একদা জমিতে কোনও আইল ছিল না। যাযাবর মানুষ জমিতে আইলের কোনও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে নি। কৃষি আবিষ্কার করে মানুষ পশুচারণের যাযাবর জীবন অতিক্রম করে এবং জমি থেকে ফসল সংগ্রহের জন্যে স্থায়ী বসবাস গড়ে তোলা জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে পড়ে। ক্রমে গ্রামজনপদ থেকে নগর, এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠান পরিবার থেকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটে। একসময় সমাজে সম্পদের মালিকানা ছিল সামাজিক। ক্রমে সম্পদের সামাজিক মালিকানা ব্যক্তিমালিকানায় পরিবর্তিত হয় এবং জমিতে ব্যক্তিমালিকানা নিশ্চিতকরণে আইল অপরিহার্য হয়ে উঠে। অর্থাৎ আইলের উৎস জমিতে ব্যক্তিমালিকানা এবং এই ব্যক্তিমালিকানার অনিবার্যতা প্রকারান্তরে জমিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে বিভক্ত করে।
গত শনিবার (২১ নভেম্বর ২০২০) দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি সংবাদশিরোনাম ছিল, “কৃষির উন্নতিতে বড় বাধা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ড জমি”। এই শিরোনামের নীচে লেখা হয়েছে, “জমির আয়তন এতই ছোট যে সেখানে ট্রাক্টর ও কম্বাইন হারভেস্টরের মতো বড় কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের জো নেই। পদে পদে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয় সেচে, হয় না সারের সুষম প্রয়োগ। বছরের পর বছর ধরে এভাবেই চলছে দেশের কৃষি উৎপাদন। পারিবারিক ভাগ বাটোয়ারায় ছোট থেকে আরো ছোট হচ্ছে কৃষি খামারের আকার। ফলে বাড়ছে কৃষকের খরচ, কমছে শস্যের নিবিড়তা ও উৎপাদনশীলতা।” তারপর প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে বেশ লম্বাচওড়া একটি বয়ানবিস্তার করা হলেও আমাদের পক্ষে লম্বাচওড়া বাকবিস্তার করার এখানে কোনও অবকাশ নেই। মোটকথা মূল সমস্যা হলো, রাষ্ট্রের জমি বাড়ছে না কিন্তু প্রতিনিয়ত লোক বাড়ছে। সীমিত জমিতে অপ্রতিরোধ্য বর্ধিত লোকের খাদ্যসংস্থান করা রাষ্ট্রের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠছে। অর্থাৎ খাদ্যোৎপাদন বাড়াতে হবে। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষিজমিতে উৎপাদন বাড়াতে হলে বৃহৎ খামারিদের হাতে সব জমি ছেড়ে দিতে হবে এবং বিপরীতে ভূমিহীন বেকার কৃষকদেরকে শ্রমিক বানিয়ে দিতে হবে কারখানায় কর্মসংস্থান। অন্যথায় জমিতে ব্যক্তিমালিকানা তুলে দিয়ে সামাজিক কৃষিসমবায় পদ্ধতির প্রবর্তন করতে হবে। এই দুই পদ্ধতিতেই জমিতে আইল তোলে দেওয়া সম্ভব হবে এবং প্রকারান্তরে ‘কৃষির উন্নতিতে বড় বাধা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ড জমি’ এই সমস্যার থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে। বুঝাই যাচ্ছে, বর্তমানে কৃষিতে আইলের অস্তিত্বই সমস্যার মূল কারণ। দেশ উপর্যুক্ত দুই পদ্ধতির একটিকে অবশ্যই বেছে নেবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে জানিয়ে রাখা ভালো যে, সামাজিক কৃষিসমবায় হলো সাধারণ মানুষের পক্ষে অধিকতর মঙ্গলকর ও একটি বৈপ্লবিক পদ্ধতি।