সুনামগঞ্জ , বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫ , ৮ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
মাইলস্টোন স্কুলে বিমান ট্র্যাজেডি নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩১ তাহিরপুরে প্রতিবন্ধী তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ হাওরে দেশি মাছের আকাল, বিপন্ন বহু প্রজাতি বালুর স্তূপে কাঁদছিল নবজাতক, মায়ের মমতায় কোলে তুলেন হাসিনা দিরাই পৌর বিএনপির ৯টি ওয়ার্ড কমিটি গঠন সুদের চাপ সইতে না পেরে ব্যবসায়ীর আত্মহত্যা সুনামগঞ্জ-৫ আসনে জমিয়তের প্রার্থী মুফতি লুৎফুর রহমান নুরুল্লা গ্রামে ৩ জনের ওপর হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত : পাইলটসহ নিহত ২০, আহত ১৭১ বিমানটি ঘনবসতি থেকে জনবিরল এলাকায় নিতে চেয়েছিলেন পাইলট শান্তিগঞ্জে গাছের চারা ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ জগন্নাথপুর পৌরসভার বাজেট ঘোষণা জগন্নাথপুরে নকল প্যাকেটে নিম্নমানের মসলা ও কেমিক্যালযুক্ত খেজুর গুড় বিক্রি পাইকুরাটি ইউনিয়ন বিএনপি’র আহ্বায়ক কমিটি বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন সড়কবিহীন কমিউনিটি ক্লিনিক, দুর্ভোগে মানুষ সুনামগঞ্জ বিএনপিতে ফাটল, ১৮ ইউনিটে পাল্টা কমিটি দেড় কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ বিশ্বম্ভরপুরে নারীর লাশ উদ্ধার দুই যুগ আগের ঝুলে থাকা ১০ হাজার মামলা নিষ্পত্তি করবে হাইকোর্ট পাঁচ মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ৯১০০ মামলা

স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত,এতো শোক সইবো কেমন করে?

