বিশেষ প্রতিনিধি ::
জামালগঞ্জের সাচনা বাজার। ভাটির বন্দর কিংবা ভাটির রাজধানী। উভয় পরিচয়ে পরিচিত বাজারটির এখন খ্যাতির চূড়া থেকে খ্যাতির তলানিতে অবস্থান করছে।
অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, দায়িত্বহীনতার কাদাজলে নষ্ট হয়েছে বাজারের সুনাম ও ঐতিহ্য, এমন অভিযোগ আছে। তবে দায়িত্বশীল পক্ষ পরস্পরকে দোষারোপ করে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছেন। চরম ভোগান্তি, ক্ষোভ, অস্বস্তি মাথায় নিয়ে নীরব যন্ত্রণায় ধুঁকছে শত বছরের প্রাচীন এই হাট। দুর্দশাগ্রস্ত বাজারের শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রকৃত ব্যবসায়ীর মতামত ও সকলের সমন্বয়ে দক্ষ, যোগ্য ও দায়িত্বশীল বাজার কমিটি গঠনের দাবি অনেকের।
জানাযায়, সাচনা বাজার থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার রাজস্ব নিচ্ছে সরকার। চলতি অর্থবছরে এ বাজারের হাটবাজার ইজারা বাবদ ২৭ লাখ ৭১ হাজার ১০০ টাকা, নৌকাঘাট থেকে ৩ লাখ ৫২ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। ইজারা না হওয়ায় খাস কালেকশন চলছে কাঠ ও বাঁশমহালে। সাচনা বাজার-জামালগঞ্জ খেয়াঘাট থেকেও মোটা অংকের রাজস্ব পাচ্ছে সরকার। বাজারের বন্দোবস্তকৃত দোকানকোঠা বাবদও বড় অংকের খাজনা দিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বাজার উন্নয়নে নেই কোন টেকসই পরিকল্পনা। বাজারে মাঝে-মধ্যে সরকারি বরাদ্দ যা আসে, তার বড় অংশ অপচয় ও লুটপাট হয়ে যায় বলে অভিযোগ আছে। বাজারের স্বার্থ সংরক্ষণে বাজার কমিটি থাকলেও ওই কমিটির কার্যক্রম পদ-পদবী পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এ নিয়ে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ী মহলে চরম ক্ষোভ আছে।
খোঁজ নিয়ে জানাযায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থ বৎসরে রাজস্ব উন্নয়ন তহবিলের আওতায় সাচনা বাজার-দুর্লভপুর রাস্তা মেরামতে দুই লাখ, বাজারে সিসি ক্যামেরা স্থাপনে চার লাখ, সিএন্ডবি রোডে যাত্রী ছাউনি নির্মাণে দুই লাখ, সাচনা বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মসজিদ রোড সংস্কারে ৯ লাখ, বাজারের যানজট নিরসনে অবৈধ মালামাল অপসারণ বাবদ পাঁচ লাখসহ মোট ২৩ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। তবে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে ওইসব কাজের সন্তোষজনক বার্তা পাওয়া যায়নি। এর বেশির ভাগ অর্থই তছরুপ হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। সম্প্রতি সিএন্ডবি রোডের একাংশে ঢালাইয়ের (পাকাকরণ) কাজ হয়েছে। বিশ লাখ টাকার ওই কাজ নিয়েও আছে মত-ভিন্নমত। সিএন্ডবি রোডের ওই কর্দমাক্ত ক্ষত সারতে মধ্যবাজারমুখী আরেক অংশে বিশাল ক্ষতের সৃষ্টি করা হয়েছে। দায়সারা গোছের এই কাজে বণিক সমিতির খোদ সভাপতি-সম্পাদকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সম্মুখস্থল নর্দমায় রূপ নিয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে ভোগান্তির চিত্র দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, জেলার প্রাচীন এই হাট এখন আগের মতো নেই। বাজারে সদাই করতে এসে নানা ঝক্কি-ঝামেলায় পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে। অতীতের জমজমাট এই বাজার অনেকটা অরক্ষিত। পানি নিষ্কাশনের কার্যকরী ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায়, একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমে চলাচলের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পড়ে গোটা বাজারের অলিগলি। বছর দেড়েক আগে বাঁধ বাজার থেকে তালপট্টিমুখী খানিক অংশে ড্রেনের কাজ হলেও তা ছিল লোকদেখানো। বাঁধা সত্বেও ড্রেনে পরিত্যক্ত বৈদ্যুতিক খুঁটি দন্ডায়মান রেখেই কোনরকম দায় সেরেছে ঠিকাদাররা। অপরিকল্পিত এই কাজে পানি নিষ্কাশনের বদলে পানি জমে জলমগ্ন হয়ে পড়ছে বাঁধ বাজার। এছাড়া সুপেয় পানির নলকূপ কিংবা শৌচাগার, কোনটি না থাকায় ভোগান্তির শেষ নেই সাচনা বাজারে। বেহেলী রোড, বাঁধ বাজার, সিএন্ডবি রোড, লামাবাজার, দুর্লভপুর রোডসহ বাজারের যত্রতত্র ঠুনকো সংস্কার, নামমাত্র ড্রেন মেরামতের নামে টুকটাক কাজ দেখিয়ে বারবার বরাদ্দের হেরফের হয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের ইচ্ছের প্রতিফলন হয়নি। বাজার অভ্যন্তরে দিনদুপুরে মালবাহী বড় বড় ট্রাক-পিকআপ এনে জনগুরুত্বপূর্ণ সড়ক দখলে নিচ্ছে ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ। বাজারের প্রবেশ মুখগুলোতে অবৈধ মোটরসাইকেল ও অটোরিকসা স্ট্যান্ড বসিয়ে দখলদারি রাজত্ব কায়েম করছে একটি চক্র।
এতে বাজারে মারাত্মক যানজট এবং চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টিসহ বাজারমুখী মানুষ ও যাত্রীসাধারণ চরম দুর্ব্যবহারের শিকার হচ্ছে। পাশাপাশি সাচনা বাজার-জামালগঞ্জ খেয়া পারাপারেও আছে দুর্ভোগ-দুর্ব্যবহারের অভিযোগ। বাজারে কোন কিছু কিনতে এসে জমা (নির্দিষ্ট পণ্য কেনা বাবদ টোল) আদায়কারীর রোষানলে পড়ছে ক্রেতাসাধারণ। ঘরে-বাইরে সবখানে জমা আদায়ের নামে এক ধরনের ‘জুলুম’ চালিয়ে আসছে বাজার ইজারাদার পক্ষ। এছাড়া কয়দিন পরপরই দোকান-ঘরে চুরির ঘটনাও ঘটছে। চোরেরা অনেকটা অবাধে মালপত্র ও টাকা-পয়সা নিয়ে ব্যবসায়ীদের আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাজারজুড়ে এমন নৈরাজ্য-অরাজকতা চললেও এগুলো দেখার কেউ নেই বলে ক্ষোভ ঝারেন অনেকে। এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে দূর-দূরান্তের লোকজন সাচনা বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে। অনিয়ম, দুর্ভোগ-ভোগান্তিসহ নানামুখী অপতৎপরতার কারণে ঐতিহ্যবাহী বাজারটি তার প্রাচীন জৌলুস হারিয়ে ফেলছে।
তবে বাজারের ভালো-মন্দ দেখভালকারী বণিক কল্যাণ সমিতি এক্ষেত্রে দায়িত্বহীনতা ও অদক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কেউ কেউ।
সাচনা বাজারে চোরের উপদ্রব আছে প্রতিকার নেই জানিয়ে ব্যবসায়ী আকবর হোসেন বলেন, কোন গরিব মানুষ বিয়ে-শাদির ফার্নিচারসহ যেকোন পণ্য ঘর থেকে কিনে বাইরে বের হলেই জমাদার হাজির। চাহিদা মতো বাড়তি টাকা না দিলে হুমকি-ধমকি কতকিছু। বাজারে জমা আদায়ের নামে চাঁদাবাজি চলছে। কোন নিয়ম-নীতি নেই। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, এত বড় একটা বাজার। শৌচাগার ও পানির ব্যবস্থা নেই। সামান্য বৃষ্টিতে রোড-ঘাটের বিশ্রি অবস্থা হয়। ময়লা-আবর্জনা ও কাদাপানিতে হাঁটেন মানুষ। অভিভাবকশূন্য বাজারে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি।
সাচনা বাজার চন্দ সমাজ কল্যাণ ও সেলুন সমিতির সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ শীল বলেন, একটু বৃষ্টিতেই বাজারে বন্যা লেগে যায়। গলিতে ময়লা-আবর্জনা ও দুর্গন্ধযুক্ত দূষিত পানি জমে থাকায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে মানুষ। মোটরসাইকেল-টমটমের বেপরোয়া চলাচলে সাধারণ মানুষ শৃঙ্খলভাবে হাঁটতে পারছে না। বাজারের প্রবেশ মুখগুলোতে অবৈধ স্ট্যান্ডের কারণে ব্যবসায় ব্যাঘাত ঘটছে। জমা আদায়ের নামেও আছে জোর-জবরদস্তি। এসব সমস্যা যারা দেখবে তারাই দায়িত্বহীন। সুশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থায় প্রয়োজন শক্তিশালী বাজার কমিটি।
কমরেড বরুণ রায় স্মৃতি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ বলেন, ‘সারা অঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিব কোথা।’ এ বাজারের সারা গায়েই ক্ষত লেগে আছে। এই ক্ষত সারতে সুচিকিৎসা প্রয়োজন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি আরও বলেন, একসময়ের লোকে লোকারণ্য সাচনা বাজারে এখন আগের মতো মানুষ আসে না। বিশৃঙ্খলায় পর্যুদস্তু এই বাজারে এসে মানুষ হেনস্তার শিকার হচ্ছে। এ অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা রোধে অংশগ্রহণমূলক শক্তিশালী বাজার কমিটি দরকার।
