সুনামগঞ্জ , শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫ , ১৮ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
‎জামালগঞ্জে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো দুর্গাপূজা দেখার হাওর ঢেকে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে উকিলপাড়ায় পাইপলাইনের লিকেজ থেকে গ্যাস নির্গমন : দুর্ঘটনার আশঙ্কা দুর্গাপূজা : মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য পূজামন্ডপ পরিদর্শন করলেন সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি ৩ ফার্মেসিকে ৭ হাজার টাকা জরিমানা পথে যেতে যেতে: পথচারী সুনামগঞ্জ পৌর শহরে স্পিডব্রেকারগুলো যেন মরণফাঁদ! ‎জামালগঞ্জে 'উন্নতি সঞ্চয় ঋণদান সমবায় সমিতির' শিক্ষা উপকরণ ও  বস্ত্র বিতরণ সুনামগঞ্জে 'ধর্ষণ মামলায়' আসামিদের শাস্তির দাবিতে পরিবারের সংবাদ সম্মেলন নির্বাচনের প্রস্তুতি অনেক এগিয়ে নিয়েছি : সিইসি আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস পালিত যৌতুক না পেয়ে স্ত্রীকে হত্যায় স্বামীর মৃত্যুদন্ড আজীবন জনগণের সেবা করতে চাই : পাবেল চৌধুরী ফার্মেসিতে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে ‘ফিজিশিয়ান স্যাম্পল’ সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জামালগঞ্জে জগন্নাথ জিউর মন্দির পরিদর্শনে এমপি প্রার্থী মাহবুব সীমান্তের ৩৫ পূজামন্ডপে বিজিবি’র বাড়তি সতর্কতা, ৮ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন শিগগিরই গঠন হচ্ছে নতুন ২ বিভাগ ও ২ উপজেলা মহাসড়কে অটোরিকশা ও ইজিবাইক চলাচল বন্ধ করতে হবে

ফার্মেসিতে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে ‘ফিজিশিয়ান স্যাম্পল’

  • আপলোড সময় : ২৯-০৯-২০২৫ ০১:২০:৩১ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২৯-০৯-২০২৫ ০১:২৬:৫১ পূর্বাহ্ন
ফার্মেসিতে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে ‘ফিজিশিয়ান স্যাম্পল’
তানভীর আহমেদ::
সুনামগঞ্জের বিভিন্ন ফার্মেসিতে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে চিকিৎসকদের জন্য নির্ধারিত ফিজিশিয়ান স্যাম্পল বা নমুনা ঔষধ
নিয়ম অনুযায়ী, ঔষধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো নতুন ঔষধ বাজারজাত করার আগে ডাক্তারদের মাধ্যমে এর কার্যকারিতা, নিরাপত্তা, এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যাচাই করার জন্য ফিজিশিয়ান স্যাম্পল বা নমুনা ঔষধ দিয়ে থাকে। এর মাধ্যমে ডাক্তাররা রোগীদের সেই ঔষধ ব্যবহার করে ঔষধটি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে রোগীদের জন্য এটি সুপারিশ করা হবে কিনা, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু ঔষধ কোম্পানিগুলোর কিছু অসাধু প্রতিনিধি ও ডাক্তারদের মাধ্যমে তা চলে আসছে ফার্মেসিগুলোতে। আর ফার্মেসিতে তা বিক্রি হচ্ছে সাধারণ ঔষধের মতোই। এতে একদিকে যেমন রোগী ঠকছে, তেমনি জনস্বাস্থ্যের জন্যও তৈরি হচ্ছে বড় ঝুঁকি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সুনামগঞ্জ শহরের বিভিন্ন ফার্মেসির পাশাপাশি জেলার ১২টি উপজেলা ছোট-বড় হাটবাজার থেকে শুরু করে গ্রামের অলিগলির ফার্মেসিতেও অবাধে বিক্রি হচ্ছে চিকিৎসকদের জন্য নির্ধারিত ফিজিশিয়ান স্যাম্পল বা নমুনা ঔষধ। বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা চিকিৎসকদের কাছে যে নমুনা ঔষধগুলো দেন, তার গায়ে স্পষ্ট করে লেখা থাকে ‘ফিজিশিয়ান স্যাম্পল’, ‘Not for sale' বা নমুনা ঔষধ। এই ঔষধগুলো সাধারণত নতুন বাজারে আসা কোনো ঔষধের প্রচারণার জন্য সরবরাহ করা হয়। চিকিৎসকদের এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখার জন্য এবং গরীব ও অসহায় রোগীদের বিনামূল্যে দেওয়ার জন্য এটি একটি নৈতিক ব্যবস্থা।
