কী কী পরিবর্তন এলো এক মাসে?
- আপলোড সময় : ০৯-০৯-২০২৪ ০৮:৩০:৫৩ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৯-০৯-২০২৪ ০৮:৩০:৫৩ পূর্বাহ্ন
সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্বের একমাস পার করলো। নতুন সরকার এই একমাসে প্রশাসনের শীর্ষপদে ব্যাপক রদবদলসহ বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। এ সময়ে সরকারের তরফ থেকে কয়েকটি নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত এসেছে। দেশের আর্থিক খাতসহ বেশকিছু ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে সংস্কারের উদ্যোগ। কঠিনতম পরিস্থিতিতে সরকারকে দায়িত্ব নিতে হয়েছে উল্লেখ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, একটি বিপর্যস্ত অবস্থা মোকাবিলা করে ‘রাইট ট্র্যাকে’ এগিয়ে চলছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। ওইদিন প্রধান উপদেষ্টাসহ ১৩ উপদেষ্টা শপথ নেন। এরপর আরও তিন দফায় আরও ৭ জন উপদেষ্টা শপথ নিয়েছেন। বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্য দাঁড়িয়েছে ২১-এ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন সরকার গঠনের পর সব থেকে বেশি চাপে পড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে ছাত্র-জনতার পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ সময় দেশের দুই-তৃতীয়াংশ থানা আক্রান্ত হয়। ভাঙচুর করে থানা জ্বালিয়ে দেওয়া, অস্ত্র ও মালামাল লুটসহ পুলিশসদস্যরা হত্যাকা-ের শিকার হন। প্রাণভয়ে পুলিশের অনেক সদস্য আত্মগোপনে চলে যান। ফলে সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার সময়কালে দেশের থানাগুলো অনেকটাই অরক্ষিত ও পুলিশবিহীন ছিল। এসময়ে কর্মস্থলে নিরাপত্তা, পুলিশ হত্যার বিচার, ক্ষতিপূরণসহ বেশকিছু দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করেন পুলিশ সদস্যরা। এতে চুরি-ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যাওয়াসহ দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থতিতে ব্যাপক অবনতি ঘটে। একপর্যায়ে, স্থানীয় বাসিন্দা ও স্বেচ্ছাসেবীরা রাত জেগে পাড়া-মহল্লায় পাহারা দেওয়া শুরু করেন। পরে অবশ্য সরকারের তরফ থেকে পুলিশের কিছু দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতিসহ কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার সময় বেঁধে দিলে এ অবস্থায় ১১ আগস্ট কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে থানায় ফিরতে শুরু করেন পুলিশ সদস্যরা। তবে বিগত সরকারের সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যবহার করা এই বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়ায় সেটা কাটিয়ে কার্যক্রম পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে বলে বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। অবশ্য এ সময় পুলিশ প্রধানসহ বিগত সরকারের সুবিধাভোগী পুলিশের শীর্ষ ব্যক্তিদের চাকরিচ্যুতিসহ তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে ইতোপূর্বে বৈষম্যের শিকার পুলিশ সদস্যরা বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন।
এদিকে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন পরবর্তী দেশের নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্যে প্রায় তিন সপ্তাহজুড়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নানান দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা প্রাঙ্গণে অবস্থানসহ একের পর এক বিক্ষোভ-আন্দোলন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ঘেরাওয়ের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল অঙ্গীভূত আনসার সদস্যদের বিক্ষোভ। ‘রেস্ট প্রথা’ বাতিলসহ চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে গত ২৫ আগস্ট সারাদিন সচিবালয় অবরোধ করে রেখেছিল তারা। তাদের একটি অংশ এ দিন সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়ে। পরে শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমে তাদের প্রতিহত করে। আনসারদের বিক্ষোভের পর সরকারকে অনেকটাই বাধ্য হয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, সচিবালয়, বিচারপতির সরকারি বাসভবন, বিচারপতি ভবন, হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ ও মৎস্য ভবন সংলগ্ন এলাকাতেও সভা-সমাবেশ না করার নির্দেশনা দিতে হয়। অবশ্য আনসার বিক্ষোভ শক্ত হাতে মোকাবিলার পর সেই অর্থে বড় আন্দোলন আর দেখা যায়নি।
