স্টাফ রিপোর্টার::
সম্প্রতি সুনামগঞ্জে যাদুকাটা নদীতে বালু লুটের ঘটনায় পৃথক মামলা দায়ের করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর ও ইজারাদার। মামলা দায়েরর পর থেকে বিভিন্ন মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। বালু লুট ঠেকাতে আন্দোলনকারী একাধিক ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে বালু লুটের মামলায় আসামি করা হয়েছে। নিরপরাধ প্রতিবাদী ব্যক্তিদের আসামি করায় পরিবেশ অধিদপ্তর, সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ ও ইজারাদারদের ঘোর সমালোচনা করেছেন পরিবেশবাদীরা। বালু লুটের মামলার ৩৬ নাম্বার আসামি করা হয়েছে আলী হোসেন (২৪) নামের এক প্রতিবাদী যুবককে। আলী হোসেনের বাড়ি যাদুকাটা নদীর তীরের লাউড়েরগড় গ্রামে। এই তরুণ পেশায় আলোকচিত্রী, থাকেন ঢাকায়। ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে এসেছিলেন বাড়িতে। এ সময় যাদুকাটা নদীতে বালু লুটের ঘটনা শুরু হলে সেটির ভিডিও ও ছবি নেন। এসব ছবি ও ভিডিও পাঠান গণমাধ্যমকর্মীদের। তাঁর তোলা বালু লুটের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। অথচ অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগে একটি মামলায় আসামি করা হয়েছে আলী হোসেনকে।
জানা যায়, যাদুকাটা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ঘটনায় গত দুই দিনে জেলার তাহিরপুর থানায় দুটি মামলা হয়েছে। একটি করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর, অন্যটি করেছেন ইজারাদার। দুই মামলায় আসামি করা হয়েছে ৮৮ জনকে। অজ্ঞাতনামা আসামি আছেন ৫০ জনের মতো। দুটি মামলাতেই ৬ থেকে ১১ অক্টোবর নদীর লাউড়েরগড় এলাকায় জড়ো হয়ে নদীর পাড় কেটে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগ করা হয়েছে। ইজারাদারের পক্ষে করা মামলার আসামির তালিকা নিয়ে বেশ সমালোচনা হলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলায় আসামির তালিকায় এই নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীসহ আলোচিত বেশ কয়েকজনের নাম আছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোহাইমিনুল হক বৃহস্পতিবার তাহিরপুর থানায় মামলাটি করেন। এই মামলায় ৩৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ২০ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় উপজেলার সোহালা গ্রামের বাসিন্দা তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও স্থানীয় বাদাঘাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আফতাব উদ্দিন, তাঁর বড় ভাই উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক রাখাব উদ্দিন, উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা বিশ্বজিৎ সরকার, নদী তীরের বাসিন্দা মোশাহিদ আলম ওরফে রানু মেম্বারের নাম আছে। রানু মেম্বার একই অভিযোগে এর আগে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই মামলায় ৩৬ নম্বরে আছে আলোকচিত্রী আলী হোসেনের নাম। মামলায় আলী হোসেনকে আসামি করায় সৃষ্টি হয়েছে সমালোচনা। তবে আলী হোসেন আসামি হওয়ায় নিজেই হতবাক মামলার বাদী পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মোহাইমিনুল হক। ভুল তথ্যের কারণে এমনটা হয়েছে বলে জানান তিনি। আলী হোসেন ব্যতীত বাকি আসামি বালু লুটের সাথে জড়িত থাকার সত্যতা রয়েছে বলে জানান তিনি।
আলী হোসেন বলেন, আমি বালু লুটের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। সবাইকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করলাম। মামলার বাদী পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাও নদী তীরে দাঁড়িয়ে আমার কাছ থেকে তথ্য নিয়েছেন, এখন দেখি আমিই আসামি। আমি বিস্মিত, হতবাক। গত বুধবার একই অভিযোগে থানায় আরেকটি মামলা করেন মোশারফ হোসেন নামের এক ব্যক্তি। তিনি যাদুকাটা-১ বালু মহালের ইজারাদার মো. নাছির মিয়ার আত্মীয়। এই মামলায় ৫১ জনের নাম উল্লেখসহ আরও ৩০ জন অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছেন। এই মামলার ৩৮ আসামি বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এই মামলায় বালু উত্তোলনবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকা ব্যক্তি ও তাদের স্বজনদের আসামি করা হয়েছে। আবার পাড় কাটায় যুক্ত অনেকের নাম আসেনি। নদীর তীরের ঘাগটিয়া গ্রামের বাসিন্দা কাসমির রেজা দীর্ঘদিন থেকে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। তিনি পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি। এবারও নদীতে বালু লুটের ঘটনা শুরু হলে তিনি প্রতিবাদ করেন। অথচ এই মামলায় তার ভাই আস্তারুল ইসলামকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় এলাকার নারজেল, পারভেজ ও মাসুদ রানা নামের তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। তারা পাড় কাটার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত ছিল বলে অনেকেই জানিয়েছেন। কাসমির রেজা বলেন, কার যোগসাজশে, কারা বালু লুট করে এটা তো এলাকাবাসীর জানা। তাই মামলায় আসামি করে, হুমকি দিয়ে কোনো কাজ হবে না। আমাদের প্রতিবাদ অব্যাহত থাকবে।
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্য মোহাম্মদ রাজু আহমেদ বলেন, প্রশাসন, মামলায় বালু লুটের সাথে জড়িত অনেককেই আসামি করা হয়নি। কেউ কেউ রয়েছেন যারা প্রতিবাদ করেছেন তাদেরকে আসামি করা হয়েছে। এমনটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। প্রতিবাদ করে আসামি হলে আগামীতে লুটের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলবে না। আমরা মনে করছি অসৎ উদ্দেশ্যে নিরপরাধ মানুষকে আসামি করা হয়েছে।
মামলায় নিরপরাধ ব্যক্তি আসামি করা হয়েছে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে ইজারাদার নাছির মিয়া বলেন, স্থানীয় সাংবাদিক ও গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া তথ্যসহ স্থানীয় নির্ভরযোগ্যদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে যারাই ঘটনায় যুক্ত ছিলেন তাদের মামলায় আসামি করা হয়েছে। আন্দোলনকারী বা প্রতিবাদকারী কাউকে উদ্দেশ্য করে মামলা করা হয়নি।
এ ব্যাপারে তাহিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, মামলা অভিযুক্ত করায় আসামি করা হয়েছে। তবে নিরপরাধ কেউ থাকলে তদন্তে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। যারা দোষী নন, তারা বাদ যাবেন। দোষী অথচ এজাহারে নাম সেই তদন্তে এমন কাউকে পাওয়া গেলে তিনিও যুক্ত হবেন। তবে নির্দোষ কেউ হয়রানির শিকার হবেন না।
উল্লেখ্য, তাহিরপুর উপজেলার যাদুকাটা নদীর দুটি বালু মহাল এবার ১০৭ কোটি টাকায় ইজারা হয়েছে। তবে মামলা সংক্রান্ত জটিলতায় গত পাঁচ মাস বালু উত্তোলন বন্ধ ছিল। চলতি মাস থেকে বালু উত্তোলন শুরু হয়।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
বালু লুটের অভিযোগে মামলা,আসামির তালিকায় প্রতিবাদকারীদের নাম
- আপলোড সময় : ১৮-১০-২০২৫ ১২:১৩:৫৫ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৮-১০-২০২৫ ০৭:৩৯:৪৩ পূর্বাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