সুনামগঞ্জ , শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ , ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
দুই দিনের রিমান্ডে ব্যারিস্টার সুমন দিরাই আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভা ধর্মপাশা কৃষি ঋণ কমিটির সভা এসএসসি’র টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করায় ছাত্রীর আত্মহত্যা জাউয়াবাজারে কৃষক দলের কমিটি গঠন ছাতকে গৃহবধূর আত্মহত্যা জনগণ যাতে সকল ক্ষমতার মালিক হতে পারেন তেমন দেশ গড়তে চাই : প্রধান উপদেষ্টা ধোপাজান-চলতি নদী : পথ বদলে চলছে বালু-পাথর লুট জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে প্রস্তুত আ.লীগ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা : শুনানি শেষ, রায় যে কোনো দিন অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতা দেবে স্পেন পথনাটক উৎসব উদ্বোধন জামালগঞ্জ উপজেলা জমিয়তের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত আজ সশস্ত্র বাহিনী দিবস পলাশ ইউপি চেয়ারম্যান সোহেল আহমদ কারাগারে মুজিববর্ষ উদযাপনে খরচ ১২৬১ কোটি টাকা পুলিশের নতুন আইজিপি বাহারুল আলম লাখে ২০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয় শিক্ষা কর্মকর্তাকে জামালগঞ্জে অগ্নিকান্ডে দুটি বসতঘর পুড়ে ছাই ধর্মপাশায় আসামি গ্রেফতার

মাজার, মৗঞ্জঝি থান, মাংরুদাম ও মব-মীমাংসা:পাভেল পার্থ

  • আপলোড সময় : ২৪-০৯-২০২৪ ০৯:১৩:৩৬ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২৪-০৯-২০২৪ ০৯:১৩:৩৬ পূর্বাহ্ন
মাজার, মৗঞ্জঝি থান, মাংরুদাম ও মব-মীমাংসা:পাভেল পার্থ
আমার শিক্ষাগ্রহণের একটা লম্বা সময় কাটে দেশের নানা মাজার ও দরগায়। বিস্ময়করভাবে দেশের মাজারগুলো গড়ে উঠেছে নদী অববাহিকার ব্যাকরণ আকুল করে। এক এক নদী অববাহিকায় এক এক তরুগুল্ম, পাখপাখালি আর জীবনপ্রকৃতি। আস্থা, বিশ্বাস, ভক্তি, ভেদজ্ঞান, বাহাস, পরমের সান্নিধ্য, শান্তি কিংবা দর্শন জানা অজানা নিযুত জীবনবিন্দু ছড়িয়ে থাকে মাজার জীবনে। বহু জন বহু কামনায়, বহু নির্জন অব্যক্ত দুর্লঙ্ঘ ইচ্ছা নিয়ে মাজারে যান। আমার কাছে স্থানীয় প্রকৃতি আর সংস্কৃতি পাঠের এক ছায়াময় শিক্ষালয় মাজার। ফকিরি জীবন থেকে আমার শেখা অনেক। বিশেষ করে বাস্তুতন্ত্র ও প্রতিবেশ সম্পর্ক নিয়ে জটিল সব জিজ্ঞাসার বিস্তার আমি এখানে জারি থাকতে দেখেছি। যার বিশাল অংশই আমার কাছে এখনো অধরা ও অজানা রয়ে গেছে, কেবলমাত্র আমার নিতান্ত ক্ষুদ্র জ্ঞান আর ‘আপাত বিলাসী’ জীবনবাস্তবতার কারণে। নিও-লিবারেল ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কত কায়দা নিয়ে নির্ঘুম কত টানটান বীক্ষা দেখেছি মাজারে। প্রবল এথনোপোসেন্ট্রিকতার বিরুদ্ধে সব প্রাণের প্রতি অবিস্মরণীয় সব দরদ আর মায়ার জগতের সন্ধানও আমাকে স্তব্ধ করেছে বহুবার মাজার পরিসরে। আমি মাজারে মানুষ নয়, মানুষের সঙ্গে বহু প্রাণের সহাবস্থান দেখে বড় হয়েছি। দেশের নানা প্রান্তে টিলা, পাহাড়, সমতল, চর, গড়, বরেন্দ্র, বিল, অরণ্য এমনকি জিরো পয়েন্টে মাজার ও ফকিরি জীবন আমার প্রতিবেশ-ব্যবস্থাপনা