শামস শামীম, তাহিরপুর ঘুরে এসে::
তাহিরপুর উপজেলার দুর্গম সীমান্তের হাবেলি বা হাউলী রাজবাড়ি ও দুর্গটিই আজকের হাউলী রাজবাড়ি ও ব্রাহ্মণগাঁও দুর্গ।
এগুলো দেখতে শত বছর আগে পরিদর্শনে আসেন বিখ্যাত লেখক পদ্মনাভ ভট্টাচার্য্য। তার দেখার ২শ বছর আগেই এটি পরিত্যক্ত হয়। তিনি দেখতে এসে রাজবাড়ি ও দুর্গের নান্দনিকতা নিয়ে লিখেছিলেন ‘তবে গাঁথুনিরও তারিফ করিতে হয় প্রায় তিনশত বৎসর হইল এইগুলি নির্ম্মিত হইয়াছে এবং দুইশত বৎসর আন্দাজ পরিত্যক্ত অবস্থায় হিংস্র জন্তুর আবাস ভূমিতে পরিণত হইয়াছে এতাবৎকাল কেহ কোনওরূপ যত্নও করে নাই। তথাপি অনেকগুলি বিনাবলম্বনেও যে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে ইহাতে সূচিত হয় অতি পোক্তা গাঁথুনি এই সকলের ছিল।’ শ্রী পদ্মনাথ ভট্টাচার্য্য বিদ্যাবিনোদ এম.এ, প্রায় শত বছর আগে পণাতীর্থ দর্শনে এসে হাউলি রাজবাড়ি ও দুর্গ দেখে গিয়ে শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষদ পত্রিকার প্রথম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, কার্তিক ১৩৪৩ বাংলায় ‘লাউড় পরিভ্রমণ’ নামে গদ্য লিখেছিলেন। যাতে ক্ষয়িষ্ণু ভবনটির ধ্বংসাবশেষ তুলে ধরেছিলেন তিনি।
এই মনীষীর ৮৯ বছর পর প্রাচীন বাংলার ঐতিহাসিক এই স্থাপনা দেখতে গিয়ে তার ভগ্নদশার প্রকট রূপ দেখা গেছে। শত বছরের আক্ষেপ নিয়েই ভবনটি ঘুরে দেখা গেছে নান্দনিক এই স্থাপত্য এখনো আভিজাত্যের জানান দিচ্ছে। প্রাচীন পুরাকীর্তির প্রত্ন নিদর্শন যেন মাটি ফুড়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। অবহেলার সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটি দখলের লড়াই শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দখলবাজরা ছাত্র-জনতার নাম দিয়ে নতুন করে কিছু ভাঙচুর করেছে এবং দখল করে স্থাপনা বৃদ্ধি করেছে। সরকার প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ হিসেবে এটাকে গেজেটভুক্ত করলেও কর্তৃপক্ষের নজর নেই।
সরেজমিনে হলহলিয়া গ্রামে প্রবেশ করে দেখা যায়, প্রায় আড়াই ফুট প্রস্থের সীমানা দেয়ালের কিছু অংশ হলহলিয়া ও ব্রাহ্মণগাঁও রাজবাড়ির প্রবেশ মুখে এখনো সটান দাঁড়িয়ে আছে। প্রাচীন বাংলা ও সুলতানী আমলের পুরাকীর্তির জানান দিচ্ছে ক্ষয়িষ্ণু হাবেলি রাজবাড়ির দেয়ালটি। দীর্ঘ দেয়াল বিভিন্ন সময়ে ভেঙেচুরে চুরমার হওয়ার পর এখন অস্তিত্বই বিলীন। গ্রামের মাটির রাস্তায় পা ফেলে হাঁটতে গেলেই পায়ের নিচে ঠোকা দেয় প্রাচীন পুরাকীর্তির ইটসুরকি, হাঁড়ি-পাতিল ও মাটির তৈজসপত্রের প্রত্নবস্তুর অংশ। মূল্যবান প্রত্নবস্তু প্রতিদিনই বিনষ্ট হচ্ছে। সংরক্ষণের কোনও উদ্যোগ নেই। স্থানীয় লোভীদেরও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছেনা। তারা এটিকে মাটিচাপা দিতে পারলে যেন খুশি। কিন্তু সেই ‘শক্তপোক্ত’ স্থাপনার কাছে বারবার হেরে যাচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কয়েক শ’ বছরের পুরনো হলহলিয়া ও ব্রাহ্মণগাঁওয়ের হাবেলি রাজবাড়ি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের গেজেটভুক্ত সংরক্ষিত হলেও স্থানীয় মানুষদের অত্যাচারে ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এখন ক্ষয়ের পথে। