তানভীর আহমেদ ::
হাওর জেলা সুনামগঞ্জের মাটি, জল আর বাতাসে একসময় মিশে ছিল এক অবিচ্ছেদ্য পরিচয়-‘মৎস্য-পাথর-ধান, সুনামগঞ্জের প্রাণ’।
এই প্রবাদটি কেবল কয়েকটি শব্দ ছিল না, এটি ছিল এই অঞ্চলের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি, সমৃদ্ধির প্রতীক এবং মানুষের আত্মপরিচয়ের ভিত্তি। মাছের প্রাচুর্য হাওর-নদীর দান, পাথর ছিল প্রকৃতির এক অমূল্য স¤পদ, আর উর্বর ভূমির সোনালী ধান ছিল কৃষকের স্বপ্ন ও অন্নের একমাত্র উৎস। এই তিনটি স্তম্ভের ওপর যুগযুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে সুনামগঞ্জের অর্থনীতি, সংস্কৃতি আর জনজীবন। কিন্তু সময়ের চাকা ঘুরেছে, বদলে যাচ্ছে এই অঞ্চলের দৃশ্যপট। সেই পরিচিতি, যা একসময় গর্বের সাথে উচ্চারিত হতো, তা আজ কেবলই পুরোনো দিনের কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হাওর-বাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ জেলায় দেশি প্রজাতির মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী এখন চলছে বর্ষাকাল। কিন্তু এই বর্ষা মৌসুমেও হাওরে দেশি মাছের দেখা মিলছে না। মাছশূন্য জলাশয় আর বাড়তি দামে কেনা পুকুরের মাছে হতাশ ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই। মৎস্যজীবী ও সাধারণ মানুষের আশঙ্কা, এমনটা চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ‘মাছের দেশ’ হিসেবে পরিচিত পাওয়া এ-জেলার বাসিন্দারা চরম আমিষ সংকটে পড়বেন।
সুনামগঞ্জ পৌর শহর ও শহরতলির পাশাপাশি বিভিন্ন উপজেলার হাট-বাজারগুলোতে এখন দেশি মাছের তেমন একটা দেখা মিলছে না। বাজারে অবাধে বিক্রি হচ্ছে পুকুরে চাষ করা পাঙাশ, পুটি, পাবদা, তেলাপিয়া, টেংরা, কৈ, কাতলা, রুই, শিং, মাগুরসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। ইতিমধ্যে সুনামগঞ্জের হাওর-নদী থেকে দেশি প্রজাতির অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়াও, বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে আরও বহু প্রজাতি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাওরে দেশীয় মাছ কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন এবং শুকনো মৌসুমে জলাশয়ের তলদেশ শুকিয়ে মাছ ধরা। এ কারণে মাছের বংশবিস্তারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে।
এছাড়া নিষিদ্ধ জাল দিয়ে অবাধে মাছ শিকারকেও দায়ি করছেন তারা। তারা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনে অত্যন্ত ঝুঁকিপ্রবণ বাংলাদেশ। খরা কিংবা অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, বন্যাসহ নানা দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয় দেশের মানুষকে। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত অনেকটা বৃষ্টিহীন কেটেছে। এর মাঝে ছিল তাপপ্রবাহ। যার বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে সামগ্রিক মৎস্য খাতে। মৎস্য গবেষকরা বলছেন, প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোয় সাধারণত এপ্রিল-জুনে বৃষ্টি হলে পানি বৃদ্ধি পায়। এ সময় দেশীয় মাছ হাওর-খাল-বিলের পানিতে ডিম ছাড়ে ও প্রজনন করে। আর মে-আগস্ট এ সময়ে মাছের বৃদ্ধি ঘটে। শীতকালে মাছের খুব বেশি বৃদ্ধি হয় না। কিন্তু সময়মতো পর্যাপ্ত বৃষ্টি হচ্ছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মৎস্যখাতে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া জানান, সাধারণত মে-আগস্টে মাছের বৃদ্ধি বেশি হয়। তুলনামূলক শীতে কম। তিনি বলেন, এপ্রিল-জুনের বৃষ্টিতে খাল-বিলে পানি বাড়লে তখন দেশীয় মাছ প্রজনন করে। কিন্তু এ সময় এবার বৃষ্টি হয়নি। এসব কারণে এবার দেশীয় মাছের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শুধু দেশীয় মাছ নয়, পুরো মৎস্য খাতেই এ প্রভাব দেখা যাবে। এদিকে ক্রেতারা বলছেন, পুকুরে চাষের মাছের স্বাদ কম হলেও বাধ্য হয়েই সেগুলো কিনতে হচ্ছে। মৎস্যজীবীরা বলছেন, হাওর-নদীতে আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। সারাদিন কষ্ট করে যা পাওয়া যায় তাও তুলনামূলকভাবে খুবই সামান্য। হাওরে