পাঠের অন্যতম বিদ্যাঞ্চল। জানি লাখো নিযুত মানুষের কাছে এই মাজার ও ফকিরি জীবনের আরও গূঢ় এবং প্রগাঢ় অসীম পাঠ ও বিস্তার আছে। কোনো বাইনারি বা কর্তৃত্ব দিয়ে মাজারকে দেখা ন্যায্যতার বাহাস নয়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর নানাভাবে যখন মাজার-দরগা আক্রান্ত হলো, চুরমার হলো চোখের সামনে শত জীবনের বিভা, কেবল মব-ট্রায়াল আর মব-জাস্টিস দিয়ে এই ক্ষয় জায়েজ হতে পারে না। যা ভাঙচুর হলো, রাষ্ট্র কি জানে আমরা কী হারালাম? কতটুকু হারালাম? এই ক্ষয়ক্ষতি কি কোনোভাবেই টাকা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব হবে? কারণ হামলার ভেতর দিয়ে মাজারবিরোধী এক প্রশ্নহীন হিংসা ও ঘৃণা প্রকাশিত হলো। যার কোনো ফয়সালা হলো না স্পিরিচুয়াল ও রাজনৈতিক কায়দায়। গণ-অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতা কিংবা জেন-জি প্রজন্ম জানল না গভীরতর তর্ক ও বিভেদের যন্ত্রণাগুলো কিংবা নানামুখী উসকানির সূত্রগুলো। আমরা জানি না কত প্রার্থনা, প্রার্থনার ধরন, গান, সৃষ্টিময়তা, দর্শন কিংবা জীবনবোধ এই সাম্প্রতিক হামলায় কতভাবেই না আহত ও নিখোঁজ হয়েছে। বহু ফকিরি জীবনে যে ট্রমা তৈরি হলো কোনো মায়াময় পরম স্পর্শ কি সেই ক্ষত সারাবে? বাংলাদেশে সচরাচর বাঙালি ও বৌদ্ধ-হিন্দুদের মন্দির-ধর্মালয় কিংবা খ্রিস্টানদের গির্জাতে হামলা হতে দেখি। ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং আদিবাসী বসতিতে হামলা এক প্রশ্নহীন অনিবার্য ডিসকোর্স তৈরি করলে মাজার-দরগায় এভাবে হামলা আমাদের কাছে নতুন প্রবণতা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। চলতি আলাপখানি মাজার-দরগা, মন্দিরসহ দেশের সব প্রান্তের সব স্পিরিচুয়াল, পবিত্র, ধর্মীয় প্রান্তিক পরিসরগুলোর মর্যাদা, সুরক্ষা, নিরাপত্তা এবং বিকাশ প্রার্থনা করে। একইসঙ্গে হামলা, চুরমার ও সংঘাতের তদন্ত ও ন্যায়বিচার দাবি করে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান আমাদের সামনে ইনক্লুশন এবং নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তের যে আকাক্সক্ষা হাজির করে সেখানে মাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত জ্ঞান ও জীবনধারা অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্ভুক্তি। নরম খোলের কচ্ছপ, কুমির বা প্রবীণ গাছেরা : দেশের যে মাজার-দরগাগুলোতে আমি গিয়েছি, প্রায় প্রতিটিকেই সব শ্রেণি-বর্গের মানুষের জন্য পাবলিক স্পেস হিসেবে দেখেছি। করপোরেট হাতছানি বা নিও-লিবারেল কনজিওমারিজম আমি খুব টের পাইনি। তবে আমাকে সর্বদা বিমুগ্ধ করেছে মাজারের প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণ দর্শন। বহু মাজার-দরগায় এত প্রবীণ গাছ আছে, যা দেশের প্রাকৃতিক ইতিহাসের জন্য খুবই গুরুত্ববহ। মাজার এলাকায় বহু পাখি, বানর, কাঠবিড়ালি, বাদুড়, সাপ, গুইসাপসহ বহু বন্যপ্রাণীর নিরাপদেই বিচরণ করতে দেখা যায়। এরা চিড়িয়াখানার মতো সর্বত্র বন্দি নয়। জীবনে প্রথম সিলেটে, হযরত শাহজালাল মাজারে প্রবীণ গজার ও জালালি কবুতরের ঢল দেখে আমার ঘোর কাটেনি বহু বছর। সিলেটের চাষণী পীরের মাজার বা টাঙ্গাইল রসুলপুরের জয়েনশাহী মাজারে বহু বানর নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যায়। চট্টগ্রামে বায়েজিদ বোস্তামির মাজারে নরম খোলের কালো কচ্ছপ আছে যা দেশে উন্মুক্ত জলাভূমিতে বিরল। বাগেরহাটের খানজাহান আলী (রহ.)