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নান্দনিক পুরাকীর্তি রাজবাড়িতেও পড়েছে স্থানীয় দখলবাজ গোষ্ঠীর কোপ। তারা কিছুটা ভাঙচুর ও আলামাত নষ্ট করেছে। ভেঙে ফেলেছে প্রত্ন অধিদপ্তরের সরকারি অস্থায়ী অফিস। লুট করে নিয়ে গেছে মূল্যবান জিনিষপত্র। এর সঙ্গে নজরদারির অভাবে অবহেলা, অযত্ন ও আর উদাসীনতায় হারাতে বসেছে প্রোজ্জ্বল প্রাচীন প্রত্ন পুরাকীর্তিসমূহ।
হলহলিয়া ও ব্রাহ্মণগাঁও এখনো দুর্গম গ্রাম। গ্রাম দুটির পূর্বে মধ্যচর, পশ্চিমে উত্তর শ্রীপুর, দক্ষিণে হাওর ও উত্তরে সীমান্ত নদী পাটলাই। দুই গ্রামের মানুষের জন্য কোনও পাকা রাস্তা নেই। মাটির রাস্তায় তারা পাকা রাস্তার মতো ব্যবহার করছেন পুরাকীর্তির ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া ইট সুরকি, হাড়ি পাতিল ও মাটির তৈজসপত্রের ভাঙা অংশের শক্তপোক্ত নিদর্শনের কল্যাণে। ব্রাহ্মণগাঁওয়ের প্রবেশমুখেই আড়াই ফুট প্রস্থের রাজবাড়ির দেয়াল এখনো দেখা যায়। কয়েক কদম হাঁটার পর দেখা যায় গ্রামেরই বাসিন্দা দখলদার রুসমত আলী গত ৫ আগস্ট ‘ছাত্র-জনতার’ নাম ভাঙিয়ে প্রত্ন অফিসের ঘর ভাঙচুর করার পর সেখানে বীজতলা তৈরি করেছেন। পাশেই আরেক দখলদার আজমত আলী নতুন ঘর তৈরি করছেন। গত ৫ আগস্ট রাজবাড়ির পাশাপাশি যারা অবস্থান করেন তারা এসব ভাঙচুরে নেতৃত্ব দেন বলে জানান গ্রামবাসী। ১৯৭১ সালেও রাজবাড়ি ও দুর্গেও কিছু দুষ্কৃতকারী আঘাত করেছিল বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। ৫ আগস্টের পর নতুন করে অনেকে ঘর করার প্রস্তুতি নিয়েছে। অনেকে ঘর তৈরি করেছে। প্রত্ন অধিদপ্তর সুরক্ষার জন্য দেওয়া কাঁটাতারের বেড়াও তুলে নিয়েছে হামলাকারীরা। তুলে নিয়ে গেছে প্রত্ন অফিসের নলকূপটিও। সময়ে সময়ে রাজবাড়ির অবশিষ্ট অংশও ভাঙচুর করে নিজেদের সীমানা বাড়ানোর চেষ্টাও করছেন অনেক দখলবাজ। কোনওভাবেই তাদের থামানো যাচ্ছেনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ২০১৮ সালে গেজেটভুক্ত করে হলহলিয়া রাজবাড়ি ও ব্রাহ্মণগাঁও দুর্গটিকে। পরবর্তীতে কিছুটা সংস্কারকাজ করা হয়। ২০১৮ সনে খননকালে সংশ্লিষ্টরা জানান, হলহলিয়া ও ব্রাহ্মণগাঁয়ের স্থাপনা পাল আমলের। এটার উপর সুলতানী আমলের শাসকরা সংস্কার করেন। তাই স্থাপনার নিচের অংশ পাল আমলের এবং উপরের অংশ সুলতানী আমলের। এখান থেকে অর্থাৎ প্রাচীন বাংলার লাউড় থেকে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ কামরূপ ও প্রাগজ্যোতিষ্পুর শাসন করতেন। এই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দীর্ঘ সময় নিয়ে খনন করলে ইতিহাসের গুপ্তধন আবিষ্কৃত হতে পারে বলে তখন বলা হয়েছিল।