কিন্তু সুনামগঞ্জের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। অনেক ফার্মেসিতেই বিভিন্ন নামে ফিজিশিয়ান স্যাম্পল সংগ্রহ করে রাখা হয়। একই সাথে ক্রেতাভেদে সেগুলো চড়া দামে বিক্রি করা হয়।
সম্প্রতি, বেশ কয়েকটি ফার্মেসি ঘুরে দেখা যায়, ঔষধগুলো বিক্রয়যোগ্য মোড়কে রাখার পর অনেক ফার্মেসির আঙিনায় কিংবা মেঝেতে বিভিন্ন প্রকার ফিজিশিয়ান স্যাম্পল ঔষধের ‘বিক্রি নিষিদ্ধ’ মোড়ক ফেলে রাখা হয়েছে।
এছাড়া একাধিক ফার্মেসিতে ক্যালসিয়াম জাতীয়- অস্টোক্যাল ডি ৫০০ মি.গ্রা. ও জিংক বি- এর বোতল ফার্মেসীর থাক বা র‌্যাকে সারিবদ্ধভাবে রেখে বিক্রি করতে দেখা যায়। একেকটি জারে ১০টি করে ট্যাবলেট আছে। এছাড়াও বিভিন্ন নামের যেমন- ইসোরাল মাপস ২০মি.গ্রা.; টাফনিল; মিউরিন ৫০০ মি.গ্রা.; জিথ্রক্স ৫০০ মি.গ্রা.; রক্সিম- ৪০০ মি.গ্রা.; ওমিপ্রাজল, এজিথ্রোমাইসিন ঔষধের বিক্রয় নিষিদ্ধ মোড়ক বিভিন্ন ফার্মেসির আশপাশে বা আঙিনায় কিংবা ফার্মেসির মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
সচেতন মহল বলছেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের এমন কর্মের কারণে একাধিক গুরুতর সমস্যা তৈরি হচ্ছে। প্রথমত, নমুনা ঔষধগুলো বাজারজাত করা হয় না, ফলে এর মান বা নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। অনেক সময় মেয়াদ উত্তীর্ণ বা নিম্নমানের ঔষধও নমুনা হিসেবে চলে আসতে পারে। দ্বিতীয়ত, চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া এই ঔষধগুলো বিক্রি হচ্ছে, যা অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের মতো মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। তৃতীয়ত, এর মাধ্যমে ঔষধ শিল্পের নৈতিকতা ও স্বচ্ছতা নষ্ট হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তাঁরা। একইসাথে, সুনামগঞ্জে এই অবৈধ বাণিজ্যের বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কোনো কার্যকর নজরদারি নেই বলেও অভিযোগ উঠেছে।
একাধিক ফার্মেসির বিক্রিয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঔষধ কোম্পানির কিছু অসাধু প্রতিনিধি চিকিৎসকদের না দিয়ে সরাসরি ফার্মেসিগুলোতে এই নমুনা ঔষধ বিক্রি করছেন। আবার কিছু অসাধু চিকিৎসকও তাদের কাছে আসা নমুনা ঔষধগুলো স্বল্প মূল্যে ফার্মেসিতে বিক্রি করে দেন। আর ফার্মেসিগুলো তা কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করে দেদারসে মুনাফা লুটছে।
বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানির মেডিক্যাল প্রমোশন অফিসারদের (এমপিও) সঙ্গে কথা বললে তাঁরা এই প্রতিবেদককে জানান, অনেক ডাক্তার ফিজিশিয়ান স্যাম্পল নিতে রাজি হন না। ডাক্তারগণ ফিজিশিয়ান স্যাম্পলের পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরনের উপহার দেওয়ার কথা বলেন। এখন বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানি আছে যারা ডাক্তারদের দেওয়ার জন্য এমপিওদের কাছে উপহার পাঠায় না। পরবর্তীতে যারা স্যাম্পল নেন না তখন ঐসব ডাক্তারদের খুশি করতে স্যাম্পল বিক্রি করে বাজার থেকে বিভিন্ন উপহার ক্রয় করে দেওয়া হয়। এসব কারণেই মূলত ফার্মেসিতে ফিজিশিয়ান স্যাম্পল বেশি পাওয়া যায়। একাধিক ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানা যায়, ঔষধ কোম্পানিগুলো ডাক্তারের জন্য যে ফিজিশিয়ান স্যাম্পল দেয় তা নামমাত্র ডাক্তারদের হাতে