1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৮:৫৪ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

কী আছে আমেরিকার গণতন্ত্র প্রেমে? : বিশ্বজিৎ দত্ত

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০২৪

পৃথিবীর অনেক দেশেই নির্বাচনই হয় না কিংবা মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা নেই। এর পরও দিব্যি সেসব দেশের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক অটুট, কোনো টানাপোড়েন নেই। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তাদের এতো মাথা ব্যাথা কেন? যার নিজের দেশে এখনও মানুষের মৃত্যুদ- নিয়ে এখনও গবেষণা হচ্ছে। মৃত্যুদ-ের পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্যে ২২ মিনিট ধরে একজন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের মাথাব্যথা গণতন্ত্র নিয়ে! মানবাধিকার নিয়ে! বিষয়টি অনেকের কাছেই হাস্যকর। তাই বেশিরভাগ মানুষই বলছেন, নিশ্চয়ই পেছনে কোন কারণ আছে।
এই লেখায় মূলত আমরা সেই কারণ খোঁজার চেষ্টা করবো। বিভিন্ন গণমাধ্যমের আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষণে করে বার বার উঠে এসেছে, পরাশক্তি চীনকে কোণঠাসা করতে ওয়াশিংটনের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি এবং বার্মা অ্যাক্টের বিষয়টি। এই দুই কৌশল মূলত ভারত এবং চীনকে চাপে ফেলে। আর দুই এজেন্ডা বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে আমেরিকার প্রয়োজনের বিষয়টিও বার বার প্রমাণিত। ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্রাটেজির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও আমেরিকার অবস্থান একই সমান্তরালে হলেও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ঢাকার কিছু নিজস্ব কৌশল রয়েছে। বাংলাদেশ সময় তার পররাষ্ট্রনীতির মূল সুর মেনে চলে “সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়” বিষয়টি আমেরিকার পছন্দ হয় না।
২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গাকে মানবিক কারণে আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ। তখন শেখ হাসিনার সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় গোটা দুনিয়া। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর ত্রাণ আসতে থাকে। মার্কিন কংগ্রেসম্যান ব্রাডলি শেরম্যান ২০১৯ সালের জুলাই মাসে স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক শুনানীতে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশকে বাংলাদেশের সঙ্গে একীভূত করার প্রস্তাব করেন। মুহূর্তেই এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বুঝে ফেলেন যে এই প্রস্তাবের মধ্যে আঞ্চলিক শান্তি বিঘিœত হওয়ার বার্তা রয়েছে।
শেখ হাসিনা ওই বছরের ৮ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, “অন্যের কোনো জমি নেওয়া, অন্য কোনো প্রদেশ আমাদের সঙ্গে যুক্ত করা আমি অপছন্দ করি। এ ধরনের কথা বলা অত্যন্ত গর্হিত এবং অন্যায় বলে আমি মনে করি। এই প্রস্তাব কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপদে নিজের দেশে ফিরে যেতে পারে সেই চেষ্টা করা। মানবিক কারণেই আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। আশ্রয় দেওয়ার মানে এই নয় যে, আমরা তাদের রাষ্ট্রের একটি অংশ নিয়ে চলে আসব।”
কূটকৌশলে ব্যর্থ হয়ে আমেরিকা রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থা নেয়। বাংলাদেশ চায় রোহিঙ্গারা নিরাপদে নিজের দেশে ফিরে যাক। কিন্তু মানবাধিকারের ধুয়ো তুলে, বার বার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আটকে দেয় আমেরিকা। তারা বলে রাখাইন এখনও রোহিঙ্গাদের জন্য অনিরাপদ। বাংলাদেশকে চাপে রাখতে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের বেসামরিক, নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল উজরা জেয়া জাতিসংঘের ৭৮তম অধিবেশনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সেই সাক্ষাতে রোহিঙ্গাদের উন্নত জীবিকা নিশ্চিত করতে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দেন। কিন্তু আসলেই বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের প্রতি আমেরিকার এই দরদ কী মৌলিক? ২০১৭ সালের পর আমেরিকা যত প্রতিরক্ষা, সামরিক বা কূটনৈতিক নথি প্রকাশ হয়েছে এর প্রত্যেকটিই বলে ‘না’।
নথি বলছে এই লোকদেখানো গণতন্ত্র বা মানবাধিকার প্রেমের মূল লক্ষ্য, চীন ঠেকানো কূটনীতি। আর এজন্য তাদের প্রথম পদক্ষেপ ভারত এবং প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে নিজেদের মিত্র দেশগুলোকে জড়ো করে চীনবিরোধী জোট গঠনের উদ্যোগ বা ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি। এই স্ট্রাটেজি বিস্তারের সবচেয়ে সহজ রাস্তা গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার ইস্যু। পাশাপাশি আরেকটি কৌশল হিসাবে আমেরিকা তার সিনেট পাশ করে ‘বার্মা অ্যাক্ট’।
