শহীদনূর আহমেদ ::
ধর্মপাশা উপজেলার সদর ইউনিয়নের মগুয়ারচর গ্রামের ৬৫ বছরের বৃদ্ধা আয়েশা বেগম ৩১ মে দুপুরে বাড়ির পুকুরে গোসল করছিলেন। হঠাৎ ঝড়বৃষ্টি শুরু হলে পুকুরঘাট থেকে দ্রুত ঘরে ফিরছিলেন। ঘরে প্রবেশের মাত্র কয়েক ফুট দূরত্বে থাকা অবস্থায় আকস্মিক বজ্রপাতে ঝলসে যায় তার দেহ। দুর্ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
২৮ মে দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের বক্তারপুর গ্রামের ১৪ বছরের কিশোর আমির হোসেন ওইদিন দুপুরে গ্রামের পাশের হাওরে কৃষক বাবা ফয়জল হকের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে বজ্রাঘাতে হাওরেই মৃত্যু হয় তার।
এভাবে গত তিন মাসে বজ্রপাতের কবলে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন অন্তত ২২ জন। হাওরে ধান কাটা, শুকানো, মাছ শিকার বা গবাদি পশু চড়াতে গিয়ে বজ্রাঘাতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ।
সূত্র বলছে, গত ১১ বছরে (২০১৫ সাল থেকে ২০২৫ সালের ৩১ মে পর্যন্ত) সুনামগঞ্জ জেলার ১২ উপজেলায় ১৮২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ প্রান্তিক ও অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের শিশু, নারী, কিশোর, যুবক, জেলে রয়েছেন।
সুনামগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্রে জানাগেছে, জেলায় ২০১৫ সালে ৩৭ জন, ২০১৬ সালে ২০ জন ও ২০১৭ সালে ১১ জন; ২০১৮ সালে ২৬ জন, ২০১৯ সালে ৯ জন, ২০২০ সালে ১১ জন, ২০২১ সালে ১১ জন; ২০২২ সালে ১৯ জন, ২০২৩ সালে ১০ জন, ২০২৪ সালে ৭ জন এবং চলতি বছর ৩১ মে পর্যন্ত ২২ জনসহ ১৮২ জনের বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে।
হাওরপাড়ের মানুষরা জানিয়েছেন, বজ্রপাত এখন হাওরবাসীর জন্য ভয়ংকর আতঙ্ক। কোনো পূর্ব সংকেত ছাড়াই বজ্রপাতের কবলে মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়ছেন হাওরে নারী, পুরুষসহ শিশুরা। জেলার সচেতন মহল বলছেন, হাওরাঞ্চলের কৃষকরা আবহাওয়া ও বজ্রপাতের আগাম তথ্য পাচ্ছেন না। এছাড়া অসচেতনতার জন্য বজ্রাঘাতে মৃত্যুবরণ করেছেন অনেকেই। বজ্রপাত প্রতিরোধে সময় উপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় প্রতি বছরই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। অন্যদিকে উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশেহারা হচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা। পিয়ার-রিভিউ জার্নাল হেলিয়ন এ প্রকাশিত গবেষণা ‘বাংলাদেশে বজ্রপাত পরিস্থিতির ওপর জিআইএস-ভিত্তিক স্থানিক বিশ্লেষণ’ এ বলা হয়েছে, বেশিরভাগ প্রাণহানি বর্ষা পূর্ববর্তী মৌসুম এবং বর্ষা ঋতুতে ঘটে, যার মধ্যে উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে সুুনামগঞ্জ জেলা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। এতে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে আবহাওয়ার ধরন ও বৈশিষ্ট্য ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। যার ফলে দীর্ঘস্থায়ী তাপপ্রবাহ, শৈত্যপ্রবাহ এবং ঋতু পরিবর্তনের মতো ঘটনা ঘটছে। এ কারণেই বজ্রপাত বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বজ্রপাতে বছরে গড়ে মারা যান ৩২০ জন।
