1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ১১:০৯ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

হাজার দুয়ারীর হাজার কথা এবং খোসবাগের মর্মগাঁথা : সুখেন্দু সেন

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৩ জুন, ২০১৭

মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের প্রপৌত্র বাংলার সুবেদার আজিমু-শান্ এর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে দেওয়ান মুর্শিদকুলী খাঁ যখন দেওয়ানি সদর দফতর রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর (বর্তমান ঢাকা) থেকে মকসুদাবাদে স্থানান্তর করেন। তখন থেকেই অখ্যাত জঙ্গলাকীর্ণ সে অঞ্চলের শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে এবং ক্রমে তা মুর্শিদাবাদ নগরীতে পরিণত হয়। দিল্লীর মোগল স¤্রাট ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলী খাঁ কে বাংলার সুবেদার মনোনীত করলে ঢাকার পরিবর্তে মুর্শিদাবাদই রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। তখন এটি হয়ে ওঠে ব্যবসা-বাণিজ্য-রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। বিভিন্ন রাজকীয় প্রাসাদ, সুরম্য অট্টালিকা, খাজাঞ্চিখানা, তোপখানা, সরাইখানা, সেনা ছাউনি, টাকশাল, হাতিশাল, ঘোড়াশাল নির্মিত হলো। অভিজাত ধনাঢ্য ব্যক্তিরা রাজধানী মুর্শিদাবাদে এসে বসতি স্থাপন করতে শুরু করলেন। ইংরেজ, ফরাসি, ডাচ, আর্মেনীয়রা রাজধানীর আশেপাশে বাণিজ্য কুঠি স্থাপনে উৎসাহী হয়ে উঠল। সুজলা-সুফলা বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদের সুনাম ও জৌলুস ছড়িয়ে পড়লো সর্বত্র।
মুর্শিদকুলী খাঁ মুর্শিদাবাদ নবাবীর পত্তন করলেও পরবর্তীতে নবাব আলীবর্দিই মূলত স্বাধীন নবাবী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভাগ্যহীন মুর্শিদাবাদের সে গৌরব আজ আর নেই। কালের আবর্তে আর ভাগিরথী বক্ষে বিলীন হয়ে গেছে মুর্শিদকুলী খাঁ নির্মিত চেহেলসেতুন প্রাসাদ, সুজাউদ্দিন নির্মিত মহলসরা, ফার্হাবাগ। নবাব আলীবর্দি নির্মিত মতিঝিল প্রাসাদ, সিরাজ-উদ-দৌলার সাধের হীরাঝিল বা মুনসুরাগঞ্জ প্রাসাদ, এনতাজ মহল, রংমহল। বর্তমান মুর্শিদাবাদে পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ হাজার দুয়ারী প্রাসাদ, যা এখন মিউজিয়াম হিসাবে ব্যবহৃত এবং ‘হাজার দুয়ারী প্যালেস মিউজিয়াম’ নামে খ্যাত। এটি নির্মিত হয় নবাব হুমায়ূন জাঁ’র আমলে। তিনি মীরজাফর প্রতিষ্ঠিত নবাবীর অষ্টম উত্তরাধিকারী এবং বংশধর হিসাবে পঞ্চম। ১৮২৯ সালের ২৯ আগস্ট বড়লাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের উপস্থিতিতে স্থপতি কর্নেল ম্যাকলিয়ড ডানকানের তত্ত্বাবধানে গ্রিসিয়াম ডোরিক স্থাপত্যের এই সুরম্য প্রাসাদের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং দীর্ঘ আট বছরে নির্মাণ সম্পন্ন হয়। তৎকালীন সময়ে এর নির্মাণ ব্যয় ছিল এক লক্ষ সাতষট্টি হাজার পাউন্ড বা সাড়ে ষোল লক্ষ টাকা। বিশালাকার তিনতলা বিশিষ্ট দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদটিতে আসল-নকল মিলে হাজারটি দরজা থাকায় লোকমুখে এর নামকরণ হয় ‘হাজার দুয়ারী’। প্রাসাদের সামনে সুরম্য উদ্যান ও বিস্তৃত সবুজ প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গণের অন্য প্রান্তে বিশাল ইমামবাড়া। পূর্বে এ স্থানে সিরাজ-উদ-দৌলা নির্মিত কাঠের ইমামবাড়া অবস্থিত ছিল। ১৮৪৬ সালে অগ্নিকাণ্ডে সেটি ভস্মিভূত হয়ে গেলে পরবর্তী সালে হুমায়ূন জাঁ’র পুত্র ফেরাদুন জাঁ বর্তমান ইমামবাড়াটি নির্মাণ করেন। এটি এ উপমহাদেশের বৃহত্তম ইমামবাড়া। হাজার দুয়ারী ও ইমামবাড়ার মধ্যস্থলে সিরাজ নির্মিত মদিনা মসজিদ। সিরাজের এই একটি মাত্র কীর্তিই এখানে বর্তমান। মদিনার কারবালা প্রান্তরের মাটি এনে এর ভিত তৈরি করা হয়েছিল। আকারে ছোট হলেও এক সময় মসজিদটি বহুমূল্য রত্ন খচিত অপরূপ কারুকার্যময় দরজা-জানালায় শোভিত ছিল। এখন সে দরজা-জানালা আর নেই। মদিনা মসজিদের সামনে ঢাকার বিখ্যাত জনার্দন কর্মকারের তৈরি ১৮ফুট দৈর্ঘ ও ২২ইঞ্চি ব্যাস বিশিষ্ট বিশালাকার ‘বাচ্চাওয়ালী তোপ’।
প্যালেস মিউজিয়ামের এক তলার মধ্যভাগে রয়েছে বিখ্যাত অস্ত্রাগার। ইতিহাস খ্যাত রাজা-বাদশাহদের ব্যবহৃত অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে নাদিরশাহের বর্ম ও মোচাকৃতি ফলাযুক্ত বল্লম। শেরশাহের লৌহ শিরস্ত্রাণ, নবাব আলীবর্দির তলোয়ার, সিরাজের ব্যবহৃত তরবারী ও সাত নলা বন্দুক, ফার্সি লিপিযুক্ত গন্ডারের চামড়ার ঢাল। সংরক্ষিত আছে লৌহ নির্মিত কয়েকটি কামান ও নৌকায় ব্যবহারের উপযোগী পিতল নির্মিত ৭টি ছোট আকৃতির কামান। চল্লিশটি ছোটবড় পিস্তলের মধ্যে একটি রুপার বাটযুক্ত ক্ষুদ্রাকৃতি পিস্তল, বিভিন্ন ধরনের বন্দুক, একটি স্টিক বন্দুক। অসংখ্য তরবারি ও ছোরা যার মধ্যে অনেকগুলি হাতির দাঁত ও রুপার বাটযুক্ত। রয়েছে ইংরেজ, ফরাসি ও মোগলদের ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র। পলাশীর যুদ্ধে যে কামান বিস্ফোরিত হয়ে সিরাজের বিশ্বস্ত সেনাপতি মিরমদন নিহত হয়েছিলেন, সে কামানটি এবং অকৃতজ্ঞ মোহাম্মদী বেগ যে ছোরা দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে হত্যা করেছিল সেটিও সযতেœ রক্ষিত আছে হাজার দুয়ারীর সংগ্রহশালায়।
দ্বিতলে আর্ট গ্যালারিতে আছে বিখ্যাত চিত্রকরদের আঁকা মুর্শিদকুলী খাঁ থেকে ওয়ারেস আলী মির্জা পর্যন্ত ১৮ জন নবাব, ১১ জন দেওয়ান ও নবাবের তৈলচিত্র। হার্ডসনের আঁকা লর্ড কর্নওয়ালিসের ছবি, দরবারে নিযুক্ত কয়েকজন বৃটিশ প্রতিনিধি ও কয়েকজন নবাবের শৈশবের ছবি। রয়েছে জন মার্শালের আঁকা বিখ্যাত ছবি ‘বেরিয়েল অব স্যার জন মুর’। ইংরেজ-ফরাসি যুদ্ধে নিহত জন মুরকে রাতের বেলা চন্দ্রালোকে সমাহিত করার দৃশ্যে আলোছায়ার অপূর্ব সমন্বয়ে চিত্রিত মোহময় জ্যোৎস্না দর্শক দৃষ্টিকে মোহাবিষ্ট করে তোলে। পৃথিবীর মাত্র দু’টি স্থানে সংরক্ষিত এই ছবির মধ্যে এটি দ্বিতীয়। অন্যটি বৃটিশ মিউজিয়ামে। ’সেন্টমেরী’র একটি অনন্য সুন্দর তৈলচিত্রের চিরনতুন অঙ্কন শৈলী দর্শকদের আকৃষ্ট করে। কিং উইলিয়াম দ্য ফোর্থের একটি পোর্টেট যা রাজা স্বয়ং উপহার হিসাবে নবাব হুমায়ূন জাঁ কে প্রদান করেছিলেন সেটিও সংরক্ষিত আছে। এ ছাড়া ভ্যান ডিউক, গিরীজা শঙ্কর ও নবাব সাদেক আলী মীর্জার কয়েকটি চিত্রকর্ম রয়েছে।