পৌঁছে। বেশিরভাগ স্যাম্পল ফার্মেসিতে কোম্পানির প্রতিনিধিরা বিক্রি করে দেন। কিন্তু কোম্পানির প্রতিনিধিরা স্যাম্পল বিক্রি নিয়ে উল্টো আমাদের নামে মিথ্যা তথ্য ছড়ায়। আসলে এসবকিছু তারাই করে থাকে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী আবুল হাসনাত বলেন, যতটুকু জানি ফিজিশিয়ান স্যাম্পলে কোনো মেয়াদের তারিখ উল্লেখ করা হয় না। উল্লেখ থাকে ক্যাচ কভারে। এজন্য অসাধু ফার্মেসি মালিকরা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের স্টিপের অবিক্রিত দুই বা তেতোধিক ওষুধ ক্যাচ কভারে ভরে বিক্রি করে থাকেন। এতে ক্রেতারা প্রতারণার শিকার হন। এসব ঔষধ আমার-আপনার আত্মীয় স্বজনের মধ্যে কেউ না কেউ সেবন করছেন, এগুলো বিক্রি বন্ধ করা খুবই জরুরি। একইসাথে যেসব ফার্মেসিতে বিক্রি হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানান তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিনিয়র এক মেডিক্যাল প্রমোশন অফিসার (এমপিও) বলেন, আমরা ইচ্ছে করে ফিজিশিয়ান স্যাম্পল বিক্রি করি না। বলা যায় অনেকটা বাধ্য হয়েই বিক্রি করি। কি কারণে বিক্রি করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডাক্তারদের খুশি করতে স্যাম্পলের পাশাপাশি কিছু স্যাম্পল বিক্রি করে বাজার থেকে ছোট-খাটো গিফট কিনে দেই।
ফার্মাসিউটিক্যালস ম্যানেজার এসোসিয়েশন সুনামগঞ্জের এক দায়িত্বশীল ব্যক্তি জানান, হাতেগোনা কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি ছাড়া বেশিরভাগ কোম্পানি ফিজিশিয়ান স্যাম্পল সরবরাহ করে। আমাদের মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ যারা আছেন তারা ৫০০ থেকে ১ হাজার ২০০ পর্যন্ত ক্যাচ কভার (ওষুধের প্যাকেট) পেয়ে থাকেন। প্রতিটি প্যাকেটে কোম্পানি ভেদে দুই থেকে চারটি করে ওষুধ থাকে। এসব ঔষধ ডাক্তারদেরকে দেওয়ার পর ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমিশনে চিকিৎসকরা ফার্মেসিতে দিয়ে দেন।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, বর্তমানে কোনো রোগীকে কোনো চিকিৎসক ফিজিশিয়ান স্যাম্পল দিয়েছেন, এটা তার নজরে আসেনি।
জেলার ফার্মাসিটিক্যালস রিপ্রেজেন্টেটিভ এসোসিয়েশন (ফারিয়া)-এর এক সংগঠক বলেন, ফিজিশিয়ান স্যাম্পল বিক্রি বন্ধ হোক এইটা আমরাও চাই। এই বিষয়ে সকলের উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
ফার্মাসিউটিক্যালস ম্যানেজার এসোসিয়েশন সুনামগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান সোহাগ বলেন, আমরা সাধারণত ফিজিশিয়ান স্যাম্পল ডাক্তারদের কাছে সরবরাহ করে থাকি। এরপর স্যাম্পলগুলো কি করবেন তা শুধু মাত্র ডাক্তারগণ জানেন। এখানে আমাদের কোনো হাত নাই। আমার ফিজিশিয়ান স্যাম্পল বিক্রির পক্ষে না। আমাদের কোনো এমপিও ফিজিশিয়ান স্যাম্পল বিক্রি বা ফার্মেসিতে সরবরাহ করেন না। এরপরই যদি আমাদের কোনো এমপিও’র বিরুদ্ধে স্যাম্পল বিক্রির অভিযোগ উঠে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবো।

সুনামগঞ্জ ঔষধ প্রশাসনের তত্ত্বাবধায়ক মিঠুন চক্রবর্তী বলেন, আমরা নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি। অভিযান করে বিভিন্ন ধরনের ফিজিশিয়ান স্যাম্পল জব্দও করছি। মাসে অন্তত দুইবার ঔষধ প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, ফিজিশিয়ান স্যাম্পল বিক্রি বন্ধ করতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। কোনো অবস্থাতেই ফার্মেসিতে ফিজিশিয়ান স্যাম্পল বিক্রি করা যাবে না। কেউ যদি বিক্রি করেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha

কমেন্ট বক্স