শহীদনূর আহমেদ::
দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঁচ দশমিক সাত মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। সকাল ১০টা বেজে ৩৮ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে এই ভূমিকম্প হয়। নরসিংদীর মাধবদীতে ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। ভূমিকম্পে হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। এদিকে সারাদেশের মতো সুনামগঞ্জেও ভূমিকম্পন অনূভূত হয়েছে। এই ভূমিকম্পে জেলার কোথাও কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
তবে তাহিরপুর উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়ন বালিয়াঘাট নতুন বাজারে ব্রিজের অ্যাপ্রোচে ফাটল দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
নতুন বাজার এলাকার বাসিন্দা মোশাহিদ তালুকদার জানান, ভূমিকম্পে বালিয়াঘাট ব্রিজের রাস্তায় ফাটল দেখা দিয়েছে। তবে এতে ব্রিজ বা রাস্তায় তেমন প্রভাব পড়েনি। সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। এদিকে ব্রিজের সংযোগ সড়কের চিড় ফাটা দেখা দিলেও সেটি ভূমিকম্পের কারণে হয়েছে কিনা তা শতভাগ নিশ্চিত নয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। এ বিষয়ে সরেজমিনে খোঁজ নিতে উপজেলা ইঞ্জিনিয়ারকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন। এদিকে পর পর ভূমিকম্পে সুনামগঞ্জ জেলাজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এর আগে ২১ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জ ও সিলেট এলাকায় মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়। যার উৎপত্তিস্থল ছিল ছাতকে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ও এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মুশতাক আহমেদ জানান, ভারতের আসাম, মেঘালয়, ডাউকি এলাকায় অনেকগুলো সক্রিয় ফল্ট রয়েছে। এসব ফল্ট প্রায়ই ঝাঁকুনি দিয়ে সরে যেতে চাচ্ছে। এতে প্রায়ই ছোট ছোট ভূকম্পন হচ্ছে। এতে বুঝা যায় বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভূতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ভূতত্ত্ববিদ ও খ্যাতনামা ভূবিজ্ঞানী এবং বর্তমানে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, আমার জীবদ্দশায় এমন ভূমিকম্প আগে অনুভব করিনি। শুক্রবারের ভূমিকম্প সামনের দিনের আরও বড় ভূমিকম্পের সতর্কবাণী দিচ্ছে। এখন থেকে সাবধান না হলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে। ভবিষ্যতে আরও বড় ভূমিকম্প হবে। যেটা আমরা ২০১৬ সাল থেকে বলে আসছি। তিনি বলেন, ভূতাত্ত্বিক গঠন অনুযায়ী বাংলাদেশ তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। বাংলাদেশের উত্তরে ইউরেশিয়ান প্লেট, পশ্চিমে ইন্ডিয়ান প্লেট এবং পূর্বে হচ্ছে বার্মা প্লেট। তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ইন্ডিয়ান ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। সেটি হচ্ছে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের হাওর হয়ে মেঘনা নদীর পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত। যদি সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের হাওরটা দেখেন, তাহলে দেখবেন যে এটি উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত এবং মেঘনা নদীতে এসে পড়েছে। এটি দিয়ে যদি একটি কাল্পনিক রেখা টানেন তাহলে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মেঘনা নদী হয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং আন্দামান দিয়ে বার্মা ও ইন্ডিয়ান প্লেটের সংযোগ ঘটেছে।
অন্যদিকে, এটির পূর্বে বার্মা প্লেট এবং পশ্চিমে ইন্ডিয়ান প্লেট অবস্থিত। ইন্ডিয়ান প্লেট সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও মেঘনা নদীর লাইন বরাবর বার্মা থেকে নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। যখন একটি প্লেট আরেকটি প্লেটের নিচে তলিয়ে যায় তখন আমরা বলি সাবডাকশন জোন। এ সাবডাকশন জোন সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন পর্যন্ত বিস্তৃত।