মাছ না থাকায় অনেকেই মাছ ধরার পেশা ছেড়ে দিয়েছেন, আবার অনেকেই বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় মাছ ধরাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তবে মাছের এই আকালের পেছনে শুধু প্রাকৃতিক কারণই নয়, দায়ী মনুষ্যসৃষ্ট কারণও। নিষিদ্ধ কোনা জাল, চায়না দুয়ারি (রিং জাল), ও কারেন্টের জালের অবাধ ব্যবহার মাছের বংশবিস্তার চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। হেমন্ত মৌসুমে নদী ও খাল-বিলের তলদেশ শুকিয়ে মাছ নিধনের ঘটনাও ঘটছে। এমনকি কিছু অসাধু ব্যক্তি পানিতে মেডিসিন প্রয়োগ ও ইলেক্ট্রিক শক মেশিন ব্যবহার করে নিয়মিত মাছ ধরছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
টাঙ্গুয়ার হাওর পাড়ের রংচি গ্রামের বাসিন্দা মৎস্যজীবী মকবুল হোসেন বকুল বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে একসময় দেশীয় প্রজাতির মাছের পরিমাণ খুব বেশি ছিল। আমরা বাড়ির পাশেই নদী কিংবা হাওরে প্রচুর মাছ ধরতে পারতাম। কিন্তু বর্তমানে টাঙ্গুয়ার হাওরে বা তাঁর আশপাশের হাওরগুলোতে তেমন একটা মাছের দেখা মিলছে না। দেশীয় মাছের সংকট দেখা দেওয়ার কারণ হিসেবে এই মৎস্যজীবী মকবুল জানান, বর্তমানে হাওরে অবাধে ইলেক্ট্রিক শক মেশিন, চায়না দোয়ারি জাল, বিষপ্রয়োগসহ সারাবছর মশারী নেট জাল দিয়ে মাছ ধরা হচ্ছে। এইসব কারণেই হাওরে এখন দেশীয় প্রজাতির মাছ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমেছে। মকবুল হোসেন বকুল আরও বলেন, আমরা এখন পুকুরের চাষকৃত মাছের উপর নির্ভরশীল, যদিও এই মাছ খেতে আমরা অভ্যস্ত না। আমরা হাওরবাসী হিসাবে বলতে চাই টাঙ্গুয়ার হাওর সংরক্ষণের দায়িত্বে যারা রয়েছে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় এনে আন্তরিকতার সাথে সংরক্ষণের কার্যক্রম জোরদার করুন, যাতে করে টাঙ্গুয়ার হাওর তার পূর্বের রূপ-যৌবন ফিরে পায়।
তাহিরপুর উপজেলার সুলেমানপুর গ্রামের বাসিন্দা মৎস্যজীবী রবিন মিয়া বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মাছ ধরার সাথে জড়িত আছি। অতীতে যে পরিমাণ মাছ ধরা যেতো বর্তমানে তাঁর ১০ ভাগও পাই না। সারাদিনে ২-৩শ টাকার মাছ ধরে বিক্রি করা যায়। এই আয়ে পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, হাওরে মাছ না থাকায় অনেকেই বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় জীবিকার তাগিদে এলাকা ছেড়েছেন। হাওরে মাছের উৎপাদন বাড়াতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
জামালগঞ্জ উপজেলার নোয়াহালট গ্রামের বাসিন্দা মৎস্যজীবী আজিম মিয়া বলেন, হাওরে এখন মাছ নাই বললেই চলে। এবার আরও বড় সমস্যা হলো হাওরে এখনও পানি নাই। পর্যাপ্ত বৃষ্টি হচ্ছে না, পাহাড়ি ঢলও নামছে না, যার কারণে হাওরগুলো পানি শূন্য হয়ে যাচ্ছে। তিনি জানান, হাওরের প্রকৃতিতে বদল এসেছে। সময় মতো হাওরে পানি আসে না। জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরা এবং ক্ষতিকর জালে মাছ শিকারের কারণে হাওরে স্থানীয় জাতের মাছের আকাল চলছে। হাওরপারের মানুষের কাছে চার-পাঁচ বছর ধরে এই পরিবর্তনটা বেশি চোখে পড়ছে।
সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামসুল করিম বলেন, হাওরে দেশীয় মাছ কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং শুকনো মৌসুমে জলাশয়ের তলদেশ শুকিয়ে মাছ ধরা। এ কারণে মাছের বংশবিস্তারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এইধরনের নিষিদ্ধ কর্মকা- রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে এবং এই কার্যক্রম আরও বেগবান করা হবে। তিনি আরও বলেন, দেশীয় মাছের উৎপাদন বাড়াতে শীঘ্রই বিভিন্ন হাওরের উল্লেখযোগ্য বিলগুলো খনন করা হবে। একইসাথে বিলগুলোকে মাছের নিরাপদ অভয়াশ্রম হিসেবে তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
হাওরে দেশি মাছের আকাল, বিপন্ন বহু প্রজাতি
- আপলোড সময় : ২৩-০৭-২০২৫ ০৮:৩২:৪২ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৩-০৭-২০২৫ ০৮:৩৬:৩৩ পূর্বাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