২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় হলহলিয়া দুর্গ ও রাজবাড়িকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে। পরে সামান্য থোক বরাদ্দে খনন কাজ শুরু হয়। এরপর ২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফা অনুসন্ধান ও খনন শুরু করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। খনন ও অনুসন্ধানের ফলে প্রতিদিনই প্রত্নবস্তু বের করে নিয়ে আসছিল। হলহলিয়া দুর্গে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধানে পাওয়া প্রাচীন সভ্যতার আবাসিক ভবনের ধ্বংসাবশেষ, একাধিক আধুনিক কক্ষের সন্ধান মিলেছিল তখন। দুর্গের প্রবেশপথে একটি অনন্য আবাসিক ভবনেরও অস্তিত্ব পেয়েছিল খননকারী দলটি। তাছাড়া খননকালে মাটির বিভিন্ন স্তরে পোড়ামাটির তৈরি বিভিন্ন ধরনের প্রত্নবস্তু উদ্ধার করেছিল। এই প্রত্নতত্ত্বটি সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত হওয়ায় সঠিকভাবে নিরবচ্ছিন্ন গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি হলেও পরবর্তিতে ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি।
অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি রচিত ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ ও শ্রী পদ্মনাথ ভট্টাচার্য্য বিদ্যাবিনোদ এম.এ, প্রায় শত বছর আগে পণাতীর্থ দর্শনে এসে হাউলি রাজবাড়ি ও দুর্গ দেখে গিয়ে শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষদ পত্রিকার প্রথম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, কার্তিক ১৩৪৩ বাংলায় প্রকাশিত ‘লাউড় পরিভ্রমণ’ লেখা এবং স্থানীয় ইতিহাসবিদদের মতে, সম্রাট আকবরের সময়ে লাউড়ের রাজা গোবিন্দ সিংহ ও তার ভাই বিজয় সিংহ বিরোধে জড়ান। ফাঁসির আদিষ্ট হয়ে বিজয় সিংহ বেঁচে গেলে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে লাউড়ে চলে আসেন এবং সম্রাট আকবরের বশ্যতা মেনে নেন। ওই সময়ই লাউড়ের এলাকা হলহলিয়ায় দুর্গ নির্মাণ করেন। এটাই হাউলি বা হলহলিয়া দুর্গ। যা এখনো টিকে আছে বলে মনে করেন তারা। লাউড় পরিভ্রমণে সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ‘দিব্যসিংহ খৃষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে লাউড়ের শাসনদ- পরিচালনা করিয়াছিলেন। এই নৃপতির বহু পুরুষ আগেও লাউড় একটী সমৃদ্ধ রাজ্য বলিয়া গণ্য ছিল। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে দিব্যসিংহ ছাড়া পূর্ব্বে (এবং পরেও) আর কোন রাজার নাম পর্যন্ত জানা যায় না।’ অদ্বৈতের পিতামহেরও পূর্ব্ববর্ত্তী শ্রীপতি নাম জনৈক বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ লাউড়ে আসিয়া বাস করিয়াছিলেন।’ দিব্যসিংহের পরেও তার বংশধর লাউড়ে আরো শত বছর লাউড় শাসন করেন। তিনি ওই প্রবন্ধে আরো লিখেন, ‘খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে প্রাচীন লাউড় রাজ্য ও রাজধানী নবগ্রাম খাসিয়াদের উপদ্রবে বিধ্বস্ত হয়। রাজ্যের অধিবাসীরা অধিকাংশই পলাইয়া প্রাণরক্ষা করে। বানিয়াচংয়ের আদি রাজা কেশব মিশ্রের অধস্থন ষষ্ঠ পুরুষ গোবিন্দ নামধেয় রাজকুমার কনিষ্ঠ হইলেও অতি সাহসী ও পরাক্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বানিয়াচংয়ের কতিপয় বীরপুরুষ সমভিব্যাহারে লাউড়ে আসিয়া খাসিয়াদিগকে তাড়াইয়া দিয়া সেই স্থানে দুর্গাকারে একটি বাটিকা নির্ম্মাণ করিয়া বসতি করিলেন’। এই দুর্গই ব্রাহ্মণগাঁও দুর্গ হিসেবে এখনও পরিচিত। যার ধ্বংসাবশেষ এখনো আছে।