-এর মাজারের ধলা পাহাড় আর কালা পাহাড় কুমিররা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সাক্ষী। বিশ্বাস ও লোকায়ত ব্যবস্থাপনার ভেতর দিয়ে কোনো বন্যপ্রাণের এই বিশেষ ধরনের এক্স-সিট্যু সংরক্ষণ আজ মুমূর্ষু দুনিয়ার জন্য এক সঞ্জীবনী বার্তা হাজির করে। বহু মাজারে বহু গাছ পবিত্র বৃক্ষ হিসেবে কিংবা বহু পুকুর ও জলাধার পবিত্র হিসেবে মানুষ সংরক্ষণ করে, প্রাণবৈচিত্র্য এবং বাস্তুতন্ত্র সবার জন্য সংরক্ষণের এই বীক্ষার কারণে মাজারে জারি থাকা প্রাণ-দর্শন চর্চার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল থাকা জরুরি। দুনিয়ার বৃহত্তম বাদাবন সুন্দরবনের মৌয়াল-বাওয়ালি- জেলেদের জীবনে মা বনবিবি এবং মাজারের প্রভাব বহুস্তরীয়। প্রতিবার মধু- গোলপাতা-মাছ আহরণ মৌসুমের আগে নানা কৃত্য পালনের পাশাপাশি নলতা রওজা শরিফে গিয়ে অনুমতি প্রার্থনা বনজীবীদের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ অরণ্য-বীক্ষা। মুন্সীগঞ্জ আড়িয়ল বিলে দেখেছি খোয়াজ খিজিরের নামে পানির জীবন সুরক্ষার মানতে নারী-পুরুষদের প্রার্থনার ঢল বেড়া ভাসান উৎসবে। দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও-সাভার-পঞ্চগড়ে গাছপীর, মানিকপীর, ঘোড়াপীর দরগাতে জীবনের মূর্ত-বিমূর্ত সব ব্যঞ্জনা দেখেছি। মাটির ঘোড়া কীভাবে বহু জীবনের পাওয়া-না পাওয়া কিংবা পাপ-পুণ্য প্রার্থনার গতিময়তা হয়ে উঠতে পারে শতবর্ষী করবী বা অশ্বত্থের তলায় মাটির ঘোড়ার স্তূপ দেখে বিস্মিত হয়েছি। বহু গান, কথা, ডাক ডিঠান, পই, প্রবাদ, নীতিকথা কত কী শুনেছি মাজারে। কৃষি উৎপাদন থেকে শুরু করে জেন্ডার, জীবনের বিকাশ থেকে ফানাফিল্লাহ অবস্থা কত কী অসাধারণ সব জিজ্ঞাসা। আমার বেশি দেখা হয়েছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর জীবনের মাজার ও ফকিরি বিদ্যাজগৎ। এ যেন এক বছরভর বিদ্যাকর্মসূচি। এই যাত্রা শুরু হয় নেত্রকোণার মদনপুরে শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমীর মাজার থেকে, এর বাদে আরও বহু দরগা ঘুরে এই যাত্রা শেষ হয় সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদীর তীরে মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে ‘হযরত শারফীনের মোকামে’। এই মোকামে শীতালং শাহ, দূরবীন শাহ, শাহ আবদুল করিম বা রাধারমণের অতি বিরল সব রচনা শুনেছি। জীবনের অতি উচ্চমার্গীয় সব আলাপ যা আমার কাছে এখনো অধরা এবং মানুষের মমতার গভীরতর উপলব্ধি কিছুটা হলেও এখানে আন্দাজ হয়েছে আমার। মাজার-দরগার জীবন, দর্শন, অনুশীলন আমাদের জানাবোঝা জরুরি। প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় এই জীবনদর্শন ও চর্চার অবদান আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে এক দারুণ বার্তা তৈরি করতে পারে। চুরমার ও অস্বীকৃত মৗঞ্জঝি থান : মান্দি সমাজের সাংসারেক ধর্মীয় দর্শন মতে, ‘দুনিয়ার সব কিছুরই কারণ থাকে, কারণ ছাড়া দুনিয়ায় কোনো কিছুরই সৃষ্টি কি উদ্ভব হয়নি।’ সমাজের যাত্রা ও রূপান্তর সম্পর্কে সম্যক ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখাই রাষ্ট্রের কাজ। কিন্তু রাষ্ট্র পুস্তকবিহীন ধর্মদর্শন এবং অনুশীলনকে স্বীকৃতি বা সুরক্ষা দিতে পারেনি। এমনকি এসব চিন্তাদর্শনকে অস্বীকার করেছে। রাষ্ট্র বা নাগরিক প্রতিক্রিয়া এসব নিয়ে কখনোই সরব হয়নি। শেরপুরের গজনী শালবনে অবকাশকেন্দ্র করার নামে কোচদের খাঙখাঙি পূজাস্থল চুরমার করে দেওয়া হয়েছে। উত্তরবঙ্গ জুড়ে প্রায়ই রাতবিরেতে সৗরি সারনা ধর্মপালনকারী সাঁওতালদের পবিত্র ধর্মস্থলগুলো ভেঙেচুরে দেওয়া হয়। সাঁওতাল গ্রামে মৗঞ্জঝি থান, বোঙ্গা থান ও জাহের থান খুব গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি সাঁওতাল, কোল, ওঁরাও, মুন্ডা বসতিতে কারাম বৃক্ষ খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দেখা গেছে দিনাজপুরের পার্বতীপুর বারকোনা গ্রামে এক প্রবীণ কারামবৃক্ষ ছাড়া দেশে আর প্রাচীন কারাম গাছ নেই। কারাম গাছ সংরক্ষণ করে নি¤œবর্গীয় বিশ্বাস ও অনুশীলন, রাষ্ট্র বা বন বিভাগ নয়। দেশ জুড়ে আদিবাসীদের এমনসব পবিত্র ধর্মস্থল যা মূলত কোনো না কোনোভাবে প্রাচীন কোনো গাছ, বনভূমি বা জলাধার তা দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে কোনো ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয় না। মৌলভীবাজারের মাধবকুন্ড জলধারার চারপাশ জুড়ে একসময় জেন্টিল খাসিদের কিছু ‘থাউ কিন্ন্যা বা থাউ রিইম (ধর্মীয় পবিত্র স্থান)’ ছিল। বন বিভাগের নানা উন্নয়ন প্রকল্প, ইকোপার্ক, বাণিজ্যিক পর্যটনের চাপে এসব ধর্মীয় স্থানের ‘পবিত্রতা’ বিনষ্ট হয়ে হারিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। কারণ বাঙালি জাত্যাভিমানে এসব কোনো ধর্মস্থল নয়, বনের অংশ বা প্রাকৃতিক স্থান, কারণ এসব ক্ষেত্রে কোনো স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করা হয় না। মাংরুদাম ও উন্নয়ন বলপ্রয়োগ : পৃথিবীর এক বিরল পত্রঝরা প্রাচীন বনভূমি বলসালব্রিং। রাষ্ট্র চিনে মধুপুর শালবন নামে। ১৯৫০ সাল থেকে এই বনের ওপর রাষ্ট্রীয় জুলুম জারি আছে। জুম আবাদ নিষিদ্ধকরণ, জাতীয় উদ্যান ঘোষণা, সংরক্ষিত বনভূমিতে চিড়িয়াখানা, উচ্ছেদ নোটিস, আগ্রাসী গাছের বাগান, রাবার বাগান, ইকোপার্ক, কৃত্রিম লেক খনন কিংবা আরবোরেটাম স্থাপন নানাভাবে এই বনে উন্নয়ন বলপ্রয়োগ করা হয়েছে। বন বিভাগ এই বনের ভেতর মান্দি বা গারোদের এক প্রাচীন মাংরুদাম বা শ্মশানে একটি আরবোরেটাম প্রকল্প হাত নিয়েছিল। বন বিভাগ বলেছে তারা প্রায় ৪,৮০০ গাছের চারা রোপণ করেছে। আরবোরেটাম এক ধরনের বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বাগান, যেখানে প্রাণ-প্রকৃতি ঘিরে শিক্ষা-বিনোদন-গবেষণা এবং সংস্কৃতি উপস্থাপন হয়। কিন্তু প্রাকৃতিক বনের চারদিকে ইটের দেয়াল তুলে ও ব্যারাক নির্মাণ করে প্রাচীন মাংরুদামের পবিত্র সত্তাকে