গত এক মাসে প্রশাসনিক বিভিন্ন পদে ব্যাপক রদবদল হতে দেখা গেছে। স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের পরিবর্তনসহ নতুন করে বদলি, পদায়ন ও নিয়োগ করা হয়েছে কয়েকশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব, পররাষ্ট্র সচিবসহ বিগত সরকারের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তার চুক্তি বাতিল করা হয়। অনেককে পাঠানো হয় বাধ্যতামূলক অবসরে। অনেকেই হয়েছেন বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও (ওএসডি)। এরআগে, গত ৬ আগস্ট চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের চুক্তি বাতিল করে নতুন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) করা হয় অতিরিক্ত আইজিপি’র দায়িত্বে থাকা মো. ময়নুল ইসলামকে। শেখ হাসিনার সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া আব্দুর রউফ তালুকদারকে সরিয়ে আহসান এইস মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়। এজন্য গভর্নর নিয়োগের বিধিতে কিছুটা পরিবর্তনও আনা হয়।
শেখ হাসিনার পতনের পর সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, এমনকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগের হিড়িক দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পদ ছাড়ছেন, আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ, অপমান-অপদস্থসহ নানান চাপের মুখে কর্তা ব্যক্তিরা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ শীর্ষ পদের ব্যক্তিরা দায়িত্ব ছাড়েন। ইতোমধ্যে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যে উপাচার্য নিয়োগ শুরু হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর বিচার বিভাগেও বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে দেখা গেছে। গত ১০ আগস্ট পদত্যাগে বাধ্য হন আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। আপিল বিভাগের অন্য ৫ বিচারপতিও তার সঙ্গে পদত্যাগ করেন। এ ঘটনার পর নতুন বিচারপতি নিযুক্ত হন আপিল বিভাগের বিচারক সৈয়দ রেফাত আহমেদ। একইভাবে, আপিল বিভাগে নতুন আরও চার বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
এদিকে, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের স্থলাভিষিক্ত হন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান। শেখ হাসিনার সরকারের তৃতীয় প্রধান ব্যক্তিত্ব ¯িপকার ড. শিরন শারমিন চৌধুরীও ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগ করেছেন কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন।
সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিচার ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। সেইসঙ্গে, পাল্টে যাচ্ছে অনেক মামলার রায়। আওয়ামী লীগ শাসনামলে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় দেওয়া ছয় মাসের দ- ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার আগের দিন বাতিল করে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অন্যদিকে, শেখ হাসিনার আমলে দুর্নীতি মামলায় সাত বছরের জেল দেওয়া হয়েছিল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে। কিন্তু সরকার পতনের একদিন পরেই রাষ্ট্রপতি তার সাজা মওকুফ করে মুক্তি দেওয়া হয়। মামলাগুলো ‘মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ ছিল বলে অভিযোগ করে আসছিল বিএনপি। এর বাইরে, মুক্তি দেওয়া হয়েছে কোটা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চলাকালে গ্রেফতার শিক্ষার্থীদের।
কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন গত দেড় দশকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার ও কারাবন্দি বিএনপি, জামায়াতে ও তাদের সমমনা দলগুলোর শীর্ষ নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অসংখ্য নেতা-কর্মী, যাদের মধ্যে ২০০৭ সালে যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন গিয়াস উদ্দিন আল মামুনও রয়েছেন। এছাড়া জামিনে মুক্তি পেয়েছেন জঙ্গিবাদের অভিযোগে নিষিদ্ধ সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীম উদ্দীন রাহমানী এবং হত্যা মামলার আলোচিত আসামি সুইডেন আসলামসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী। তবে, এসব মুক্তি নিয়ে নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার জন্ম নিয়েছে।
হত্যা, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। সজীব ওয়াজেদ, সায়মা ওয়াজেদ, শেখ রেহানাসহ আওয়ামী লীগ সভাপতির পরিবার ও নিকট আত্মীয়দের অনেকে।