শ্রী পদ্মনাথ ভট্টাচার্য্য এর ওই লেখায় হাউলী রাজবাড়ি ও ব্রাহ্মণগাঁও দুর্গ সম্পর্কে আরো জানা যায়। তিনি লিখেন, ‘গোবিন্দ নিজকে তিনি এতই পরাক্রান্ত মনে করিতে লাগিলেন যে মুসলমান বাদশাহের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরাজিত- হইবেন না। প্রথমতঃ সামান্য দু একটা যুদ্ধে বিজয় লাভ করিলেও পরিশেষে ধৃত ও দিল্লীতে নীত হইয়া তিনি বাদশাহ কর্ত্তৃক প্রণদ- প্রাপ্ত হইলেন। আত্মীয়গণের চেষ্টায় ও কৌশলে তাঁহার প্রাণ রক্ষা হইল - কিন্তু তাঁহাকে মোসলমান ধর্ম্ম গ্রহণ করিতে হইল - তিনি তদবধি ‘হাবিব খাঁ’ নামে সংজ্ঞিত হইলেন। কথিত আছে তিনি বাদশাহ পরিবারের একটী মহিলার পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং ফিরিবার সময়ে বহু সম্ভ্রান্ত ও বিক্রান্ত - মোসলমানকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলেন। হবিব খাঁ তাঁহার রাজ্য লাউড়ের বাস বাটিকা বা হাবিলীরÑতথা সেই রাজ্যের খুবই শ্রীবৃত্তি সাধন করিয়াছিলেন।’ ধর্মান্তরিত হাবিব খাই এটা নির্মাণ করেন বলে ওই লেখায় ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অষ্টাদশ শতাব্দিতে লাউড়ের এই হাবেলি বা হাউলি রাজবাড়ি ও দুর্গ পরিত্যক্ত হয় খাসিয়াদের উপদ্রবে। ১৮৯৭ সালে প্রবল ভূমিকম্পের সময় ওই রাজবাড়ি ও ব্রাহ্মণগাঁও দুর্গ নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল বলে লেখায় উল্লেখ করেন তিনি। তোরণঘেঁষা ভগ্ন দেয়ালটি সম্পর্কে তিনি লিখেন, তোরণের সংলগ্ন ভগ্ন দেওয়ালটীর --- প্রায় দুই হাত এবং দেখিয়াছি যে চূণ সুরকি ইটের মাঝে ছোট ছোট পাথরও রহিয়াছে। নহবৎখানা ছাড়াইয়া আরো দু একটির ভগ্নাবশেষ-দর্শনান্তে আমরা কিছুদূর গিয়া একটী দালান দেখিলাম ইহা বোধহয় বৈঠকখানা ছিল। ছাদ ভীষণ ভাবে ফাটিয়া গিয়াছে তবে দেওয়ালগুলি দাঁড়ানই রহিয়াছে। আমার সঙ্গী দুইজন উভয়েই একাধিক বার এই ধ্বংসাবশেষ দেখিয়া গিয়াছিল; ইহাদের বাচনিক এবং অপরের মুখেও দুইট দর্শনীয় জিনিষের কথা শুনিয়াছিলাম এক মহিলা দিগের গোসলখানা ইহা নাকি অভগ্নাবস্থায়ই দন্ডায়মান রহিয়াছে এবং ইহার কারুকার্য্যও নাকি মনোহর; অপর ভূগর্ভস্থ দুর্গ যাহাতে ৫০০ শত সৈনিক থাকিতে পারিত।’ এই হাবেলীর পাশে ব্রাহ্মণগাঁও ছাড়া আরো বসতি ছিল নাগারচী পাড়া, নাপিত পাড়া, প্রভৃতি কতই কি ছিল কিন্তু সমস্তই অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে। কেবল হাবিলীটি শোচনীয় অবস্থায় টিকিয়া রহিয়াছে।’ ওই প্রবন্ধে তিনি লিখেন,‘ এখনও যাহাতে এই প্রাচীন কীর্ত্তির সম্পূর্ণ বিলোপ না হওয়ায় ব্যবস্থার জন্য সম্প্রতি প্রত্ন-বিভাগের কর্ত্তৃপক্ষের নিকট আবেদন একটী করা হইয়াছে দেখা যাউক ফলাফল কি হয়।’ শত বছর আগে প্রত্ন অধিদপ্তরকে লেখা হয়েছিল। শত বছর পরে আবারও আবেদনের প্রেক্ষিতে তালিকাভুক্ত হলেও ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই।
