জীবন ও জীবিকার তাগিদে আজ প্রায় চার বছর হতে চলল আমি নিউইয়র্ক আছি। বড় অদ্ভুত এই নগরী আর বড় অদ্ভুত এই নগর জীবন। শহরের আনাচে-কানাচে সর্বত্র যেন বিস্ময়ের এক মায়াজাল বিছানো। অদ্ভুত এক ব্যাপার ঘটে গেল কিছুদিন আগে। ওই সকালের একটা ব্যাপার নিয়ে সারাদিন যখন আমি বিমর্ষ, আমার সব ভাবনার ঘর যখন উল্টে পাল্টে যাচ্ছে। বেঁচে থাকার অর্থ যখন অর্থহীন ঠেকছে তখনি আরও একটা ঘটনা আমায় চোখে আঙ্গুল দিয়ে বলে গেল জীবনের মানে কি … আমার নিজেকে নিজের অনেক ছোট মনে হল … কী নিছক ছোট ছোট বিষয় নিয়ে আমরা আমাদের অর্থপূর্ণ জীবনটাকে অর্থহীন করে তুলি।
প্রতিটি দেশের রেলস্টেশন, বাসস্টেশনগুলোই সে দেশের সত্যিকার জীবনের প্রতিচ্ছবি বহন করে। সেই হিসাবে নিউইয়র্ক-এর রেলওয়েগুলো আমার মতে সব থেকে আলাদা এবং এর চেয়ে বেশি বৈচিত্র একসাথে পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় বলে আমার মনে হয় না। বস্তুত: আমার কাছে নিউইয়র্ক যেন সাগরের মতো। সব নদী যেমন সাগরে এসে মিশে যায়, তেমনি গোটা পৃথিবীর মানুষ যেন এখানে মিলেমিশে একাকার। আমার ভালোই লাগে এতো রং দেখতে…। আবার মাঝে মাঝে শঙ্কাও হয় এতো রঙের মাঝে আমি আমার নিজের রঙটা ভুলে যাচ্ছি নাতো!
সারাদিনের কাজের পরে বাড়ি ফিরছি ট্রেনে আমার ঠিক মুখোমুখি বসে একটা মেয়ে আপন মনে উলের কাঁটাগুলো এপাশ-ওপাশ করে কিছু একটা বুনে যাচ্ছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম একটা উলের টুপি। দেখে মনে হলো সে টুপিটায় ফিনিশিং টা” দিয়ে যাচ্ছে। জানিনা কেনো মেয়েটাকে দেখে অদ্ভুত মায়া হলো। কী যেন একটা বেদনার ছায়া মুখ জুড়ে। ছিপছিপে শরীরের গড়ন। হাঁটুর উপর পর্যন্ত একটা স্কার্ট পরা। ধবধবে সাদা সুন্দর সুগঠিত পা তাতে কালো ব্যাল্ট লাগানো এক জোড়া সেন্ডল সু পরা। উপরে টপ আর টপের উপরে হাল্কা শীতের চাদর জাতীয় কিছু। মাথায় পরেছে বেতের বড় হেট তাতে মাথা নিচু করলে মুখের অনেকটাই ঢেকে যাচ্ছে। এখন রাত তবুও সে বড় সান হেট টা পরে আছে অবশ্য এই হেটগুলো এখন এক ধরনের ফ্যাশন অনুষঙ্গ। আগে একসময় হেটগুলো সামাজিক পরিমর্যাদার বাহক ও ধর্মীয় অনুষঙ্গ ছিল। কিন্তু এখন আর সেটা নেই বললেই চলে।
বয়স কত হবে মেয়েটির বড়জোর ২৫-২৬। আমি বিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। আমার ক্লান্তি মাখা অলস মস্তিষ্কে হাজারো প্রশ্নের বুদবুদ শুরু হয়ে গেছে। এটা আমার প্রায়ই হয়…। আচ্ছা কার জন্য সে টুপিটা বুনে যাচ্ছে? ও যে গায়ে উলের একটা চাদরের মত কিছু পরে আছে। এটাও কি সে নিজে বানিয়েছে? মেয়েটার চোখমুখ কেনো এতো শান্ত? এই জাতীয় প্রশ্ন… মাঝে মাঝেই ট্রেনের অ্যানাউন্সমেন্ট অথবা দরজা খুলার শব্দে সে মাথা তুলে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে তারপর আবার তার কাজে মন দিচ্ছে। আমি যে অপলক তার দিকে তাকিয়ে আছি তাতে ওর কোনো ভ্রƒক্ষেপই নেই। কোন রকমের অস্বস্তি বোধও দেখছি না। একসময় মেয়েটা উলের টুপিটায় তার শেষ কাঠিটা ঘুরালো। তারপর সেটা সুন্দর করে ব্যাগের মধ্যে রেখে মোবাইল আর হেড ফোন নিল। আমি মনে মনে ভাবলাম সৃষ্টিকর্তা মানুষকে কতই না গুণের অধিকারী করে পাঠায়! আর আমিও সেই সৃষ্টিকর্তারই সৃষ্ট আস্ত একটা অশ্বডিম্ব মাত্র। কিছুই পারিনা … আমি যখন মানুষের যোগ্যতা আর নিজের অযোগ্যতা নিয়ে এতো শত ভাবছি তখনি মেয়েটা আমার ভাবনায় আরো শত ঘা বসিয়ে দিয়ে হাতে সাদা ছড়ি আর চোখে কালো গ্লাস পরলো। আমার ভাবনার ঘর উলট-পালট হয়ে গেল মূহূর্তে। যেন নিমিষেই আমি আমার অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম।
মেয়েটা ব্যাগ থেকে ফ্ল্যাটের চাবি বের করলো তারপর পরবর্তী স্টেশনে নেমে গেলো। আমি হতবাক হয়ে মেয়েটার খুব সাবলীলভাবে সাদা ছড়ি নিয়ে হেঁটে যাওয়া, সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠা দেখলাম যতক্ষণ পর্যন্ত না ট্রেনের দরজা বন্ধ হয়ে ট্রেন আবার ছুটে চলল।
কী আশ্চর্য এই মানব জীবন! এই দৃষ্টিহীন মেয়ে আজ আমাকে দৃষ্টি দান করল। জীবনবোধের দৃষ্টি। অনেক কিছুই করার আছে এই জীবনে…। কোন প্রতিবন্ধকতাই শেষ প্রতিবন্ধকতা নয়। কত সহজ অথচ আমরা বুঝি না হয়তো বুঝিও কিন্তু উপলব্ধি করি না…