প্যালেস মিউজিয়ামের লাইব্রেরিটি অনেক মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি গ্রন্থে সমৃদ্ধ। প্রদর্শনের জন্য যেগুলি উন্মুক্ত আছে তার মধ্যে বাগদাদের বিখ্যাত হারুন-আল-রশিদের হস্তলিখিত এবং নকশা শোভিত কোরআন, আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী গ্রন্থের মূল পা-ুলিপি, প্রায় ৮০০ বছরের পুরনো কোরআন শরীফ উল্লেখযোগ্য। মাত্র দুই ইঞ্চি সাইজের একটি হস্তলিখিত কোরআন শরীফও এখানে দেখা যায়। সাড়ে চার ফুট দৈর্ঘ ও তিন ফুট প্রস্তের বিশালাকার একটি অ্যালবাম রয়েছে, যার ওজন প্রায় ২০ কেজি। সংরক্ষিত আছে ঐতিহাসিক চুক্তিপত্র, অনুমোদনপত্র, নিয়োগপত্র, রাজকীয় ফরমান, দলিল, তা¤্রলিপি, রাজা-বাদশাহের সীলমোহর ও মনোগ্রাম।
দ্বিতলে সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে অংশটি সেটি দরবার। সুরম্য দরবার হলটি গোলাকার। চারদিকে চারটি দরজা। দুই দরজার মাঝখানে মার্বেল পাথরের দুটি বিশালাকৃতির সুদৃশ্য মোমবাতি স্ট্যান্ড। ৮০ ফুট উচ্চতার গোলাকৃতি ছাদ গ্রিক শিল্পকলায় সজ্জিত। ছাদের কেন্দ্রে ঝুলানো ১০১টি বাতিবিশিষ্ট ভিক্টোরিয়ান ঝাড়। দরবারের দক্ষিণ দিকে মার্বেল পাথরের পাটাতনের ওপর সোনার কারুকাজ বিশিষ্ট রৌপ্য নির্মিত সিংহাসন। ওপরে বিশাল রুপোর ছাতা এবং সামনে রৌপ্য নির্মিত আলবোলা। দেয়ালে বৃটিশ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে নবাব হুমায়ূন জাঁয়ের দরবার পরিচালনার একটি সুবৃহৎ তৈলচিত্র। দেয়ালের ওপরের দিকে চারটি ঝরোকা। ত্রিতলে অবস্থিত বেগম মহলের মহিলাদের দরবার প্রত্যক্ষ করার জন্য এ ব্যবস্থা। রাজকীয় প্রদর্শনে রয়েছে স¤্রাট শাহজাহানের ব্যবহৃত হস্তিদন্ত নির্মিত তাঞ্জাম। স¤্রাট ঔরঙ্গজেব কন্যা জেবুন্নেছার রৌপনির্মিত রাজকীয় পালকি, নবাব ফেরাদুন জাঁয়ের হাতির দাঁতের পালকি, দু’টি রুপো এবং দু’টি হাতির দাঁতের তৈরি সুদৃশ্য হাওদা (হাতির পিঠে বসার আসন)। এছাড়া স্ফটিক ও পাথরের ভাস্কর্য, হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম, খাদ্যে বিষক্রিয়া যাচাইয়ের টেস্টিং প্লেট, রাজকীয় পোশাকসহ অনেক শৈল্পিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন। একটি আর্শ্চয্য আয়না এমনভাবে স্থাপিত আছে যার সামনে দু’তিন জন দাঁড়ালে নিজের প্রতিবিম্বটি নিজে কেবল দেখা যায় না।