আমেরিকার মূল লক্ষ্য চীন হলেও ভৌগোলিক কারণে ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে তাদের আমলে আনতে হয়েছে। ভারতবর্ষের বিভাজন, স্বাধীনতা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে মহাশক্তিধর হয়ে ওঠে। কিন্তু ভূরাজনীতি ও ভূকৌশল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার এক প্রান্তে আমেরিকা আর ভারত, অপর প্রান্তে চীন। এই দুই শক্তির মাঝখানে অবস্থান বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের। তাই এই দুই দেশ নিয়ে একধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয় পরাশক্তিধর দেশ তিনটির মধ্যে।
আমেরিকা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করে ২০১৯ সালে। এরপর ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি বা আইপিএস ঘোষণা করে। পুরোনো এশিয়া-প্যাসিফিক বহুমাত্রিক জোটের বদলে গঠন করে ইন্দো-প্যাসিফিক জোট। জোটের চার শক্তির মধ্যে ভারত আমেরিকার পরই বৃহৎ সামরিক শক্তি, অন্য দুই দেশ হলো জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। পরাশক্তি চীনকে ভারত মহাসগর ও চীন সাগরে কোনঠাসা করতে এই অঞ্চলের মিত্র দেশগুলোর অর্থনীতি ও সামরিক শক্তি নিয়ে আমেরিকা দিন দিন শক্ত করার চেষ্টা করে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি।
যদিও চীন বসে নেই। এরই মধ্যে তারা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআই প্রকল্প ঘোষণা করেছে। এর অধীনে চীন অর্থনৈতিকভাবে উদীয়মান দেশগুলোকে বন্দর, সড়ক ও সেতুর মতো অবকাঠামো নির্মাণে ঋণ দেয়া শুরু করে। এই প্রকল্পে যুক্ত হচ্ছে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বহু দেশ। বৈশ্বিক আর্থিক সংস্থাগুলোর বিকল্প ঋণের উৎস হয়ে উঠেছে বেইজিং। আমেরিকার কলেজ অফ উইলিয়াম অ্যান্ড মেরির গবেষণা অনুযায়ী ২০২১ সাল পর্যন্ত আরআইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় দেড় শতাধিক দেশ। এতে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে আমেরিকার আধিপত্য খানিকটা খর্ব হয়েছে। এই আধিপত্য ঠিক রাখতে এখানে আমেরিকার দরকার শক্ত ঘাঁটি। এই অঞ্চলের মিয়ানমারের গণতন্ত্র সবচেয়ে দুর্বল। তাই ঘাঁটি গাড়ার জন্যে সেটাই সবচেয়ে পছন্দের যায়গা তাদের। কিন্তু চীন তো তাদের সামরিক জান্তার কাছে আমেরিকার চেয়ে বেশি প্রিয়। সমস্যাটা সেখানে। তাই তাদের দরকার মায়ানমারের আধিপত্য নেই, কিন্তু মায়ানমারের কাছাকাছি একটা এলাকা।
বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের স্থল সীমান্ত ২৮৩ কিলোমিটার। দেশটির ছয়টি অঞ্চলের মধ্যে দুটি অঞ্চল বাংলাদেশের সাথে সীমান্ত ভাগাভাগি করেছে। এরই মধ্যে ২০২১ সালে বার্মা অ্যাক্ট প্রণয়ন করে বাইডেন প্রশাসন। এই আআন অনুযায়ী মিয়ানমারের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ও চার্চ রক্ষা করতে চাইছে আমেরিকা। এই আইনের মাধ্যমে আমেরিকা সরাসরি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি ‘যুক্ত’ হয়ে গেছে। কারণ এখানে বলা আছে মিয়ানমারের ভেতরকার গণতন্ত্রের সংগ্রামকে আমেরিকা সহায়তা দেবে। আর এই যুক্ত হয়ে যাওয়ার বিষয়টিই আমেরিকার ভাষায় ‘মানবিক সহায়তা’।
বার্মা অ্যাক্ট ও এনডিএএ অ্যাক্ট পাশাপাশি মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার জন্য কত ব্যাপকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে আমেরিকা। আর এজন্য এই তল্লাটে নাগরিক সমাজকেন্দ্রিক স¤পৃক্ততা বাড়াতে চায় তারা। এদিকে, বার্মা অ্যাক্টে বলা আছে মিয়ানমারের মুক্তিকামী মানুষের পাশে আছে আমেরিকা। অর্থাৎ দেশটির বিদ্রোহী যে গ্রুপগুলো আছে তারা এই আইন প্রণয়নে অনেকটা উৎফুল্ল।
কেউ তাদের বাধা হয়ে দাঁড়ালে কঠোর ব্যবস্থা নেবে দেশটি। এটি মূলত চীনকে হুমকি দেয়া। কারণ জান্তা সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে চীন। এতে চীনও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসতে পারে। জান্তা সেনা জ্বালানি সরবরাহ করায় এ খাতও পড়তে যাচ্ছে নিষেধাজ্ঞার আওতায়। বার্মা অ্যাক্টকে ত্বরান্বিত করতে মিয়ানমারের প্রতিবেশী দুটি দেশ গুরুত্বপূর্ণ, পূর্বে থাইল্যান্ড এবং পশ্চিমে বাংলাদেশ।
আমেরিকার বার্মা অ্যাক্ট যে এই অঞ্চলে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আরাকানকে বাংলাদেশের সাথে যুক্ত করার প্রস্তাব শেখ হাসিনার সরকার প্রত্যাখ্যান করায় নতুন করে মাথা ব্যথার সৃষ্টি হয় বাইডেন প্রশাসনের। ফলে নানা কৌশলে বাংলাদেশকে ভয়ভীতি দেখাতে থাকে। আর অস্ত্র হিসেবে বেছে নেয় নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার নানা কৌশলের পরও নিজেদের অবস্থানে অটল থেকেছে ভারত ও চীন। আবার নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগকে সবার আগে অভিনন্দনও জানিয়েছে এই দুই দেশই। কাজেই বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা নির্বাচন, গণতন্ত্র কিংবা মানবাধিকার ইস্যু অনেকটা লোকদেখানো। বস্তুত এই অঞ্চলে সম্প্রসারিত ভূরাজনৈতিক কৌশল বাস্তবায়নই বাইডেন প্রশাসনের মূল উদ্দেশ্য।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com