বঙ্গভঙ্গ ও সিলেট-ভঙ্গ
- আপলোড সময় : ২১-১০-২০২৫ ০৭:৫৬:২০ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২১-১০-২০২৫ ০৭:৫৬:২০ পূর্বাহ্ন
মোহাম্মদ আব্দুল হক ::
বর্তমান ভারতের করিমগঞ্জ জেলা সিলেটের ছিল। এখানে আছে বঙ্গভঙ্গ ও সিলেটের দুঃখগাঁথা। দীর্ঘ লেখায় পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে, তাই সংক্ষিপ্ত। ১৫৭৬ খ্রিস্টিয় সালে মুঘল সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে সুবা বাংলা শুরু। পলাশীর যুদ্ধ হয় ১৭৫৭ খ্রিস্টিয় সালে এবং এরপর সুবা বাংলা ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর আমরা ব্রিটিশ-ভারত বললে ব্রিটিশ শাসিত ভারত উপমহাদেশের কথা বুঝি। ব্রিটিশরা রাস্তা ও যা-কিছু অবকাঠামো উন্নয়ন করেছে তা তাদের স্বার্থের জন্য। তবে ব্রিটিশরা যে নির্বিঘ্নে তাদের শাসন চালিয়েছিলো তা নয়। তারা দীর্ঘ প্রায় দুইশো বছর বাংলা তথা ভারত শাসন করতে গিয়ে সবসময়ই ক্ষমতা হারানোর ভয় তাদেরকে তাড়িত করতো। সেজন্যে তারা বঙ্গভঙ্গসহ নানান রকম পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা শুধু বাংলায়ই ফকির বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, ফরায়েজি আন্দোলন এবং সিপাহী বিদ্রোহ মোকাবেলা করেছে। সেসব অনেক দীর্ঘ ইতিহাস। এখানে আমরা সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বঙ্গভঙ্গ ও সিলেট প্রসঙ্গে বেশি মনোযোগ দিতে সচেষ্ট থাকবো।
সিলেটের মানুষ ঐতিহাসিক ভাবে পূর্ব বঙ্গের মানুষ, ঐতিহাসিক ভাবে বাংলার মানুষ। কিন্তু বঙ্গভঙ্গের চাকায় পিষ্ট হয়ে সিলেট হয়েছে দ্বিখ-িত। ভারত উপমহাদেশের ‘বঙ্গভঙ্গ’ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে হলে প্রথমে মনে রাখতে হবে এই উপমহাদেশের সবচেয়ে বড়ো প্রদেশ ছিলো ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি’ বা ‘বাংলা প্রেসিডেন্সি’, এটি বাংলা, বিহার, ছোট নাগপুর ও উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত ছিল। এখন আসি বঙ্গভঙ্গের আলোচনায়। তখন ওই বাংলা প্রেসিডেন্সি প্রদেশের শাসনভার একজন গভর্নর বা ছোটলাটের উপর ছিল। আয়তনের দিক বিবেচনায় বর্তমান সময়ের তুলনায় তখন লোকসংখ্যা অনেক কম হলেও ১৮৬৬ খ্রিস্টিয় সালে উড়িষ্যায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সে সময়ে ব্রিটিশ সরকার দুর্ভিক্ষের কারণ অনুসন্ধানে একটি কমিটি গঠন করে। তখন ওই কমিটির অনুসন্ধানে উঠে আসে বিশাল আয়তনের প্রদেশ চালানোর ক্ষেত্রে প্রশাসনিক নানান রকম অসুবিধার কথা। এতো বড়ো আয়তনের একটি প্রদেশ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা সত্যি সত্যিই খুব কষ্টকর ছিল। তাই বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা শেষে এক সময়ের বড়লাট লর্ড কার্জন বাংলা প্রেসিডেন্সি ভেঙ্গে ছোট করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এরই প্রেক্ষিতে সেই সময় বিশাল আয়তনের এক প্রদেশ বাংলা প্রেসিডেন্সি বিভক্ত করে দুটি প্রদেশে ভাগ করা হয়। একটি প্রদেশ হয় ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিভাগ ও আসাম নিয়ে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশ এবং তখন এর রাজধানী স্থাপন করা হয় ঢাকা, আর অপর প্রদেশ হয় পশ্চিম বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে যা ‘পশ্চিম বাংলা’ প্রদেশ এবং রাজধানী তখন কলকাতাতেই। ইতিহাসে ইহা-ই বঙ্গভঙ্গ, যা ১৯০৫ খ্রিস্টিয় সালের ১৬ই অক্টোবর বাস্তবায়িত হয়েছিল। এভাবে বঙ্গভঙ্গের ফলে এ অঞ্চলের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিপরীত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ্য হয়। মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানালেও হিন্দুরা বিরোধিতা করে। তুমুল আন্দোলনের ফলে মাত্র ছয় বছরের মধ্যে ১৯১১ খ্রিস্টিয় সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছে। সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষকগণের কথায় উঠে এসেছে সেই যে বঙ্গভঙ্গ হয়েছিল এতে বাংলা অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এর প্রভাব পড়েছিলো বহুদূর বিস্তৃতি নিয়ে। একটা ইতিবাচক দিক পরিলক্ষিত হয়, ঐতিহাসিক ওই বঙ্গভঙ্গের ফলে বাংলার মুসলমানরা অধিকার সচেতন ও অধিকার বিষয়ে আরও অধিক সোচ্চার হয়ে উঠে।
‘বঙ্গভঙ্গ’ ও ‘বঙ্গভঙ্গ রদ’ নিয়ে ইতিহাসের দিকে গভীর মনোযোগ দিলে দেখা যায় বঙ্গভঙ্গ হয়েছে দুইবার। প্রথম ভঙ্গ যা ১৯০৫ খ্রিস্টিয় সালের তা ঠেকানো গেলেও দ্বিতীয় বারের ভঙ্গ মারাত্মক ক্ষত তৈরি করেছে এবং আর ঐক্য সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়বার বঙ্গভঙ্গ হয় ১৯৪৭ খ্রিস্টিয় সালে। আমরা ব্রিটিশ শাসনের অধীনে যে এক ভারত দেখি সেই ভারত ভাগ হয়ে ব্রিটিশ শাসন থেকে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের মাধ্যমে দ্বিতীয় বারের মতো চূড়ান্ত বঙ্গভঙ্গ হয়। এখানে বর্তমান স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের সময়ে এসে ভারত ভাগের ঐতিহাসিক আলোচনায় সিলেট অঞ্চল খুবই প্রাসঙ্গিক। ১৯৪৭ খ্রিস্টিয় সালের ৩ জুন ভারতের শেষ গভর্নর লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন তৎকালীন মুসলিম লীগ, কংগ্রেস ও শিখ নেতাদের সাথে বৈঠক করে জানান ভারত ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হবে। এতে অনেকের অবিভক্ত বাংলার আশা ভঙ্গ হলো। তখন দুই দেশের সীমানা নির্ধারণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ভারতে সম্পূর্ণ নতুন স্যার সিরিল রেডক্লিফের হাতে। ভারতের সবকিছুতে অনভিজ্ঞ রেডক্লিফ কমিশন যাচাই-বাছাই শেষে ১২ আগস্ট যে ‘রেডক্লিফ লাইন’ নকশা প্রকাশ করে তাতে করিমগঞ্জসহ সিলেটের সাড়ে তিন থানাকে ভারতের সাথে যুক্ত দেখানো হয়। গণভোটে সংখ্যা গরিষ্ঠ হয়েও করিমগঞ্জ হারানোর ওই নকশায় মুসলিম লীগ এবং পূর্ব বঙ্গের মানুষ ক্ষুব্ধ হলেও বিতর্কিত ওই সিদ্ধান্তে আমাদের সিলেট ভাগ হয়ে যায়।
এখানে একটু পিছন থেকে আসতে হবে। অতীতের সিলেট জেলা ছিলো সিলেট সদর, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও করিমগঞ্জ মহকুমা নিয়ে এক বন্ধনে। ভারত ও পাকিস্তান দুই ভাগে বিভক্তি যখন চূড়ান্ত তখন সিলেট অঞ্চল নিয়ে ভিন্ন চিন্তা করতে হয়েছে। উল্লেখ করতেই হবে, ১৯৪৭ খ্রিস্টিয় সালের ৬ ও ৭ জুলাই গণভোট হয়েছিল সিলেট ও করিমগঞ্জ কোন দিকে যাবে ভারত নাকি পাকিস্তানে। এটিই ছিল ‘সিলেটের রেফারেন্ডাম’ বা ‘সিলেটের গণভোট’ নামে খ্যাত। তখনকার রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের নেতারা পাকিস্তানের পক্ষে সিলেটে সভা-সমাবেশ করেছেন জোরালে ভাবে। গণভোটে সিলেট ও করিমগঞ্জ পাকিস্তানের পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু দুঃখজনক এক অধ্যায় এখানে দেখতে হয়েছে। জানা যায়, গণভোট পরবর্তী ১৪ থেকে ১৭ আগস্ট তারিখ পর্যন্ত করিমগঞ্জের মানুষ পাকিস্তানের পতাকা উড়ায়, কিন্তু