এক নাগাড়ে সাড়ে তিন ঘণ্টা মিউজিয়ামের কক্ষগুলো ঘুরে দেখতে দেখতে ইতিহাসের অনেক পাতাই চোখের সামনে খুুলে গেলো। মিরজাফরের বংশধর কর্তৃক এই হাজার দুয়ারী প্রতিষ্ঠিত বলে হয়তো এর রাজকীয় ঠাঁট, জৌলুস ও জাঁকজমক দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও এর কোন গৌরবের আবেগ প্রথমদিকে হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি। মনে কিছুটা দ্বিধা নিয়েই ভিতরে প্রবেশ করেছিলাম। কিন্তু অভ্যন্তরে অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান ঐতিহাসিক নিদর্শন, চিত্রকর্ম, শিল্পসম্ভারের সমৃদ্ধ সংগ্রহের জন্য এ মিউজিয়ামটি গর্ব করতেই পারে। ইতিহাসের বাঁকে জমা হর্ষ-বিষাদের মিশ্র অনুভূতি আর পরদিন সুবে-বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সমাধিক্ষেত্র খোসবাগ দেখার সংকল্প নিয়ে প্যালেস মিউজিয়াম ত্যাগ করেছিলাম। খোসবাগ দর্শন না করলে যে বাঙালির মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ অপূর্ণই থেকে যায়।
পর্যটকদের তেমন আনাগোনা নেই খোসবাগে। দু’দিন অপেক্ষার পর সঙ্গী পাওয়া গেল বিহারের ছেলে মুকেশকে। দীর্ঘদিন মুর্শিদাবাদে বসবাস। বাঙালি কন্যা বিয়ে আর বাঙালিদের সাথে উঠা-বসায় প্রথম আলাপে অবাঙালি ভাবা যায় না। কথাবার্তায় অজানতেই মাতৃভাষার কিছু উচ্চারণ মাঝে মধ্যে জাতীয়তা জানান দিয়ে যায়। বাংলা-বিহার-ওড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দোলার সমাধি দর্শনে বাংলা বিহারের দুই প্রতিনিধি। তবে দু’জনের আবেগ অনুভূতি ভিন্ন। আমার আগ্রহেই সঙ্গী হতে রাজি হয়েছিল মুকেশ। যেতে যেতে বললো, এর আগে একবারই মাত্র এসেছিল। দেখার মত বিশেষ কিছু নেই। তবে বাগানটি বহুৎ ভাল লেগেছিল। গোলাপের অনেক ভ্যারাইটি আছে।
ভ্রমণ যদি কেবল বিনোদন হয়ে থাকে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বা শিল্প সুষমা উপভোগের মনোমুগ্ধকর দৃষ্টিসুখ হয়ে থাকে তবে আজকের দ্রষ্টব্য এর কোনটিই নয়। নিছক ভ্রমণবিলাসও বলা যাবে না। ইতিহাসের কোন বিষাদময় অধ্যায়ের পৃষ্ঠা খুলে কিছুক্ষণের নীরব পাঠ মাত্র। এক পরাজিত হতভাগ্য নায়কের সমাধিস্থল খোসবাগ। ইতিহাস এখানে কেবল হাহাকারই করে উঠে। শুধু চোখ দিয়ে দেখার নয়, হৃদয় দিয়ে অনুভবেরও কিছু একটা আছে।
লালবাগ থেকে ভাগীরথী পার হয়ে দক্ষিণদিকে প্রায় এক মাইল দূরে শান্ত নির্জন পরিবেশে শায়িত আছেন সুবে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। নবাব আলীবর্দী খাঁ জীবিত থাকাকালেই নিজ সমাধির জন্য নির্মাণ করেছিলেন প্রাচীর বেষ্টিত এবং সুগন্ধী পুষ্পবৃক্ষ শোভিত খোসবাগ। দাদু আলীবর্দীর পাশেই প্রিয় দৌহিত্র সিরাজের সমাধি। সিরাজের পদপ্রান্তে বেগম লুৎফা। পূর্ব পাশে সিরাজের ভ্রাতা মীর্জা মেহেদী, যাকে সিরাজের মতই নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল। অত্যন্ত সাধারণ সমাধি ক্ষেত্র। কোন আড়ম্বর নেই। নেই কোন চাকচিক্য। আড়াইশ বছরের ইতিহাসের জীর্ণ, নীরব ভাষার কেবলই আকুলি-বিকুলি।
