1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৩:৫৮ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

ডাক দিয়ে যায় ইতিহাস : সুখেন্দু সেন

  • আপডেট সময় সোমবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৭

বঙ্গবন্ধু তুমি
স্বাধীনতার পটভূমি।
তোমার জীবন ঘিরে
সকল অহংকারে
কতশত যুগ পরে,
জেগে ওঠে এক দেশ
তোমার নামে নাম বাংলাদেশ
প্রিয় জন্মভূমি। – লেখক

শতাব্দীর প্রবাদ পুরুষ, সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, যার জন্ম না হলে বাংলাদেশের সৃষ্টি হত না, ইতিহাস যার কণ্ঠে আজো ডাক দিয়ে যায়, বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রয়াণ দিবস আজ। কত শোকে, কত ক্ষোভে, হাহাকারে. প্রত্যয়ে, কত বেদনাগাঁথায় প্রলেপিত হয়ে আছে এই শোকের দিনটি।
এসেছে কান্নার দিন/কাঁদো বাঙালি কাঁদো। কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘আগস্ট শোকের মাস, কাঁদো’ কবিতায় ১৫ আগস্টের শোকাবহ দিনটিকে এভাবেই বিশেষায়িত করেছেন। বাংলার প্রকৃতিও এ মাসটিতে এমনি এক শোকের আবহ তৈরি করে রাখে। বাঙালির অন্তরাত্মার ক্রন্দন অশ্রু হয়ে ঝরে শ্রাবণ ধারায়। বাংলা ও বাঙালির অস্তিত্বের বঙ্গবন্ধু, হৃদয়ের রবীন্দ্রনাথ ও চেতনায় নজরুল এই তিন মহামানবের মহাপ্রয়াণ ঘটেছিল এই মাসে। কী দৈব যোগসূত্র নির্ধারণ করে রেখেছিল নিয়তি। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির হৃদয়ের উদ্বোধন ঘটিয়েছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করে দিয়ে গেছেন শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু বাংলার পরিপূর্ণ ভৌগোলিক সীমানা নির্ধারণ করে বিশ্ব মানচিত্রে স্থায়ী আসন তৈরি করে দিয়ে গেছেন। ইতিহাসের প্রথম বাঙালি জাতি রাষ্ট্র গঠন করে স্বাধীন বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষাকে নিয়ে গেছেন জাতিসংঘে। নজরুল সুপ্ত চেতনাকে উজ্জীবিত করে কুসংস্কার, কূপমণ্ডুকতা ও বন্দিত্ব হতে মুক্ত হতে বাঙালিকে শিখিয়েছেন শিকল ভাঙার গান। অন্তর দিয়ে কামনা করেছেন বাংলা ও বাঙালির জয়।
এমনি এক মেঘ থৈ থৈ শ্রাবণে হায়েনার হিংস্র থাবা মধ্যরাতের অন্ধকারে খাবলে ধরেছিল প্রিয় স্বদেশের বুক। বিবেকবান বিশ্বকে স্তব্ধ করে জাতিকে হতচকিত করে সভ্যতার ইতিহাসে এক কলংকজনক, নির্মম ও কাপুরুষোচিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল ১৫ আগস্টের কালো রাতে। নৃশংসতা ও বর্বরতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আরো একটি অসাধারণত্ব। সেটি পাপ। হত্যাকারীদের রক্ষার জন্য তড়িঘড়ি করে তৈরি করা হয়েছিল ইনডেমনিটি অ্যাক্ট। খুনীদের পৃষ্ঠপোষকতা ও হত্যাকাণ্ডের বৈধতা দান অপরাধকে দিয়েছিল পাপের গভীরতা। বিলম্ব হলেও সে আইন রহিত করে জাতি পাপমুক্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন এবং রায় কার্যকর করে জাতি হয়েছে কলঙ্কমুক্ত। যদিও কয়েকজন সাজাপ্রাপ্ত খুনী এখনো মৃত্যুদ- মাথায় নিয়ে পলাতক রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের এমন নির্মমতার নজির বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। সেদিন একই সাথে বঙ্গবন্ধুর সকল স্বজনকে হত্যা করা হয়েছিল। নবপরিণিতা বধূ, অন্তঃসত্ত্বা নারী, ভয়ে বিহ্বল আট বছরের শিশু রাসেলকে হত্যা করে অন্ধকারের সেই কাপুরুষেরা হিংস্রতার সকল মাত্রা অতিক্রম করে হৃদয়হীন উন্মাদনায় উচ্চারণ করেছিল ‘অল আর ফিনিশড’। শুধুমাত্র শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা ভাগ্যক্রমে বিদেশে অবস্থান করায় বেঁচে যেতে পেরেছিলেন।
