মরে গেলে আমাদের সমাজ বলে, “আরো অনেকভাবে সমাধান করা যেত। মৃত্যুই একমাত্র সমাধান নয়”। আর বেঁচে থাকলে সমাজ বলে, “মানিয়ে নাও, মেনে নাও” মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সমাজ এই শিক্ষাই দেয়। মৃত্যুর পর চেহারা পালটে ফেলে। এতোই হিপোক্রেট আমাদের সমাজ।
প্রিয়াংকার হাসির আড়ালে, চোখে লুকিয়ে রাখা কান্না আমরা দেখেও দেখিনি। আমরা এতটাই যন্ত্রমানব। ‘পারিবারিক বিষয়’ বলে আমরা যে বিষয়গুলো ওর মৃত্যুর পর ধামাচাপা দিতে চাচ্ছি, সেই বিষয়গুলোই সাপ হয়ে আমাদের ছেলে-মেয়েকে দংশন করবে।
যখন নারীদের (ঘরের বউ) সমস্যার কথা বলতে শুরু করি, তখন অনেকেই আমাকে পুরুষ বিদ্বেষী আখ্যা দেন। বলেন, এখন গৃহে নারীর প্রতি হিংসাত্মক আচরণ অনেক কম। এসব নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। অনেক নারীও বলেন, আমার শাশুড়ি এতো ভাল, আমার ননদ এতো ভাল!! উনাদের আহ্লাদ দেখে মনে হয় দুনিয়াতে উনারাই শুধু আছেন। এর বাইরে আর কোন নারী নেই, আর কোন অসভ্য শ্বশুরবাড়ি নেই। উনারা ভুলে যান, সবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে তুলতেই নারীরা (ঘরের বউরা) আজকে এতদূর এসেছেন। চাকরি করছেন, ঘরের কাজ করছেন, বাচ্চা সামলাচ্ছেন। এখনো ঘরের মধ্যে নানাভাবে নারীরা নির্যাতিত, সে ডাক্তারই হোক বা ইঞ্জিনিয়ার।
আমি তখন অনেক ছোট, চুপচাপ ছিলাম খুব। মা রীতিমতো মারধর করতে করতে আমাকে কথা বলা শেখান। আমার এক মাসি ছিলেন। প্রিয়াংকার মতো উনিও শান্তশিষ্ট। বিয়ের পর মাঝেমধ্যে শ্বশুরবাড়ির দুয়েকটা অন্যায়ের কথা বলতেন। আমার মামার বাড়ি থেকে গিয়ে সমস্যা মিটমাট করে আসতেন মামারা। বিয়ের প্রায় সাত বছর পর মাসিমণি মারা যান। সুইসাইড বলছিল সবাই। কিন্তু এটা ছিল মার্ডার। বিয়ের পর শান্ত, মেধাবী মেয়েটাকে একটু একটু করে দমবন্ধ করে মেরে ফেলা। শুধুমাত্র দেহটা বেঁচে ছিল। সেই দেহ দিয়েছিল আগুনে আত্মাহুতি। একটা ছেলে ছিল মাসিমণিরও। মৃত্যুর পর একইভাবে সমাজ বলছিল, এটা কোন সমাধান নয়।
হ্যাঁ, এটাই ছিল ওদের জন্য সেরা সমাধান। কারণ ওদের কে আপনারাই শিখিয়েছেন, “মেয়েদের জোরে হাসতে নেই… মেয়েদের গলা যেন দুই হাত দূরে শোনা না যায়… মেয়েরা যেন ঘরের কথা পরকে না জানায়… মেয়েরা যেন পরকে আপন করে নেয়…. শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদের সাথে মিলেমিশে না চলতে পারলে দোষটা স¤পূর্ণভাবে মেয়েটার… মেয়েরা যেন মেনে নেয়… মেয়েরা যেন মানিয়ে নেয়… সংসারে দায়-দায়িত্ব সব বউয়ের, কিন্তু অধিকার দাবি করলেই সে বেয়াদব।”
যে বউ এসব শুনবে না তাকে নিয়ে আপনারা রসালো গল্প বানান। সন্ধ্যার আসর গরম করেন, “শুনেছো, অমুকের বউটা না…”।
ছেলেদের আপনারা শিখিয়েছেন, “বউ যদি অবাধ্য হয় গায়ে হাত তুলে হলেও তাকে থামাতে হবে… মা-বাবা হচ্ছেন ঈশ্বর, উনাদের কথার অবাধ্য হতে নেই… বৃদ্ধ মা-বাবা, অবুঝ ভাই-বোন যদি বউয়ের সাথে দুর্ব্যবহার করে, বউকে রাতে বিছানায় আদর করে বুঝিয়ে বলবে, যে তুমি ওর পাশে আছো, তাতেই মেয়েটা গলে গিয়ে সব মেনে নেবে… আর ছেলে যদি একমাত্র হয় তবে তো কথাই নেই, আরো কত শর্তারোপ…। শ্বশুরবাড়িতে যেতে নেই, শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে যত কম যোগাযোগ হবে ততই মঙ্গল, কি জানি ছেলেটা কোলছাড়া হয়ে যায়।”
যে ছেলে নিয়মগুলো মানবে না, তাকে আপনারা ত্যাজ্যপুত্র করবেন। স¤পত্তিচ্যুত করার ভয় দেখাবেন।
মাসিমণির জীবন নিয়ে এরকমই একটা গল্প লিখে ফেসবুকে পোস্ট করছিলাম ধারাবাহিকভাবে। একেকজনের গা জ্বলে যাচ্ছিল। সাফাই গাইতে ছুটে আসছিলেন তারা। আপনারা দ্বার বন্ধ করে দিয়ে যতদিন পর্যন্ত ভ্রমটাকে রুখতে চেষ্টা করবেন, সত্য ততদিন পর্যন্ত আপনাদের ঘরে ঢুকার রাস্তা পাবেনা।
আমি এখনো একটা মেয়ের চোখ দেখে বলতে পারি, সে সুখে নেই। আপনারা তার ঠোঁটের হাসি দেখে বিগলিত হন। আপনারাই সমাজ। আপনারাই নারীর প্রতি হয়ে যাওয়া অন্যায়ে অন্য নারীর সিংহভাগ হাত থাকে, সেটা এড়িয়ে যান। যে মা বউয়ের গায়ে হাত তোলায়, ছেলের হয়ে সাফাই গেয়ে বেড়ান, “বউ টা খুব অবাধ্য, হাত না তুললে থামানো যায়না” সেই মায়ের গায়েও ছেলেটা হাত তুলতে দু’বার ভাববে না। বোনের গায়েও হাত উঠতে পারে।
চিরন্তন সত্য কথাটাই আবার বলব, আপনারা মানুন বা না মানুন। একটা নতুন পরিবারে আসার পর বউটা অবশ্যই দুর্বল থাকে। কালের পরিক্রমায় যখন সে নিজের ছেলের বউ ঘরে আনে, সে হয়ে ওঠে, আহত বাঘ।
“দুর্বলের অত্যাচারের মতো জঘন্য জিনিস আর হয়না”। মা-বাবা বলেছেন বলেই ছেলেরা সব মানতে বাধ্য, এমন বিবেকহীন পশ্বাধম ছেলে যেন কারো জঠরে জন্ম না নেয়। অন্যায়ে মা-বাবাকেও ছাড় না দেওয়াই বিবেকবোধের পরিচয়। প্রায় সব অন্যায়কারীই কারো না কারো মা-বাবা। মাতৃত্ব বা পিতৃত্বকে ঈশ্বরের জায়গায় বসিয়ে দেয়া ভ-ামি।