মোস্তফা কামাল::>
সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ গোটা দেশ নির্বাচনমুখী। আন্তর্জাতিক বিশ্বও এ নিয়ে অপেক্ষমাণ। বিশেষ করে ঢাকার পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের ব্যস্ততা স্পষ্ট। এর আগে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সনদ। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ থেকে শুরু করে যেখানেই যাচ্ছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হচ্ছে তা নিশ্চিত করছেন। তার কথায় সবাই আস্থা রাখছেন। নির্বাচনের পর নতুন সরকারের হাতে দায়িত্ব দিয়ে, বিশ্বম-লে নেমে পড়বেন আগের কাজে। আন্তর্জাতিক বিশ্বে তার অনেক দায়িত্ব। স্বদেশের ক্রান্তিকালে তিনি দেশবাসীর ডাকে সাড়া দিয়ে, এক বছরের বেশি সময় ধরে সরকারের দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের যে সময় ২০২৪-এর জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর সৃষ্টি হয়েছিল, তখন তিনি দায়িত্ব নিয়ে সেই জটিল সময় পার করে দিয়েছেন। এতে তিনি ব্যক্তিগতভাবে এবং বিশ্বপরিম-লে সময় দিতে পারেননি। বিদায়ের পর ড. ইউনূস আবার হবেন আন্তর্জাতিক বিশ্বের মানুষ। হিসাব মোটামুটি এমন। কিন্তু, আকস্মিকভাবে এর ফাঁকে ঢুকে পড়েছে নতুন সাবজেক্ট। সামনে এসেছে তার সরকারের কয়েক উপদেষ্টার সেফ এক্সিট প্রসঙ্গ। খানিকটা এলোমেলো বিক্ষিপ্ত দৃশ্যায়ন। যেখানে দু-তিনদিনের মধ্যেই সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় সই হতে যাচ্ছে জুলাই সনদ। একে জাতির আরেকটি দলিল হিসেবে ভাবা হচ্ছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি হিসেবে অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অনুষ্ঠানে থাকবেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধি। এমন একটা আবহের মধ্যে অনির্ধারিত জোর আলোচনা অন্তর্বর্তী সরকারের সেফ এক্সিট নিয়ে। টেনে আনার মতো প্রসঙ্গটার সূচনা করেছেন এ সরকার থেকে এক্সিট নিয়ে আসা একজন উপদেষ্টা এনসিপি প্রধান নাহিদ ইসলাম। কেমন হয়ে গেল ব্যাপারটা! এর আগে বিভিন্ন সময় কয়েকবার কোনো কথা বা মন্তব্য থেকে সরলেও, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের কারও কারও সেফ এক্সিটের চেষ্টা নিয়ে ছোড়া অভিযোগ থেকে সরছে না জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি। এ নিয়ে চলছে তোলপাড়। আলোচনা-সমালোচনা তুঙ্গে। গণমাধ্যমে নানা সংবাদ ও বিশ্লেষণ। স্যোশাল মিডিয়ায় অন্তহীন ন্যারেটিভ। সঙ্গে নানা গুজব-গুঞ্জন। এতে উপদেষ্টা কেন, যে কারোরই খামোশ না হয়ে পারা যায় না। বিশেষ করে, উপদেষ্টাদের মধ্যে এ নিয়ে যিনি বেশি কথা বলবেন, তিনিই মার্কিংয়ে পড়বেন। কী বলে ফেঁসে যাবেন। কারণ এ অভিযোগ করা এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলাম কারও নাম বলেননি। কাজেই বেশি প্রতিক্রিয়া দেওয়া মানে ‘ঠাকুর ঘরে কে?’ অবস্থা হওয়ার ঝুঁকি। এরপরও আইন, স্বরাষ্ট্র, পরিবেশসহ কয়েকজন উপদেষ্টা প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। পরিবেশ এবং পানিস¤পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘উপদেষ্টারা সেফ এক্সিট খুঁজছেন, নাহিদ ইসলামের এমন বক্তব্য তাকেই প্রমাণ করতে হবে।’ আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সেফ এক্সিট খোঁজার দরকার নেই জানিয়ে বলেছেন, ‘বরং দেশকে একটি সুন্দর এক্সিট দেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা।’ একদিকে অভিযোগ যেনতেন নয়, আবার জবাবও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। নাহিদ ইসলাম অভিযোগটা ছুড়েছেন একদম প্রকাশ্যে। ‘উপদেষ্টাদের অনেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে ফেলেছেন, তারা নিজেদের সেফ এক্সিটের কথা ভাবছেন’ একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথাও বলেছেন, ‘উপদেষ্টাদের কেউ কেউ আখের গুছিয়ে নিয়েছেন।’ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক দফা ঘোষণা করেছিলেন সে সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। অভ্যুত্থান পরর্বর্তী সরকারে তিনি তথ্য উপদেষ্টা ছিলেন। গত ফেব্রুয়ারিতে সরকার থেকে পদত্যাগ করে এনসিপির আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন। কারও কারও অপেক্ষা আছে, নাহিদ কখন ওইসব উপদেষ্টার নাম জানাবেন? সেইসঙ্গে জানাবেন তারা কে কী আখের গুছিয়েছেন? এমন অপেক্ষার মধ্যে এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, ‘কিছু উপদেষ্টার মধ্যে দেখা যাচ্ছে, তারা কোনোভাবে দায়সারা দায়িত্ব পালন করে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এক্সিট নিতে পারলেই হলো। এই দায়সারা দায়িত্ব নেওয়ার জন্য অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি সরকার কাজ করতে পারে না। তারা এত শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে ওখানে আছেন। তারা এমনটা করে থাকলে দেশের মানুষের সামনে মুখ দেখাতে পারবেন না। যারা এ ধরনের চিন্তা করেন, তাদের জন্য মৃত্যু ছাড়া কোনো সেফ এক্সিট নেই। পৃথিবীর যে প্রান্তে যাক, বাংলাদেশের মানুষ তাদের ধরবে। অভিযোগ বিবেচনায় সারজিসের কথার তেজও কম নয়। এ পর্যায়ে এসে নাহিদ-সারজিসদের বড় ভাই গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ স¤পাদক রাশেদ খান কয়েক উপদেষ্টার জোগসাজশের কথা বলেছেন। যারা বিতাড়িত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন বলে দাবি তার। তার ভাষায় ‘শেখ হাসিনার সঙ্গে পাঁচজন উপদেষ্টা হাত মিলিয়েছেন। তারা শেখ হাসিনার সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। অভিযোগ বিচারে তা আরও মারাত্মক। অভিযোগ বা মন্তব্যের এ কাতারে শামিল হয়েছেন এখনো সরকারে থাকা স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তার কথার মার একটু ভিন্ন। একাধিক দেশের পাসপোর্টধারীরাই অন্যদের সেফ এক্সিটের তালিকা করছে বলে কথার মারপ্যাঁচ দিয়েছেন তিনি। নিজের ফেসবুক পেজের এক পোস্টে এ মন্তব্য করে পোস্টে আসিফ মাহমুদ লেখেন, যারা ৫ আগস্ট পালিয়েছিল, তাদের সিমপ্যাথাইজাররা কষ্টে মরে যাচ্ছে। বারবার ফ্যাসিস্টদেরই পালাতে হবে। আমাদের জন্ম এদেশে, মৃত্যুও এদেশের মাটিতেই হবে ইনশাআল্লাহ। ফ্যাসিস্ট, খুনিদের সঙ্গে লড়তে লড়তে আমার ভাইদের মতো শহীদী মৃত্যু কামনা করি। উপরোক্ত এসব কথা একসঙ্গে করলে মানে ভালো দাঁড়ায় না। রীতিমতো এটা উদ্বেগজনক। এর মধ্যেই এখন সনদ সইয়ের অপেক্ষা। যদিও সনদ বাস্তবায়নের উপায় এখনো চূড়ান্ত করেনি কমিশন। সনদ বাস্তবায়নে গণভোট নিয়ে ঐকমত্য থাকলেও গণভোটের ভিত্তি, সময় ও পদ্ধতি নিয়ে মতবিরোধ আছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই পর্বের আলোচনায় ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে কিছু প্রস্তাবে কোনো কোনো দলের ভিন্নমত আছে। এই ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। প্রথম পর্বে ৩৩টি এবং দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দল আলোচনায় অংশ নেয়। তবে সংবিধান-স¤পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের পাঁচ দিন আলোচনা হলেও ঐকমত্য হয়নি। তার ওপর রয়েছে গণভোটের বিষয়। সরকারের কাজের ভলিউম কেবল বড় হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশে গণভোট একেবারে নতুন নয়। তবে এবার ঝামেলা-যন্ত্রণা বেশি। প্রেক্ষিতও ভিন্ন। বাংলাদেশে প্রথম গণভোট হয় ১৯৭৭ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের অনুসৃত নীতি ও কর্মপন্থার প্রতি মানুষের আস্থা আছে কি না এই প্রশ্নে। মূলত নিজের পদকে বৈধ করার জন্য জিয়াউর রহমান এই গণভোটের আয়োজন করেছিলেন। দ্বিতীয় গণভোট হয়, ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ রাষ্ট্রপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অনুসৃত নীতি ও কর্মসূচির প্রতি আস্থা এবং স্থগিত সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হওয়া পর্যন্ত তার রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকায় জনগণের সম্মতি আছে কি নেই এই প্রশ্নে। এরশাদও নিজের ক্ষমতার বৈধতা দেওয়ার জন্য সেই গণভোটের আয়োজন করেন এবং স্বভাবতই ভোটের ফলাফল তার পক্ষে যায়। তৃতীয় গণভোট হয়েছে ৯১ সালে। তখন অল্প সময়ের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার ছিল। ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন) বিল, ১৯৯১-এ রাষ্ট্রপতির সম্মতি দেওয়া উচিত কি না এই প্রশ্নে। প্রথম দুটি গণভোটের সঙ্গে তৃতীয় গণভোটের মৌলিক পার্থক্য ছিল যে এই ভোট রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমতায় টিকে থাকার বৈধতার জন্য নয়, বরং গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য। তখন এ নিয়ে কঠিন অবস্থা হয়নি। তবে এবার অবস্থা ও পরিস্থিতি কঠিনের চেয়েও কঠিন। ৭৭ আর ৮৫-তে হ্যাঁ-নাতে কাজ হয়ে গেছে। ৯১ সালে স্বৈরাচারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ছিল বেশ আন্তরিক। এবার দৃশ্যত আন্তরিকতা আছে। মুখ দেখাদেখিও হচ্ছে। কিন্তু ভেতরে জটিলতা, বাগড়া, চিকন বুদ্ধির চর্চা খুব বেশি। তা নির্বাচন, গণভোট, সনদ সবকিছু নিয়েই। আগের তিনটি গণভোটের ফলাফল নিরঙ্কুশভাবে সরকারের পক্ষে গেছে। সরকার যে ফলাফল চেয়েছে, গণভোটের ফলাফলে তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। এবার এককথায় সব বলে দেওয়ার অবস্থা নেই। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে গণভোট আয়োজন করতে একটি অধ্যাদেশ জারির ‘মতামত’ পেতে গত ৮ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা শেষ হয়। এখন ১৭ অক্টোবর সনদ স্বাক্ষরের অপেক্ষা। জুলাই সনদের মতো একটি বড় ডকুমেন্ট বা রাজনৈতিক দলিল যার সবগুলো ধারা ও অঙ্গীকারে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি; যে সনদের অনেক বিষয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন। অবশ্যই এ সনদের অনেক ধারাই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য জরুরি। কিন্তু, স্পষ্টতাও দরকার। সনদের ধারাগুলোর বেশ কটি রাজনৈতিক বিতর্কে ঘেরা। সাধারণ মানুষের অস্পষ্ট। ব্যাখ্যাও অজানা। তাই স্পষ্টতা ছাড়া গণভোট একটু প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়। তারপরও আশাবাদী হতে সমস্যা নেই। আশা না থাকলে, অপেক্ষাই বা কেন? লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
সনদ-ঐক্য-ভোটের বাঁক, রাজনীতিতে দুর্বিপাক
- আপলোড সময় : ১৫-১০-২০২৫ ০৮:৪৩:০৮ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৫-১০-২০২৫ ০৮:৪৩:৫৯ পূর্বাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