ঘাতক চক্র যে ব্যক্তি মুজিবকে হত্যা করেছিল কেবল তা নয়। হত্যা করেছিল বাংলাদেশের আত্মাকে। আঘাত করেছিল বাংলাদেশের অস্তিত্বে। নবজাতক এই দেশটিকে আঁতুড়ঘরেই গলাটিপে হত্যা করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। কট্টর কমিউনিস্ট চীন, ধর্মবাদী সৌদিআরব, পরাজিত পাকিস্তান আর প্রবল বাধা সত্বেও বাংলাদেশের স্বগর্ব অভ্যুদয়ের সজোর চাপেটাঘাতে অপমানিত কিসিঞ্জার, বিশ্বাসঘাতক মোস্তাক চক্র এক জোট হয়েছিল। এর সাথে যোগ দিয়েছিল দেশীয় পরাজিত শক্তি। হঠকারী উগ্র বামেরা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে, সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের নামে, সদ্যজাত রাষ্ট্রের তরল অবস্থায় ক্রমাগত আঘাত হেনে থানা, ব্যাংক লুট, পাটের গুদামে আগুন, জনপ্রতিনিধি হত্যা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও, ভারতীয় হাইকমিশনারকে অপহরণের মাধ্যমে অরাজকতা, অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করে অপপ্রচার ও ভিত্তিহীন গুজব ছড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অবস্থান খুনীদের উৎসাহিত করার পক্ষে যথেষ্ট কার্যকর ছিল। সরকারের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা কিছু বিশ্বাসঘাতক ও আমলা এ ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়ে বিভিন্ন সংকট তৈরি, পরিকল্পিতভাবে কৃত্রিম খাদ্যাভাবের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষাবস্থা তৈরি করে গণমনে অসন্তোষ সৃষ্টি করে অভ্যুত্থানের পটভূমি রচনায় ভূমিকা রেখেছিল। এর প্রমাণ পেতে বিলম্ব হয়নি। খাদ্যাভাব সৃষ্টিতে দক্ষতা প্রদর্শনকারী তৎকালীন খাদ্য সচিবকে পরবর্তী সুবিধাভোগী সেনা শাসক পুরস্কৃত করেন খাদ্যমন্ত্রী বানিয়ে। আর খুনীদের পুরস্কৃত করা হয়েছিল বিভিন্ন দূতাবাসে নিয়োগ ও পদোন্নতি দিয়ে। পাকিস্তান ফেরত সেনা সদস্যদের কদর বেড়ে যায়। স্বাধীনতাবিরোধীদের বসানো হয় গুরুত্বপূর্ণ পদে। বানানো হয় প্রধানমন্ত্রী।
সেদিন কি পলাশীর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল? নবাব সিরাজের মনোনীত প্রধান সেনাপতি মীরজাফরই সেদিন ষড়যন্ত্রের প্রধান হোতা ছিল। আর বঙ্গবন্ধু যাকে সংগত কারণে সেনাপতি করেননি তিনিই ছিলেন এ চক্রান্তে যুক্ত। পলাশীতে সেনাপতি মীরমদন, মোহনলালেরা স্বদেশপ্রেম ও নবাবের প্রতি অনুগত থেকে যুদ্ধ করেছেন, প্রাণও দিয়েছেন। আর এখানে সেনাপতিরা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় এবং ব্যর্থ।
বঙ্গবন্ধু কখনও বিশ্বাস করেননি কোনো বাঙালি তার ক্ষতি করতে পারে। হত্যা করা তো চিন্তায়ই আনেন নি। নিজের সুরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি ছিলেন উদাসীন। অথচ এ দেশের, তাঁর নিজের হাতে গড়া সেনাবাহিনীর বিকৃত মানসিকতার কিছু সেনা, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীদের ইশারায় তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে ইতিহাসের চাকাকে উল্টোপথে পরিচালিত করতে চেয়েছিল। ১৫ই আগস্টের পর আবার পাকিস্তান ফিরে এলো বলে আহ্লাদে আমোদিত হয়েছিল অনেকেই। আন্তর্জাতিকভাবেও এর প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। চীন, সৌদিআরব কর্তৃক বাংলাদেশকে তড়িঘড়ি স্বীকৃতি দান এর প্রমাণ। যে চীন জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভে পূর্বে বারবার বাধার সৃষ্টি করেছিল। এবারো পাকিস্তানকে প্রত্যক্ষ সমর্থন ও অস্ত্র দিয়ে গণহত্যায় সহযোগিতা করেছিল। কী ব্যাকুলতায় মার্কিনীরা আদরে সোহাগে কাছে টেনে নিয়েছিল বাংলাদেশকে।
এ জঘন্য হত্যাকা-ের পরিণতি কেবল কয়েকটি শোকাহত ঘটনায় শেষ হয়ে যায়নি। অভিশাপের মতো জাতিকে আকড়ে ধরে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও গতিকে পরিবর্তন করে দিয়েছিল। সে অভিশাপ থেকে আজও মুক্ত হওয়া যায়নি। কিছু উচ্ছিষ্টভোগী রাজনীতিক, সুবিধাভোগী নির্বিবেক জ্ঞানপাপী তৎপর হয়ে উঠে ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে মহান মুক্তিসংগ্রামকে হেয় প্রতিপন্ন করার কাজে। স্বাধীনতার অর্জনগুলোকে একে একে ধ্বংস করে ফেলার তৎপরতা চলে সুকৌশলে। ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা মুছে ফেলার অপচেষ্টাও জোরদার হয়েছিল। অর্বাচীনেরা শেখ মুজিবকে অস্বীকার করার ধৃষ্টতাও দেখায়। তাদের সকল ষড়যন্ত্র, হীনমন্যতা, মিথ্যাচার ব্যর্থ করে দিয়ে আজ ইতিহাস তার স্বরূপে-স্বমহিমায় আবির্ভূত। এটাই ইতিহাসের আমোঘ বিধান।