বণিক সমিতি নিয়ে কিছুটা গাফলা আছে স্বীকার করে ব্যবসায়ী আলী আক্কাছ মুরাদ বলেন, টমটম-মোটরসাইকেল স্ট্যান্ড বসিয়ে যানজট সৃষ্টি ও দুর্ব্যবহারের ব্যাপারে তাদেরকে ডেকে বলা হলেও কাজ হচ্ছে না। জমা আদায়ের নামে অপমান করার ঘটনাও ঘটছে। বৃষ্টির পানিতে নালা-নর্দমায় পরিণত হচ্ছে বাজার। সবকিছুতেই নানা অনিয়ম আছে। সকলকে মিলেমিশেই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
ব্যবসায়ী মো. নূরু মিয়া বলেন, বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি খুবই নাজুক। এর সাথে সুনাম আর ঐতিহ্য বেমানান। নামকাওয়াস্তে যে কমিটি আছে, বাজার উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে সে যোগ্যতা তাদের নেই। ব্যবসায়ী-অব্যবসায়ী কয়েকজন লোক বণিক সমিতির হর্তাকর্তা। বাজারের দুর্ভোগ-দুর্দশা লাঘবে তাদের কার্যক্রম শূন্য। প্রকৃত ব্যবসায়ীদের নিয়ে কমিটি গঠন করতে না পারলে বাজারের অবস্থা এ রকমই থাকবে।
জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি চিত্তরঞ্জন তালুকদার সাচনা থেকে ফিরে ক্ষোভ জানিয়ে এই প্রতিবেদককে বলেন, জামালগঞ্জের খেয়া পারাপারে ঝুঁকি ও কষ্ট দেখে ঘাটের লোকদের প্রশ্ন করলাম, ঈদ-পূজায় এমনটা হয়ে থাকলে আপনারা অন্তত কয়েকদিনের জন্য নৌকা আরেকটা বাড়ালেন না কেন? পারাপারের জন্য আগে ছোট ছোট নৌকা ছিল, এগুলোও আপনারা বিদায় করে দিলেন। ‘জবাবে একজন আমাকে বলে, কোয়াই তনি আইছইন আফনে, কিতার লাগি আইছন এইখানে। গুদারা পার হইতে চাইলে উঠৌকা গিয়া। এইতা কিতা মাতইন আফনে। যাউকা যাউকা।’ তাদের এই অসদাচরণে মানুষ যেন অসহায়।
সাচনা বাজারের সমস্যা নিয়ে সংবাদ পরিবেশনের তাগিদ দিয়ে বণিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি চিত্ত রঞ্জন পাল বলেন, আমার দোকানের সামনের কাদাজলের বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। এটি সংস্কারে ইউএনও মহোদয় বণিক সমিতি থেকে অর্ধেক টাকা দেওয়ার জন্য বলেছেন। কিন্তু আমাদের তো ফান্ড নেই। বাজারের দুর্ভোগ নিয়ে মানুষ বিভিন্ন ধরনের কথা বলে। কিন্তু প্রশাসন আমাদের পাত্তা দেয় না। অথচ এই বাজার থেকে কোটি টাকা রাজস্ব নিচ্ছে সরকার।
সাচনা বাজার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাসুক মিয়া বলেন, পানি জমা স্থানে দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাজারের জমা শতকরা ছয় টাকা তোলার নিয়ম আছে। যদি এর ব্যত্যয় হয় তাহলে কেউ অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এসব সমস্যা বণিক সমিতি দেখার কথা। কিন্তু বণিক সমিতি যেখানে ঠিক না, সেখানে ভালো-মন্দ দেখবে কে? এ সমিতি বাদ দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুশফিকীন নূর বলেন, দুর্ভোগ লাঘবে ইতিমধ্যে আমরা বিশ লাখ টাকা ব্যয়ে একটা রাস্তার কাজ করে দিয়েছি। ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বাজারের নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্ন কর্মীসহ সব ক্ষেত্রে পরিকল্পনা আছে। আগামী অর্থবছরে এসব কাজ বাস্তবায়নের চেষ্টা করব।
বাজারের উন্নয়নে ব্যবসায়ীদেরকেই উদ্যোগী হতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বাজারে এই মুহূর্তে কোন বণিক সমিতি নেই। নামকাওয়াস্তে যে সমিতি আছে সেটা নিবন্ধিত না। তাদের কর্মকান্ডে আমরা হতাশ। নিবন্ধিত হয়ে কমিটি নির্বাচনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচিত কমিটি হলে পরামর্শক্রমে বাজার উন্নয়নে কাজ করা হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
অভিভাবকহীন সাচনা বাজার
কাদাজলে নষ্ট ভাটির বন্দরের সুনাম
- আপলোড সময় : ২৬-০৬-২০২৫ ০১:৩১:০৪ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৬-০৬-২০২৫ ০১:৪০:৪৬ পূর্বাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