বিনষ্টকরণের এই আজব আরবোরেটাম নামের প্রকল্পের বিরুদ্ধে আদিবাসীরা প্রতিবাদ জানিয়েছে। মধুপুর বনে প্রাচীন মাংরুদামগুলো গড়ে উঠেছিল গড়ের চালা বা উঁচু জমিনে। এগুলো সামাজিকভাবে পবিত্র এলাকা হিসেবে গণ্য। এসব এলাকায় সজারু, অজগর, গুইসাপ, উইঢিবি, মৌমাছি, চামড়াঝোলা ব্যাঙ, ময়ূর, হরিণ, চিতা, সর্পগন্ধা, শতমূলী, হস্তীকর্ণপলাশ, কুচ, বচ, দামবং এমন বিরল বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের সমাগম থাকত। মধুপুর মান্দি সমাজে সাংসারেক থেকে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তকরণের ফলে প্রাচীন মাংরুদামগুলো হারিয়ে যেতে থাকে। তারপরেও টিকে থাকা সাংসারেক ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে মাংরুদাম এখনো জীবন্তপবিত্র অঞ্চল। সাংসারেক বিশ্বাসমতে, মাংরুদাম বনেরই এক বিশেষ অংশমাত্র। এখান থেকে প্রাণের উদ্ভব ও ক্ষয় ঘটে এবং প্রাণশক্তির অবিনশ্বর রূপান্তর ঘটতে থাকে। কেবল মান্দি মাংরুদাম নয়; দেশে বাঙালি হিন্দু কিংবা আদিবাসী সমাজের শ্মশানের পবিত্র ভাব সর্বদা সুরক্ষিত থাকেনি। দখল, হামলা এবং জবরদস্তিমূলক নানা স্থাপনা কিংবা বাগান শ্মশানে করা হয়েছে। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে খাসি আদিবাসীরা বহু প্রাচীন জিংত্যাপ বা কবরভূমি ফেলে নিজেদের পুঞ্জি/বসতি অঞ্চল ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। বাঙালি, বন বিভাগ বা চা বাগানের নানামুখী চাপ ও বলপ্রয়োগের ফলে। সুন্দরবনের মুন্ডা আদিবাসীদের এখনো নিজস্ব কোনো শ্মশান বা সমাধিস্থল নেই। রাখাইন ভাষায় চানসাই মানে শ্মশানভূমি। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার টিয়াখালী ইউনিয়নের ছয়ানীপাড়ার দেড়শো বছরের প্রাচীন শ্মশান থেকে শুরু করে বরগুনার তালতলী উপজেলার নিশানবেড়িয়া ইউনিয়নের অংকুজান পাড়ার খাদ্যা সং চানসাই শ্মশান দখল হয়ে গেছে রাখাইনদের চোখের সামনে। একই অবস্থা পটুয়াখালীর কলাপাড়া থনজুপাড়া, মিশ্রীপাড়া, দিয়াড় আমখোলা পাড়া, কালাচাঁন পাড়া, তুলাতলী, নয়াপাড়া-বাবলাতলা, সোনাপাড়া, চৈয়পাড়া, হাড়িপাড়ার শ্মশানগুলোর ক্ষেত্রেও। কালাচাঁন পাড়ার ২৭ শতক জমির শ্মশানটি বেদখল বাঙালি ও রাষ্ট্রীয় আধিপত্যবাদের মাধ্যমে। বরগুনার তালতলী উপজেলা সদরের ২০০ বছরের প্রাচীন রাখাইন শ্মশানের এক একর ৩৩ শতক জায়গা জবরদখল করেছে এক প্রভাবশালী বাঙালি মুসলিম। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে আমরা রাষ্ট্র সংস্কারসহ বহু অমীমাংসিত জিজ্ঞাসাকে সামনে এনেছি। কোনো মব-ট্রায়াল বা মব-জাস্টিসের নামে কোনো নিপীড়ন ও অন্যায় কোনোভাবেই জায়েজ হয়ে যায় না। আমাদের মতামত ও প্রশ্ন থাকলে সেটি আমাদের প্রতিদিনের আলাপ বাহাসের ভেতর দিয়ে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বোঝাপড়ার ভেতর দিয়েই ফায়সালা হওয়া জরুরি। আমরা আশা করব সব মীমাংসা হবে, মাজার কিংবা ফকিরি মনে তৈরি হওয়া পুঞ্জ পুঞ্জ ট্রমা সারাতে রাষ্ট্র তৎপর হবে। লেখক: গবেষক ও লেখক

নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha

কমেন্ট বক্স