শেখ মুজিব, বঙ্গবন্ধু, জাতির জনক, মুজিব বা মুজিবুর রহমান যে নামেই সম্বোধন করা হোক না কেন প্রতিটি শব্দই আপন ব্যঞ্জনায় হিমালয়ের বিশালতা, সাগরের গভীরতা আর আকাশের উদারতা নিয়ে যেটি মূর্ত করে তুলে সেটি ব্যক্তি মুজিব নয়Ñ বিমূর্ত মানচিত্র। একটি পতাকা, একটি স্বাধীন দেশÑ বাংলাদেশ। কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি। তাই অনুভব করতে পারি হিমালয়ের বিশালতা।’ সোহরাওয়ার্দির ভাবশিষ্য, শেরেবাংলার অনুরাগী, মওলানা ভাসানীর স্নেহধন্য মুজিব তাঁর রাজনৈতিক গুরুদের সকল অপূর্ণতা পূরণ করেই হয়ে উঠেছিলেন এক সম্পূর্ণ মুজিব। এদের বিভিন্নমুখী চিন্তা-ভাবনার সার্থক সমন্বয় এবং নিজের সারা জীবনের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আপোষহীন সংগ্রামের আদর্শে জাতিকে উজ্জীবিত ও ঐক্যবদ্ধ করে ইতিহাসের এক মহেন্দ্রক্ষণে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ডাক। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, সুন্দরবন থেকে সুনামগঞ্জ ৫৬ হাজার বর্গমাইলব্যাপী সকল বাঙালির আত্মার বিস্ফোরণ ঘটে গিয়েছিল একই সঙ্গে।
কবি আল-মাহমুদ যে ভাষায় বলেনÑ সে যখন বলল, ভাইসব। অমনি অরণ্যর এলোমেলো গাছেরাও সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল। সেই তো ইতিহাস। অতুলনীয় ইতিহাস। সে ইতিহাস লেখার জন্য জ্ঞানপাপী, তাঁবেদার, ভাড়াটে ইতিহাসবেত্তার প্রয়োজন পড়ে না। সময়ই সেটা লিপিবদ্ধ করে দিয়েছে রক্তাক্ত পটভূমিতে।
স্বাধীনতা, বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু সে তো সমার্থক। একটি থেকে অন্যটি বিচ্ছিন্ন হওয়ার নয়। এ অবিচ্ছেদ্য বন্ধন একদিনে বা হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। লক্ষ-কোটি জনতার হৃদকম্পন অনুভবে, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আস্থা অর্জনের নিরন্তর সাধনার ফসল। এ সাধনা সাধিত হয়েছে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কারান্তরালের নির্জন প্রকোষ্ঠে, ফাঁসির দড়িতে গলা বাড়িয়ে, পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টে হাজারো নির্যাতনে মাথা না নুইয়ে, প্রতিদিন প্রতিকর্মে, জীবনাচারে বাঙালির জন্য নিখাদ ভালোবাসায় সে সাধনা বুকে লালন করেই তো নেতা ও জনতার ঐক্যসূত্র, এমন অটুট বন্ধন।
১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে কেবল স্মরণ করাই যথেষ্ট নয়, তিনি কি কেবলই স্মৃতি? জাতির চলমান ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু সর্ববস্থায় সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। শেখ মুজিবের জীবন সংগ্রামের প্রতি মুহূর্তের প্রতিক্ষণ সত্যিকার অর্থে বাঙালিকে প্রাণিত করবে অনন্তকাল। আজকের রাজনীতিতে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তপনায়, দখলদারিত্বের প্রতিযোগিতায়, আধিপত্য বিস্তারের সংঘর্ষে, অবক্ষয়ের ঘুনে আক্রান্ত সমাজে, মানবিক বিপর্যয়ে, মানবাত্মার অপমানে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করার মতো হৃদয়ের প্রশস্ততা বা পবিত্রতা ক’জন রাজনীতিক নেতা-কর্মীর রয়েছে। ভোগ-লালসায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত থেকে, হীন স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজনে অনৈতিক চর্চায় বঙ্গবন্ধুকে যারা ট্রেডমার্ক হিসাবে যত্রতত্র ব্যবহারের প্রতিযোগিতায় মত্ত রয়েছেন তারাও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীর মতো অপরাধী। তাদের পাপের গভীরতা আরো ব্যাপক। কারণ তারা প্রতিনিয়ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে খুন করছেন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com