের (১৪২৫-১৪৮০) ‘ক্রিয়াচিন্তামণি’, রঘুনন্দনের (১৫শ-১৬শ শতক) ‘তিথিতত্ত্ব’ ইত্যাদি গ্রন্থে দুর্গাপূজার বিস্তৃত বর্ণনা থাকায় অনুমান করা হয়, বাংলায় দুর্গাপূজা দশম অথবা একাদশ শতকেই প্রচলিত ছিল। হয়তো কংসনারায়ণ কিংবা কৃষ্ণচন্দ্রের সময় থেকে তা জাঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। উনিশ শতকে কলকাতায় মহাসমারোহে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হতো। অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয়রাও দুর্গোৎসবে অংশগ্রহণ করত।
বাংলাদেশের সর্বত্রই দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। কেউ ব্যক্তিগতভাবে করে, কেউ বা সমষ্টিগতভাবে পূজা করে। সমষ্টিগত পূজাকে বলা হয় বারোয়ারি বা সর্বজনীন দুর্গোৎসব।
দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। তবে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের অবাঙালিরাও ভিন্ন ভিন্ন নামে এই উৎসব পালন করে। যেমন-কাশ্মীর ও দাক্ষিণাত্যে অম্বা ও অম্বিকা, গুজরাটে হিক্সগুলা ও রুদ্রাণী, কান্যকুব্জে কল্যাণী, মিথিলায় উমা এবং কুমারিকা প্রদেশে কন্যাকুমারী নামে দেবীর পূজা ও উৎসব পালিত হয়।
[লেখক : প্রাধ্যক্ষ, জগন্নাথ হল; সাবেক চেয়ারম্যান, সংস্কৃত বিভাগ; সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com