বিভিন্ন মামলায় ইতোমধ্যেই সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক, শাহাজান খান, পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, টিপু মুনশি, দীপু মনি, জুনাইদ আহমদ পলক, এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, চট্টগ্রাম বন্দরের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল, বিচারপরিত শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকসহ অনেকে গ্রফতার হয়েছেন। আদালতে নেওয়ার সময় তাদের অনেকের উপর হামলাও হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে শেখ হাসিনাসহ আগের সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের লাল পাসপোর্ট। আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে যেসব অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল তার সবগুলো বাতিল করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া বা গুম হওয়া ব্যক্তিদের অনেকেরই খোঁজ মিলছে সরকার পরিবর্তনের পর। আগের সরকারের নির্দেশেই বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা তাদেরকে তুলে নিয়ে বছরের পর পর আটকে রেখেছিলেন বলে ভুক্তভোগীরা দাবি করেছেন। গুম থাকা এসব ব্যক্তিদের বর্ণনায় উঠে এসেছে ‘আয়নাঘর’ নামে কথিত এক গোপন বন্দিশালার কথা। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুমের ঘটনা তদন্তে হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে গত ২৭ আগস্ট কমিশন গঠন করেছে সরকার। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের ওই কমিশনকে তদন্ত করে ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এর আগে সরকার গুম বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছেন।
ক্ষমতা নেওয়ার পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দুর্নীতির অভিযোগে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় অর্ধশত মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনেকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। জালিয়াতি ও অনিয়মের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকের প্রায় এক লাখ কোটি টাকা তুলে নিয়ে বিদেশে পাচার করার অভিযোগে বিগত সরকারের সুবিধাভোগী এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাংকিংখাতে ‘নজিরবিহীন লুটপাট’ হয়েছে জানিয়ে এ খাতকে স্থিতিশীল করার জন্য পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে সরকার। ব্যাংকিং খাতের টেকসই সংস্কারে ইতোমধ্যেই আলাদা ব্যাংকিং কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। খুব শিগগিরই কমিশন গঠন করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
এছাড়া ‘লুটপাটে’র শিকার হওয়া বেশ কিছু ব্যাংকের আগের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে পুনর্গঠন করা হয়েছে। দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার জন্য অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আগামী তিন মাসের মধ্যে তারা প্রতিবেদন প্রকাশ করবেন বলে জানানো হয়েছে।
শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর মাত্র দশ দিনের ব্যবধানে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা ও উপজেলা মেয়র ও চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ করে অন্তর্বর্তী সরকার। পট পরিবর্তনের পর সরকার সমর্থিত জনপ্রতিনিধিরা আত্মগোপনে কিংবা পরিষদে না যাওয়ায় নাগরিক সেবা ব্যাহতের কারণে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
স্থানীয় সরকারের ওই চারটি প্রতিষ্ঠানের পদ থেকে মেয়র ও চেয়ারম্যানদের অপসারণ করা হলেও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় নীতি গ্রহণ করেছে সরকার। যেসব জায়গায় চেয়ারম্যানরা অনুপস্থিত রয়েছেন, সেখানে কাজ চালিয়ে নিতে প্যানেল চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব পালন করতে পরিপত্র জারি করেছে সরকার।
ক্ষমতা হারানোর চারদিন আগে ৩১ আগস্ট অনেকটা তড়িঘড়ি করেই ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ ও তাদের ছাত্র সংগঠন ‘ইসলামী ছাত্রশিবির’কে নিষিদ্ধ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু নতুন সরকার ক্ষমতায় বসার তৃতীয় সপ্তাহে এসে ২৮ আগস্ট ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা নেওয়ার পর গত দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান মৃত্যুদিন ১৫ আগস্টে সারা দেশে ব্যাপক আয়োজনে শোকদিবস পালিত হতে দেখা গেছে। জাতীয় দিবস হিসেবে ওইদিন সরকারি ছুটিও ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতার পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে সেটিও বদলে গেছে। শপথ নেওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ১৫ আগস্টের সরকারি ছুটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এ ঘটনার পর গত ১৫ আগস্ট ধানম-ি ৩২ নম্বরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে দাঁড়াতে দেয়নি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের কর্মী-সমর্থকরা।
দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. ইউনূস আরব আমিরাতে ছাত্র আন্দোলনে শাস্তির মুখে পড়া ৫৭ প্রবাসী বাংলাদেশির সাজা মওকুফের ব্যবস্থা করেছেন। সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানের সমর্থন পেয়েছেন।
ছাত্র আন্দোলনের ঘটনা তদন্তে আওয়ামী লীগ সরকারের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি গঠন করেছেন। সরকার দেশে ন্যায়পাল নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, স¤পাদক, ব্যবসায়ী নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনকে জুলাই আন্দোলন স্মৃতি জাদুঘর ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারি অর্থে নির্মিত প্রতিষ্ঠানের নামকরণে আইনি কাঠামো প্রণয়নে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষ বিধান বাতিলসহ কয়েকটি আইন সংশোধন করেছে। শেখ হাসিনার নামে থাকা একটি প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করেছে। এদিকে এই সরকার কতদিন থাকবে এমনটি খোলসা না করলেও তারা যৌক্তিক সময় পর্যন্ত থাকবে বলে জানিয়েছেন।
এদিকে দায়িত্ব নেওয়ার পর দুই সপ্তাহের মাথায় ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস। ওই ভাষণে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের নানা কর্মপরিকল্পনা নিয়ে তিনি একটি ধারণা দেন।
ড. ইউনূস বলেন, বিপ্লবী ছাত্র-জনতা জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে আমাকে এক গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছে। নতুন প্রজন্মের এই গভীর আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সংগ্রামে আমি একজন সহযোদ্ধা হিসেবে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছি। দেশের সব বয়সের, সব পেশার, মতের, সব ধর্মের সবাইকে বিনা দ্বিধায় এই সংগ্রামে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান।
বর্তমান সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহ শেষ হলো উল্লেখ করে ভাষণে ড. ইউনূস কর্মযাত্রার প্রথম পর্যায়ে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে সকলের সমর্থন পাচ্ছেন বলে জানান। সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে বদ্ধপরিকর উল্লেখ করে বলেন, দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রহীনতা, ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের জন্য পর্বতসম চ্যালেঞ্জ রেখে গিয়েছে। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ নেওয়ায় আমরা প্রস্তুত। আজ আমি সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করতে আপনাদের সামনে এসেছি। আপনাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে বৃহ¯পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক বার্তায় শিক্ষার্থীদের ক্লাস ও ক্যা¤পাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ড. ইউনূস বলেন, সরকার বিপ্লবের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের কাজ শুরু করেছে। প্রথম কাজ জুলাই ও আগস্টের হত্যাকা-ের বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘের নেতৃত্বে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা খুনিদের প্রত্যর্পণ এবং স্বৈরাচারের সময় দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ ও আমলারা যে পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন তা দেশে ফিরিয়ে আনতে চাই। এ জন্য বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ শুরু করেছি।
সরকারের একমাস কেমন গেলো জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন স¤পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশের প্রশাসনসহ সব কিছু ভেঙ্গে পড়েছিল। সরকার একটি দুরূহ পরিস্থিতি ও জটিল অবস্থার মধ্যে দায়িত্ব নিয়েছে। তারা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে। প্রথমদিকে তাদের খুব বেগ পেতে হয়েছিল। তবে, মনে হচ্ছে তারা আস্তে আস্তে সব গুছিয়ে আনছে।
সরকার সঠিক পথে আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার রাইট ট্রাকেই আছে। তারা নানা ধরণের সংস্কারের উদ্যোগ ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছে। আশা করি তারা একটি রোডম্যাপ তৈরি করে সেই পথেই এগুতে থাকবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই সরকারের বিশাল দায়িত্ব। তারা মাত্র একমাস দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সময়টা তাদের কাজের মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট সময় নয়। কাজেই এটা নিয়ে এখনই মন্তব্য করতে চাই না।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