কালচক্রের চাকা ঘুরে প্রতি বছরের মতো আবার ফিরে এলো গত শতকের বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনের স্মারক একুশে ফেব্রুয়ারি। ইতোমধ্যে এই দিবসটি বাঙালির তথা বাংলাদেশের জাতীয় উৎসবে পর্যবসিত হয়েছে, এমন কি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্ব পরিসরে প্রতিপন্ন হয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারির মর্যাদা অপরিসীম। কিন্তু জাতিগত যে-আকাক্সক্ষার সাপেক্ষে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল এবং যে-প্রত্যাশা অর্জনের অভিপ্রায়ে ভাষা আন্দোলন স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে পর্যবসিত হয়েছিল সে-প্রত্যাশা স্বাধীনতা অর্জনের পরও এখনও অপূর্ণই থেকে গেছে, যদিও দেশ অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। কিন্তু বিশেষ করে দেশকে উন্নতির পথে অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অক্লান্ত সাধনায় অর্জিত অসংখ্য সাফল্য সত্ত্বেও দেশের ভেতরে সাধারণ মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা পূরণ করে সুখে, শান্তিতে বেঁচে থাকার জন্যে সমাজসাংস্থিতিক পরিসর প্রস্তুত করা যায় নি, যে-কাক্সিক্ষত পরিসরে মানুষের মানবিক মেধার বিকাশ লাভ করতে পারে পুরো মাত্রায়। তবেই না হবে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন। অথচ এখন দেশে একেবারে সংক্ষেপে বর্ণনা করলে বলতে হয় অবাধে সম্পদ লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, দখলচ্যুতি, সন্ত্রাস, জালিয়াতি, প্রতারণা, নারীনির্যাতন, ধর্ষণ, শিক্ষাবঞ্চনা, ঘুষ-দুর্নীতি, আত্মসাৎ ইত্যাদি মিলে একধরণের কাঠামোগত সহিংসতা অপ্রতিহত গতিতে চলছে। এই আর্থসামাজিক ব্যবস্থাগত বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। সমাজসাংস্থিতিক এই বাস্তবতা একুশে ফেব্রুয়ারির আদর্শের পরিপন্থী, যা সমাজ পরিসরে একটি অচলায়তনের সৃষ্টি করেছে। এই অচলায়তন থেকে বেরিয়ে আসতে হলে জাতিকে অবশ্যই একুশে ফেব্রুয়ারির উৎসব মুখর সাংস্কৃতিক বাহ্যাড়ম্বর থেকে বেরিয়ে এসে একুশে ফেব্রুয়ারির আদর্শের পরিপন্থী অচলায়তন ভাঙার কাজে জাতিগতভাবে সক্রিয় হতে হবে, আদর্শিক হয়ে উঠতে হবে প্রতিটি সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনীতিক, আর্থনীতিক প্রতিষ্ঠানকে। জাতিগতভাবে এই ব্যাপারে কোনও আপোষ করা চলবে না।
অন্যথায় গণমাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না, পণ্যমূল্য বৃদ্ধির সিন্ডিকেট নির্মূল করা যাচ্ছে না, কিংবা ঠিকাদার সরকারি জমির মটি লুটে নিচ্ছে, শহীদ মিনারের নকশা বদলে দিচ্ছে, শিক্ষার্থীদের বই বিক্রি করে দিচ্ছেন শিক্ষক ইত্যাকার খতরনাক সংবাদ প্রকাশিত হতেই থাকবে এবং ধর্ষণের সংবাদ সাদামাটা খবরের মতো স্বাভাবিকই থেকে যাবে। তাই পরিশেষে বলতেই হয় যে, কেবল একুশে ফেব্রুয়ারির আদর্শিকতার বাস্তবায়নই জাতিগত উন্নতিকে নিশ্চিত করতে পারে।