বিশেষ প্রতিনিধি ::
২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতিতে যখন ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করেন, তখন তিনদিন সরকার ও প্রশাসন ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। সারাদেশে বিরোধী মতাবলম্বীদের উপর হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের মতো অরাজকতা চললেও, এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সুনামগঞ্জ। শান্তি ও সম্প্রীতির প্রতীক এই জনপদে কোনো বড়ো ধরনের সহিংসতা, সাম্প্রদায়িক হামলা কিংবা হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। স্থানীয় রাজনৈতিক দল ও সুধীজন বুক চিতিয়ে রক্ষা করেছেন শান্তি ও সম্প্রীতির জনপদ সুনামগঞ্জের সুনাম ও ঐতিহ্যকে। কোনও দুষ্কৃতকারীদের প্রশ্রয় দেননি তারা। বরং ভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও এই সময় পাহারা দিয়ে রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। গত এক বছরে ভিন্নমতের উপর বড়ো কোনও মবের ঘটনাও ঘটেনি সুনামগঞ্জ জেলায়। সুধীজন ও রাজনৈতিক মহল এ ঘটনায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পরম্পরা রক্ষার কারণেই এসব ঘটনা ঘটেনি বলে মনে করছেন তারা। সুধীজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেখ হাসিনার পলায়নের খবরে রাজপথে নেমে আসে ছাত্র-জনতা। এসময় বিচ্ছিন্নভাবে জেলায় সরকারি কিছু অফিসে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। কিছু এলাকায় ক্ষমতার অপব্যবহারকারী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘরেও বিচ্ছিন্ন হামলার ঘটনা ঘটে। তবে বড় ধরনের হামলা বা নাশকতার ঘটনা ঘটেনি। নিরাপদ ছিল জেলার ব্যবসা, সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিষ্ঠানগুলো। রাজনৈতিক দলগুলো ও সুধীজন বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতাকে সামাল দিয়েছেন। যার ফলে বড়ো দুর্ঘটনা ঘটেনি। এসময় সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় স্থাপনা পাহারা দিয়েছিল। সারা জেলার নেতাকর্মীদের শান্ত থেকে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও সাধারণ মানুষের জানমাল রক্ষায় ভূমিকা রাখার নির্দেশনা দিয়েছিলেন জেলার রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সরেজমিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে অভয় দিয়ে এসেছিলেন তারা। যে কারণে ৫ আগস্ট থেকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের তারিখ ৮ আগস্ট পর্যন্ত এমনকি পরবর্তী সময়েও সুনামগঞ্জ জেলায় অপ্রীতিকর বড়ো ঘটনা ঘটেনি। কোনও হতাহত বা মব সন্ত্রাসের ঘটনাও ঘটেনি। যার ফলে স্বস্তি ছিল জনজীবনে। এখনো স্বস্তিতে আছেন সাধারণ মানুষ। সরকারবিহীন তিনদিন অতিক্রম করার বেশ কিছুদিন পর কয়েকটি মাজার ভাংচুর, দোয়ারাবাজারে হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি বাড়িতে ভাঙচুর ও কিষাণ চত্বর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। তবে এ ঘটনায় রাজনৈতিক দলগুলোও প্রতিবাদ জানিয়েছিল। প্রশাসনও দ্রুত পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিল। সুধীজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ষাটের দশকে সিলেটি-আবাদি দ্বন্দ্ব, বাবরী মসজিদ দাঙ্গাসহ নানা সময়ে সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক মুখোমুখি অবস্থানে পৌঁছেছিল স্থানীয় জনতা। তখন স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এসব দাঙ্গা সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করে সম্প্রীতির ঐতিহ্য বজায় রেখেছিলেন। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাত এড়িয়ে সম্প্রীতির ধারা বজায় রেখে চলেছেন। সুনামগঞ্জ ট্রেড ইউনিয়নের সেক্রেটারি সাইফুল আলম সদরুল বলেন, আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুদীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। সকল সংকটে আমরা দলমত নির্বিশেষে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এই ঐতিহ্য রক্ষা করেছেন। যার ফলে ৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সরকারবিহীন সময়েও আমরা নিরাপদ ছিলাম। বড়ো কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে কতিপয় সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি এসবে উস্কানীর চেষ্টা করেছিল। তাদের ফাঁদে কেউ পা দেয়নি। সুনামগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যসচিব জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সরকারবিহীন তিনদিন স্বৈরাচারের প্রেতাত্মাসহ দুষ্কৃতকারীরা আমাদের সুনামগঞ্জের সুনাম বিনষ্ট করার চেষ্টা করেছিল। আমরা তা হতে দেইনি। আমরা রাজপথে রাতদিন শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করেছি। জনগণের জানমালের হেফাজত করেছি। জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি যে গণমানুষের রাজনীতি করে এবং সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রাখতে চায় সেই কঠিন সময়েও আমরা তা পালন করেছি। সুনামগঞ্জ জেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুল হাসান রাজু বলেন, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশবাসীর সঙ্গে সুনামগঞ্জবাসীও খুশি হয়েছেন। তবে এ সময়ে সরকারি, বেসরকারি স্থাপনা, ভিন্ন মতাবলম্বিদের ধর্মীয় ও সামাজিক স্থাপনা যাতে দুষ্কৃতকারীদের টার্গেটে না পড়ে আমরা আমাদের নেতা নূরুল ইসলাম নূরুল ভাইয়ের নির্দেশনায় সচেতন ছিলাম। মানবঢাল হয়ে আমরা কাজ করেছি, পাহারা দিয়েছি। যার ফলে অন্ধকার শক্তি আমাদের গ্রাস করতে পারেনি। সুনামগঞ্জ পৌর বিএনপির সদস্য সচিব মোরশেদ আলম বলেন, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিলেন। তখন কোনও সরকার ও প্রশাসন ছিলনা। অরক্ষিত ছিল সব কিছু। তখন আমরা রাস্তায় নেমে সরকারি-বেসরকারি এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের স্থাপনার সুরক্ষা দিয়েছি। আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য বজায় রেখেছি। আমরা একযোগে কাজ করে প্রমাণ করেছি ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা, ধর্মীয় সহাবস্থান এবং সামাজিক ঐক্যই একটি জনপদকে নিরাপদ রাখতে পারে। সুনামগঞ্জ জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা তোফায়েল আহমদ খান বলেন, ৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকার প্রধান শেখ হাসিনার পলায়নের পর আমরা ট্রাফিক পয়েন্টে ছিলাম। তখন আমিরে জামায়াতের নির্দেশনা অনুসারে আমরা শান্তি, সম্প্রীতি বজায় রেখেছি। কোনও ক্ষতি হতে দেইনি। যার ফলে আমাদের সুনামগঞ্জ শান্ত ছিল। আমরা এই ধারাবাহিকতা এখনো বজায় রেখেছি। সুনামগঞ্জ জাসাসের সভাপতি অধ্যক্ষ (অব.) শেরগুল আহমেদ বলেন, সুনামগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। সরকারবিহীন উত্তাল সময়েও আমরা এই ঐতিহ্যে কলঙ্ক লেপন করতে দেইনি। ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশ আমলেও আমরা এই ঐতিহ্য রক্ষা করে চলছি সুনামের সাথে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর
সরকারবিহীন ৩ দিনে সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল সুনামগঞ্জ
- আপলোড সময় : ০৮-০৮-২০২৫ ০৮:২৮:৪২ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৮-০৮-২০২৫ ০৯:০৫:৫১ পূর্বাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