তিনি বলেন, পৃথিবীর যত বড় বড় ভূমিকম্প সবগুলোই এ সাবডাকশন জোনে সংঘটিত হয়েছে। জাপান, চিলি, আলাস্কায় বড় বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। সেখানে যে ভূতাত্ত্বিক কাঠামো (সাবডাকশন জোন), একই কাঠামো আমাদের বাংলাদেশে অবস্থিত। সাবডাকশন জোনের ভূমিকম্প খুবই ক্ষতিকারক।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আমাদের সাবডাকশন জোন এবং এর আশপাশের অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। সেই ভূমিকম্পগুলো ভূপৃষ্ঠের পরিবর্তন ঘটিয়েছে, নদী-নালার গতিপথের পরিবর্তন এনেছে।
১৭৬২ সালে আসাম ভূমিকম্পের ফলে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যমুনা নদী দিয়ে চলে যায়। আগে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়েই এ নদের বেশির ভাগ পানি প্রবাহিত হতো।
সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, আমরা কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ২০০৩ সাল থেকে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছি। যেহেতু বাংলাদেশ তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত এবং প্লেটগুলোর ত্রিমাত্রিক গতি নির্ণয় করার জন্য আমরা জিপিএস স্থাপন করি। এর মাধ্যমে আমরা ১৪ বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্লেটের গতির পরিমাপ নির্ণয় করি। প্রতিটি প্লেট এক স্থান থেকে আরেক স্থানে প্রতি বছর সরে যাচ্ছে। প্লেটগুলো কোন দিকে যাচ্ছে, দুটি প্লেটের সংযোগ বা পর¯পরমুখী যে গতি এবং সাবডাকশন জোনে প্রতি বছর কী পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে, সেটিও আমরা পরিমাপ করি। এগুলো পরিমাপ করে আমরা ২০১৬ সালে প্রতিবেদন প্রকাশ করি।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সিলেট থেকে কক্সবাজার অঞ্চলে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তিসম্পন্ন ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার মতো শক্তি জমা হয়ে আছে। যেকোনো সময় এ শক্তি বের হয়ে আসতে পারে। এ শক্তি একবারে বের হতে পারে আবার ধীরে ধীরেও বের হতে পারে। তবে, পৃথিবীর বিভিন্ন সাবডাকশন জোনে যেসব ভূমিকম্প হয়েছে, সেগুলো থেকে ৬৫ থেকে ৮০ ভাগ শক্তি একবারে বের হয়েছে। বাকিটা ধীরে ধীরে বের হতে থাকে। একই রকম অবস্থা আমাদের এখানে বিরাজ করছে।
উল্লেখ্য, সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ২, ৪ এবং ৫নং ওয়ার্ডকে ভূমিকম্পের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ২০১৯ সালে চিহ্নিত করেছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ন্যাশনাল রেজিলিয়েন্স প্রোগ্রাম। পৌরসভার অনুমোদন ছাড়া বিল্ডিং কোড না মেনে যত্রতত্র ভবন নির্মাণ, নিয়মনীতি না মেনে বহুতল ভবন নির্মাণ ও মাটির ধারণ ক্ষমতা পরীক্ষা না করে সনাতন পদ্ধতিতে বহুতল ভবন নির্মাণসহ একাধিক কারণে এই তিনটি ওয়ার্ডকে ভূমিকম্পে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
সুনামগঞ্জের পরিবেশ সংগঠক সালেহিন চৌধুরী শুভ বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে ভূমিকম্প প্রবন এলাকা হচ্ছে সিলেট, সুনামগঞ্জ অঞ্চল। এটি ঝুঁকিপূর্ণ ডাউকি ফল্টের মধ্যে পড়েছে। ১৭৯৭ সালে এই অঞ্চলে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প হয়। সুনামগঞ্জ জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এরপর আর বড় কোনো ভূমিকম্প না হওয়ায় আমাদের এই অঞ্চল ঝুঁকিতে রয়েছে। সুনামগঞ্জের মাটির তলদেশ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বিল্ডিংকোড না মেনেই পৌরসভার অধিকাংশ বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়েছে। হাওর-পুকুর ভরাট করে বহুতল ভবন করা হচ্ছে। শহরের রাস্তাগুলো প্রশস্ত নয়। তাই একটু বড় আকারের ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে। এখনো সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এ নিয়ে কাজ করবে এটি আমাদের বিশ্বাস।
এদিকে ভূমিকম্প বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রতি উপজেলায় কাজ করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
আরও বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা : ঝুঁকিতে রয়েছে সুনামগঞ্জ
- আপলোড সময় : ২২-১১-২০২৫ ০৭:২৫:০৪ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২২-১১-২০২৫ ০৭:২৯:৩০ পূর্বাহ্ন
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ

স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক সুনামকণ্ঠ