সরেজমিনে গ্রাম দুটিতে গিয়ে দেখা যায় ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানাযায়, প্রাচীন এই পুরাকীর্তি সরকার গেজেটভুক্ত করার পর পঞ্চাশের দশকে ভাগ্যন্বেষনে আসা নরসিংদী, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহের বসতি স্থাপনকারীরা খননের সময় বাধা দিয়েছিলেন এবং মানববন্ধনও করেছিলেন। এই লোকজনই এবার গত বছরের ৫ আগস্ট সংস্কারকৃত পুরাকীর্তিতে আঘাত করেছেন এবং সরকার নির্মিত অফিস স্থাপনা ভাঙচুর করেছেন। সংস্কারকৃত জীর্ণ ভবনগুলোতেও পড়েছিল হাতুড়ি ও শাবলের আঘাত। কিন্তু ‘শক্তপোক্ত’ থাকায় তারা আর ভাঙতে পারেনি। এখন নতুন করে প্রাচীন ভবনের চারপাশ নতুন স্থাপনা, বৃক্ষরোপণসহ নানাভাবে আড়াল করে দিয়েছেন ভবন লাগোয়া বাসিন্দারা। সুরক্ষার জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক নির্মিত কাঁটাতারের বেড়াও তুলে ফেলেছেন। এলাকাবাসী জানান, খননের শুরু থেকেই সংরক্ষণের বিরোধিতা করে আসছেন পার্শ্ববর্তী বসতিরা। দেখা গেছে, দুটি ভবনের মধ্যে হলহলিয়া রাজবাড়িঘেঁষা মৃত আলী হোসেন, রহমত আলী, মরম আলী, আতাউর রহমান, শামায়ুন মিয়া, নাসির মিয়াসহ কয়েকজনের বাড়ি। তারা ভবনের দেয়ালঘেঁষে অবকাঠামো ক্ষতি করে নিজেদের বসতঘর তৈরি করে নিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। ৫ আগস্টের পর নতুন করে সম্প্রসারণ করছেন তারা। পাশের ব্রাহ্মণগাঁও গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রাচীন দুর্গটি বনে ঢাকা পড়েছে। তবে মাথা উঁচু করে এখনো ঐতিহ্যের জানান দিচ্ছে। এই ভবনের পাশে গেদু মিয়া, কাইয়ুম মিয়ার বসতঘর। দুর্গের স্থাপনা ও অবকাঠামো বিনষ্ট করে বিভিন্ন সময়ে তারা নিজেদের বসতি করেছেন। দুর্গের পাশে নতুন করে তাহের উদ্দিন ও রুসমত আলী স্থাপনা করার চেষ্টা করছেন। সরেজমিনে আরো দেখা যায়, ইটের তৈরি হলহলিয়া নান্দনিক ভবনটির মেঝের গর্তে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। ভবনের সামনেই সম্প্রতি টিনশেডের একটি ঘর ওঠেছে। ভবনের গায়ে শ্যাওলা জমেছে। ভবনটির আশপাশে আরো ছোট ছোট দুর্গ ও প্রাচীন আলামত আভিজাত্যের প্রোজ্জ্বল চিহ্ন এখনো আছে। মূল্যবান প্রত্ননির্দশন প্রতিদিনই বিনষ্ট হচ্ছে এবং অবশিষ্ট প্রত্ননির্দশন হুমকিতে আছে।
হলহলিয়া গ্রামের কিশোর আজিম শাহ বলেন, ‘কয় বছর আগে রাজবাড়ি ঠিকঠাক করায় সুন্দর হইছিল। হাসিনা ভাগার পর মাইনসে আইয়া আবার ভাঙচুর করছে।’ একই কথা জানান, হলহলিয়ার হালেমা খাতুন ও মুসলিমা আক্তার। তাদের স্বজনরা ভাঙচুর ও হামলায় জড়িত থাকলেও তারা জানান, ‘ছাত্র জনতা’ হামলা করেছে। হালেমা খাতুন (৭৫) ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে জানান, ‘১৯৭১ সালেও রাজবাড়ি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আমি সংগ্রামের আগে বউ হয়ে আসার পর দেখেছি ভবনটি অনেক সুন্দর। তখনো ভবনে আবাসিক কক্ষ, দুর্গও সুন্দর ছিল। অনেক মাটির জিনিষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। এখন আর এসব নাই’। তার নাতি বউ ও রাজবাড়ির দেয়ালঘেঁষা ঘরের বাসিন্দা মুসলিমা আক্তার বলেন, ৫ আগস্ট ‘ছাত্র-জনতা’ ভাঙছে। আমরা দেখছি। কেউ বাধা মানছেনা। তার ঘর রাজবাড়ির মূল ভবনের পাশে হলেও কেন তারা বাধা দিলেন না জানতে চাইলে তিনি কোনও উত্তর দেননি।