হাজার দুয়ারীর নজরকাড়া বৈভব, দৃশ্যমান জৌলুস মনে কোন দাগ না কাটলেও সাদামাটা সমাধির পাশে এসে গভীর নির্জনতায়, করুণ বিষণœতায় অন্তর আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। হৃদয় আপ্লুত হলো শ্রদ্ধা ভালবাসার এক অনির্বচনীয় আবেগে। দাদু নবাব আলীবর্দ্দী খাঁ’র ¯েœহাধিক্যে বিলাসী তরুণ সিরাজের ব্যক্তিজীবন বা নবাব হিসাবে দক্ষতা, পারদর্শিতা যাই থাক না কেন, নবাবী প্রাপ্তির মাত্র এক বৎসর সময়কালে অর্থলোভী আমত্যপরিষদ, চক্রান্তকারী আত্মীয়-স্বজন, কূটকৌশলী ইংরেজ, বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি মীরজাফরের ষড়যন্ত্রের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়া স্বাধীনতাকাক্সক্ষী অথচ নিরুপায় নবাবের দেশপ্রেম ও মর্মান্তিক জীবনদান, বাঙালি বিশেষ করে বাংলাদেশের বাঙালি মানসে সিরাজ এক দেশপ্রেমিক বীরের মর্যাদায় অভিষিক্ত। আর তাই মুর্শিদাবাদ বলতে প্রথমে যেটি মনে আসে তা হলো বাংলার ইতিহাসের এক ট্র্যাজিক নায়ক নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং সেই সঙ্গে এক বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের নাম।
সমাধির পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে কি এক শিহরিত আবেশে আপনা হতেই চোখ বুজে এলো। সমাধি ক্ষেত্রের দৃশ্যপটগুলি যেনো আলো-ছায়ার মত পরিবর্তিত হয়ে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়ে গেলো পলাশীর প্রান্তরে। ফুলের বাগানগুলি যেনো বিস্তীর্ণ আ¤্রকানন। হাওয়ায় দোলা লাল গোলাপগুলি মনে হলো কামানের ছুটন্ত অগ্নিগোলা। এক প্রান্ত থেকে ক্লাইভের ইংরেজ বাহিনী কামান দাগছে। অন্য প্রান্তে নবাবের বিশাল বাহিনী প্রধান সেনাপতি মীরজাফরের নির্দেশে পুতুলের মত ঠায় দাঁড়িয়ে। গুটিকতক অনুগত সৈন্য নিয়ে মোহনলাল প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে। কামানের গোলার বিস্ফোরণে আরেক বিশ্বস্ত সেনাপতি মিরমদন হঠাৎ লুটিয়ে পড়লো যুদ্ধক্ষেত্রে। নবাব সিরাজ উদ্ভ্রান্তের মত একবার ছুটে যাচ্ছেন সেনাপতি মীরজাফরের কাছে। মিনতি করছেন আক্রমণের নির্দেশ দিতে। আরেকবার প্রাণপণে চেষ্টা করছেন ছত্রভঙ্গ সৈন্যদের একত্রিত করতে। একবার যদি একযোগে আক্রমণ করা যায় তবে মুহূর্তেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ক্লাইভের বাহিনী। রক্ষা পাবে বাংলার স্বাধীনতা। কিন্তু অসহায় নবাবের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হলো অভিশপ্ত পলাশীর প্রান্তরে।
দাদা কি বংলাদেশ থেকে এস্ছেন? আপনি কি বংলাদেশের? গাইড সম্ভবত কয়েকবারই এ প্রশ্নটি করেছিল। উত্তর পাবার আগেই আবার বলতে শুরু করলোÑ বাংলাদেশের লোকেরাই এখানে বেশি আসে। মুর্শিদাবাদের সবাইতো মীর জাফরআলী খাঁ’র বংশধরদেরই দু’শো বছর নবাব বলে মান্য করে এসেছে। এরাই ছিল বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব নাজিম। এখানকার কেউতো সিরাজের কথা মনেই রাখেনি।
গাইডের কথায় সম্বিত ফিরে এলো। তাকিয়ে দেখলাম মুকেশ কাছে নেই। বাগানে গোলাপের ভ্যারাইটি দেখছে। বিকেল পেরিয়ে গেছে আগেই। দূরের আম বাগানের মাথার উপর হেলে পড়া সূর্য পশ্চিমাকাশে অস্তরাগের বিষণœ রঙ ছিটিয়ে দিয়েছে। ফিরে আসতে আসতে ভাবলাম, মীরজাফরের বংশধরেরা মুর্শিদাবাদে রয়ে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু মীরজাফরের প্রেতাত্মারা ছড়িয়ে রয়েছে সর্বকালে এবং সর্বত্র।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com