রেডক্লিফের নকশায় ১৮ তারিখ থেকে করিমগঞ্জ ভারতের সাথে যুক্ত করা হয়। সেদিন থেকে সেখানে আবার ভারতের পতাকা উড়ে। এভাবেই সমগ্র সিলেট আর এক থাকতে পারেনি। করিমগঞ্জকে আলাদা করার মাধ্যমে আমাদের সিলেটের ব্যবচ্ছেদ করা হয়। আমি এই ঘটনাকে ‘সিলেট ভঙ্গ’ বলি। আহা! ব্রিটিশরা আমাদের সিলেটকে আলাদা করে দিলো। হাজার হাজার মানুষকে ছিন্নমূল করে দিলো। অনেক অনেক মানুষ তাদের নিজের জায়গা সম্পত্তি হারিয়েছে। যারা ছিল এক, তাদের অনেক মানুষ এরপর তাদের নিজেদের আত্মীয়-স্বজন থেকে আলাদা হয়ে যায়। অথচ করিমগঞ্জ ঐতিহাসিকভাবে বৃহত্তর সিলেট হিসেবে পরিচিত।
জানা আছে, ১৮৭৮ খ্রিস্টিয় সালে যখন সিলেট পৌরসভা গঠিত হয় সে সময় থেকে করিমগঞ্জ সিলেটের একটি মহকুমা। করিমগঞ্জ কিন্তু বেশি দূরে নয়। বর্তমান সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কুশিয়ারা নদীর ওপারে শহর করিমগঞ্জ। এই করিমগঞ্জ আয়তনেও বেশ বড়ো, প্রায় ১৮০৯ বর্গকিলোমিটার। আমাদের বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য রম্যলেখক সৈয়দ মুজতবা আলী জন্মেছিলেন করিমগঞ্জে। তাই সিলেটে সাহিত্য আসরে সৈয়দ মুজতবা আলী প্রসঙ্গে আলোচনা হলে করিমগঞ্জের কথা উঠে আসে। পরবর্তী পরিস্থিতিতে পাকিস্তান থেকে এক রক্তাক্ত সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গ যা পরে পূর্ব পাকিস্তান সেটি ১৯৭১ খ্রিস্টিয় সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ হয়েছে। এখন সিলেট বাংলাদেশের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগ।
ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ‘বঙ্গভঙ্গ’ ভারত ও বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বিষয়। এর প্রভাব অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে এবং আজও বাঙালি জাতি এর ভার বহন করে চলেছে। ‘বঙ্গভঙ্গ’ যেমন নিজেই ঐতিহাসিক এক শব্দ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে ব্রিটিশ ভারতের সময় থেকে, তেমনি সাতচল্লিশের ভারত ভাগের সময়ে ‘সিলেট-ভঙ্গ’ সিলেটের মানুষের কাছে এক দুঃখের ইতিহাস। তাই সিলেটের মানুষের কাছে, বৃহৎ পরিসরে বাংলাদেশের মানুষের কাছে বঙ্গভঙ্গের ইতিহাসের আলোচনায় সিলেট প্রসঙ্গ উঠে আসে বারবার। এখানে যারা ইতিহাস পড়েন তারা জানেন বঙ্গভঙ্গ ও সিলেটের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। হ্যাঁ, ইতিহাসের পাঠ থেকে জানা দরকার আজকের বাংলাদেশে কেমন করে সিলেটের মানুষ নিজস্ব মতামত প্রদান করে অর্থাৎ গণভোটে পছন্দের রায় দিয়ে তৎকালীন ভারতের আসাম প্রদেশ থেকে নিজেদেরকে চাপিয়ে দেয়া শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছিল। স্বীকার করতে হবে বৃহত্তর সিলেট থেকে করিমগঞ্জ হাত ছাড়া হয়ে যাওয়া সিলেটের মানুষের জন্য ‘সিলেট-ভঙ্গ’ নামক এক ক্ষত। এ বিষয়টি শত শত বছরের শিকড় সংশ্লিষ্ট এক বেদনাদায়ক অধ্যায়। এখানে সিলেটের মানুষের দুঃখগাঁথা আছে স্মরণীয়। আলোচনার প্রসঙ্গটি অনেক দীর্ঘ হওয়ার দাবি রাখে, কিন্তু এখানে পরিসর স্বল্পতায় আলোচনা সংক্ষিপ্ত। পরিশেষে বলা যায় বঙ্গভঙ্গ যেমন বাংলাকে একেবারে খ-িত করেছে, তেমনি করিমগঞ্জ ভারতের সাথে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে সিলেটের বিরাট অংশ আমরা হারিয়েছি যা খুবই দুঃখজনক।।
[লেখক : মোহাম্মদ আব্দুল হক, কলামিস্ট ও কথাসাহিত্যিক]
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ

সুনামকন্ঠ ডেস্ক