  • আপলোড সময় : ২৩-০৭-২০২৫ ০৯:০২:১০ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২৩-০৭-২০২৫ ০৯:০৩:২১ পূর্বাহ্ন
স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত,এতো শোক সইবো কেমন করে?
 ড. হারুন রশীদ::
পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ সবচেয়ে ভারী বস্তু। সেটা যদি হয় ছোট ছোট কোমলমতিদের লাশ তাহলে তা বহন করা আরও দুঃসাধ্য।
উত্তরার বিমান দুর্ঘটনায় একমাত্র সন্তান ফুটফুটে মেহেনাজ আক্তার হুমায়রাকে হারিয়ে দিশেহারা সখীপুর উপজেলার হতেয়া গ্রামের দেলোয়ার হোসেন দম্পতি। হুমায়রা মাইলস্টোন স্কুলের শিশু শ্রেণির ছাত্রী ছিল। তিনিও ওই প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষক। তার মতো অনেক পিতা-মাতাই শোকে বিহ্বল। কারণ তারাও যে হারিয়েছেন আদরের ধন। ছুটির পর যে স্কুল ক্যাম্পাস থাকতো কোলাহলে মুখর তা ভেসে গেল আর্তনাদে। স্কুল ছুটির পর জীবন থেকেও ছুটি নিলো কোমলমতিরা। মুহূর্তেই তারা হয়ে গেলো আকাশের তারা। বিষাদে ছেয়ে গেল আকাশ-বাতাস। এতো শোক যে সইবার নয়। প্রশিক্ষণের সব ধাপ শেষে তৌকির ইসলাম প্রথমবারের মতো একা বিমানটি চালাচ্ছিলেন গত সোমবার। স্বপ্ন ছিল আকাশের অসীম নীল সীমানা পাড়ি দেওয়ার। পরিবারের লোকজনেরও এ নিয়ে উচ্ছ্বাসের কোনো অন্ত ছিল না। কিন্তু এটিই যে তার শেষ উড়াল হবে তা কে জানতো? উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরই তার বিমানটি আছড়ে পরে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজ ক্যা¤পাসে। বিকট শব্দে আগুন ধরে যায় বিমানটিতে। তখন স্কুলের ছাত্ররা ছুটি শেষে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় ছিল। বিধ্বস্ত বিমানে আগুন লেগে তা ক্লাসরুমে ছড়িয়ে পড়ে। কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় চারদিক। দাউ দাউ শিখায় জ্বলতে থাকে তাজা প্রাণ। এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয় ক্যাম্পাসে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার অভিযান শুরু করে। কিন্তু ততক্ষণে নিভে যায় অনেক প্রাণ। বহু আহত হয়। সরকারি হিসেবে এ পর্যন্ত ৩১ জন নিহত ও ১৭১ জন আহত হয়েছে বলে বলা হচ্ছে। আহতদের মধ্যে ২৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানানো হয়েছে। দুর্ঘটনায় পাইলটও প্রাণ হারান। সেই সঙ্গে শেষ হয় একজন তেজোদ্দীপ্ত তরুণের অমিত সম্ভাবনার এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের। সেই বিষাদময় দুপুরে মাইলস্টোন কলেজ ক্যা¤পাসের কী অবস্থা ছিল তা এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানিয়েছেন সেই স্কুলের শিক্ষিকা পূর্ণিমা দাশ। সেই হৃদয় বিদারক দৃশ্যের কথা তুলে ধরে তিনি লিখেন- ‘স্কুল ছুটি হয় দুপুর একটায়। এরপর দুই ঘণ্টা কোচিংয়ের জন্য কিছু ছাত্রছাত্রী স্কুলে ছিল এবং যাদের অভিভাবক তখনও নিতে আসেনি, তারা অপেক্ষা করছিল। দুপুর একটা ১০ কি ১৫ মিনিটে একটা জেট বিমান (বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান) ক্র্যাশ হয়ে দিয়াবাড়ি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হায়দার আলী বিল্ডিংয়ে আগুন ধরে। ওই বিল্ডিংয়ে বাংলা ভার্সনের ক্লাস থ্রি থেকে ফাইভ আর ইংরেজি ভার্সনের ক্লাস সিক্স থেকে এইটের বাচ্চাদের ক্লাস হয়। আমিও ওখানেই ক্লাস নিই। আমি ক্লাস শেষ করে ঠিক যেখানে আগুনটা লেগেছে, ওই করিডোর পার হয়ে আমাদের টিচার্স রুমে গেছি। ততক্ষণে ওই বিল্ডিংয়ের আশি ভাগ বাচ্চারা বাড়ি চলে গেছে। এবং তখন বিল্ডিংয়ে ভয়ানক শব্দ, আমি কিছু বোঝার আগে দেখি, ছোট ছোট বাচ্চাগুলো দৌড়ে আসছে। দেখলাম, তাদের সারা গায়ে আগুন। আমি কোনো রকমে ওয়াশরুমে গিয়ে পানি ঢালছি দুই-তিনজনের গায়ে। এমন সময় একজন টিচার চিৎকার করে বলছেন, ‘পূর্ণিমা বের হোন। বের হোন।’ রুম থেকে বের হয়ে দেখি, এত আগুন এত আগুন! সমস্ত করিডোরে আগুন! আমার থেকে দুই হাত দূরে আগুনের মধ্যে আমার একজন সহকর্মী ছুটতে ছুটতে এসে আমার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে বলেন, ‘আমাকে বাঁচান।’ তাঁর সারা শরীর পুড়ে গেছে। আমি স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে আছি তখনও। কেউ একজন হ্যাঁচকা টান দিয়ে আমাকে ওই জায়গা থেকে সরায় এবং বিল্ডিংয়ের গ্রিল ভেঙে আমাদেরকে বের করা হয়। আমার বাচ্চাগুলোকে আমি পাঁচ মিনিট আগেও দেখে এসে পাঁচ মিনিট পরে তাদের পুড়ে যাওয়া শরীর দেখে এসেছি। ভগবান এ রকম দিন কেন দেখাল জানি না, কেন আমার কোনো আঁচড়ও লাগল না, আমার কেন কিছু হলো না, আমি জানি না। ওই ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর মুখ আমার চোখের সামনে ভাসছে। আমার সহকর্মীদের চেহারাগুলো চোখের সামনে ভাসছে। কত মায়ের বুক আজ খালি হলো। কেন হলো, জানি না।” যে বিমানটি দুর্ঘটনার শিকার হয় তা বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজিআই মডেলের বিমান। এটি একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান, যা চীনে তৈরি। বিমানটি সোমবার বেলা ১টা ৬ মিনিটে উড্ডয়ন করে। মাইলস্টোন স্কুলের একটি ভবনের সামনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। ভবনটি দোতলা। সেখানে পাঠদান করা হয়। ভবনটির নাম প্রজেক্ট-২। ওই ভবনে দুটি তলা মিলিয়ে মোট ১৬টি ক্লাসরুম আছে। আর ৪টি শিক্ষকদের রুম। প্রাথমিকের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস হতো এই ভবনে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শ্রেণিকক্ষের সামনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে। ভবনটিতে ছুটির পর ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা কোচিং করতো। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ জাহেদ কামাল সোমবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে জানান, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ১৯ জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ৫০ জন। যদিও এ সংখ্যা পরে বৃদ্ধি পায়। আইএসপিআর জানায়, দুর্ঘটনায় বিমানের পাইলটও মারা গেছেন। বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, হতাহতের ঘটনায় আজ মঙ্গলবার এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। কেন বার বার প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা জরুরি। প্রশিক্ষণের ত্রুটি, নাকি যান্ত্রিক ত্রুটি, নাকি উভয়ই- সেটি বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। গত বছর ৯ মে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধ বিমান যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় দুর্ঘটনায় পড়ে। এ ঘটনায় একজন পাইলটের মৃত্যু হয়। অন্যজন সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। একই মডেলের আরেকটি বিমান ২০১৭ সালেও চট্টগ্রামের লোহাগড়ায় বিধ্বস্ত হয়েছিলো। সবশেষ ঘটলো উত্তরার দুর্ঘটনা। বিমান বিধ্বস্তে বহুসংখ্যক হতাহতের ঘটনায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। শোকে মুহ্যমান গোটা দেশ। এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। প্রশ্ন ওঠেছে, জনবহুল এলাকায় কেন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালানো হয়। তাছাড়া আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত ও হতাহতদের পরিবারের পাশে থাকাটাও অত্যন্ত জরুরি। তদন্ত সাপেক্ষে প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখে পুনরাবৃত্তি রোধে নিতে হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও। মৃতের কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না। যারা স্বজন হারিয়েছেন কোনও প্রতিদানই তাদের শোক ভোলাবে না। কিন্তু রাষ্ট্রের তো দায়িত্ব রয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানোর। যারা অগ্নিদগ্ধ হয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটের বিছানায় কাতরাচ্ছে তাদের কষ্টও অবর্ণনীয়। অবর্ণনীয়। দগ্ধ দেহে তারা জীবন্মৃত। যে কোনো মূল্যে তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে নিতে হবে দেশের বাইরে। হতাহতের পরিবারগুলো যেন মনে না করেন তারা একা। কল্যাণ রাষ্ট্রের নাগরিকের পাশে দাঁড়ানোটা অন্যতম কর্তব্য। উত্তরার স্কুলে বিমান দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষেত্রে এ কথা আরও বেশি প্রযোজ্য।

নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha

কমেন্ট বক্স