’ ব্রাহ্মণগাঁও গ্রামের দুর্গের ভবন লাগোয়া ঘরের মালিক আঞ্জু মিয়ার ছেলে মো. সোহেল মিয়া বলেন, ‘সরকারের ঘর, টিউবওয়েল, জিনিষপত্র নিয়ে গেছে ভাঙচুরকারীরা। এই ভাঙচুরে তার স্বজনরা জড়িত থাকলেও তিনি অস্বীকার করে বলেন, এসব করেছে ‘ছাত্র-জনতা’।
গ্রামের ইউপি সদস্য ও বিএনপি নেতা রুপন মিয়া বলেন, ‘এই প্রত্নসম্পদ আমাদের গর্ব। এটা দেখার জন্য মাঝে মধ্যে আমাদের দুর্গম গ্রামে বিখ্যাত মানুষেরা আসেন। কিন্তু কিছু অবুঝ মানুষ এটাকে ধ্বংস করতে চান। ৫ আগস্টও তারা ভাঙচুর করেছে। তখন আমি এলাকায় ছিলাম না। এলাকায় থাকলে আমি এটা হতে দিতাম না।
প্রত্নতত্ত্ব অধিপ্তরের প্রথম খননকালের নেতৃত্বদানকারী ড. আতাউর রহমান বলেন, সরকারিভাবে এই দুটি ভবন তালিকাভুক্ত হওয়ায় সঠিকভাবে নিরবচ্ছিন্ন গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এখানকার প্রাচীন পটভূমি নতুন করে জানা যাবে। তিনি বলেন, হলহলিয়া ও ব্রাহ্মণগাঁও দুর্গই ছিল প্রাচীন বাংলার লাউড়ের কার্যালয়। এটির মাধ্যমে ঐতিহাসিক অঞ্চলকে প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যটন আরো বিকশিত হবার সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। আরো অধিকতর খনন ও অনুসন্ধানের দীর্ঘমেয়াদী কাজ হলে প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসও উন্মোচিত হবে। খননকালে প্রাচীন আবাসিক সুসজ্জিত কক্ষের নমুনা এবং প্রবেশ পথে পোড়ামাটির মূল্যবান প্রত্ন সম্পদ পেয়েছিলেন বলে জানান তিনি।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সিলেট অঞ্চলের ফিল্ড অফিসার মা. সাইদ ইনাম তানভিরুল বলেন, ৫ আগস্টের পর আমাদের প্রত্ন অধিপপ্তরের তৈরি অফিসঘর ভাঙচুরের বিষয়টি আমরা শুনেছি। তবে শীঘ্রই আমার পরিদর্শনে এসে নতুন করে সংরক্ষণ ও সুরক্ষার ক্ষেত্রে কি করা যায় চিন্তা-ভাবনা করবো। তিনি নতুন আসায় এ বিষয়ে বিস্তারিত জানেননা বলেও জানান।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেদী হাসান মানিক বলেন, হলহলিয়া ও ব্রাহ্মণগাঁও দুর্গ ও রাজবাড়ি সরকারের সম্পদ। এখানে নতুন করে হামলা হয়েছে কি-না আমার জানা নেই। তবে বিষয়টি আমরা খোঁজ নিয়ে দেখবো এবং সংরক্ষণে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবগত করবো।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
ধ্বংস হচ্ছে স্থাপনা-প্রত্নবস্তু
প্রাচীন বাংলার হাবেলি দুর্গ ও রাজবাড়ি দখল হচ্ছে প্রতিদিন
- আপলোড সময় : ২৬-১০-২০২৫ ০৮:৪৬:১০ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৬-১০-২০২৫ ০৯:১৮:৩৭ পূর্বাহ্ন
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ

স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক সুনামকণ্ঠ