সুনামগঞ্জ দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। আবহাওয়া-জলবায়ু পরিবর্তনে ফলে দিন দিন এই অঞ্চলের পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব হোসেন। বজ্রসহ ঝড়বৃষ্টি হওয়ার কারণ সম্পর্কে এই আবহাওয়াবিদ বলছেন, নদী শুকিয়ে যাওয়া, বায়ুদূষণ, জলাভূমি ভরাট হওয়া আর গাছ ধ্বংস করায় দেশে তাপমাত্রা এক থেকে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। এতে বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে ভেসে আসা আর্দ্র বায়ু আর উত্তরে হিমালয় থেকে আসা শুষ্ক বায়ুর মিলনে বজ্রঝড়ের সৃষ্টি হচ্ছে। যখনই বজ্রঝড় শুরু হবে তখন বাইরে অবস্থান না করার পরামর্শ দিয়ে এই জলবায়ু বিশেষজ্ঞ বলেন, বজ্রঝড় সচরাচর ৩০-৪৫ মিনিটের মতো স্থায়ী হয়। এই সময়টিতে ঘরে থাকতে পারলেই ভালো। আর যদি ঘরের বাইরেও থাকেন তাহলে অবশ্যই নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হবে। কখন বুঝবেন বজ্রপাত হচ্ছে : গভীর ও উলম্ব আকৃতির মেঘ দেখলেই বুঝবেন বজ্রঝড় হতে পারে।
বজ্রপাত হওয়ার আগের মুহূর্তে কয়েকটি লক্ষণে তা বোঝা যেতে পারে। যেমন বিদ্যুতের প্রভাবে ব্যক্তি চুল খাড়া হয়ে যাবে, ত্বক শিরশির করবে বা বিদ্যুৎ অনুভূত হবে। এ সময় আশপাশের ধাতব পদার্থ কাঁপতে পারে। এমন পরিস্থিতি অনুভব করলে দ্রুত বজ্রপাত থেকে বাঁচতে প্রস্তুতি নিতে হবে।
বজ্রপাতের সময় করণীয় : এমন কোনো স্থানে যাবেন না, যে স্থানে আপনিই উঁচু। বজ্রপাতের সময় ধানক্ষেত বা বড় মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে যান। বাড়ির ছাদ কিংবা উঁচু কোনো স্থানে থাকলে দ্রুত সেখান থেকে নেমেযান। বজ্রপাতের সময় আপনি যদি ছোট কোনো পুকুরে সাঁতার কাটেন বা জলাবদ্ধ স্থানে থাকেন তাহলে সেখান থেকে সরে পড়ুন। পানি খুব বেশি বিদ্যুৎ পরিবাহী। মাটিতে শুয়ে পড়লে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। বজ্রপাতের সময় চামড়ার ভেজা জুতা বা খালি পায়ে থাকা খুবই বিপজ্জনক। এ সময় বিদ্যুৎ অপরিবাহী রাবারের জুতা সবচেয়ে নিরাপদ। বজ্রপাতের সময় যে কাজ করা যাবে না : ঘন ঘন বজ্রপাত হতে থাকলে কোনো অবস্থাতেই খোলা বা উঁচু স্থানে থাকা যাবে না। সবচেয়ে ভালো হয় কোনো একটি পাকা দালানের নিচে আশ্রয় নিতে পারলে। উঁচু গাছপালা বা বিদ্যুতের খুঁটিতে বজ্রপাতের সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই এসব স্থানে আশ্রয় নেবেন না। খোলা স্থানে বিচ্ছিন্ন একটি যাত্রী ছাউনি, তালগাছ বা বড় গাছ ইত্যাদিতে বজ্রপাত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি থাকে। বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি থাকবেন না। জানালা বন্ধ রাখুন এবং ঘরের ভেতর থাকুন। বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করবেন না। বজ্রপাতের সময় বৈদ্যুতিক সংযোগযুক্ত সব যন্ত্রপাতি স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।
বজ্রপাতে আক্রান্ত হলে করণীয় : বজ্রপাতে অনাকাঙ্খিতভাবে যদি আক্রান্ত হলে দ্রত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। বজ্রপাতে আক্রান্ত হলেই সবাই তাৎক্ষণিকভাবে মারা যান এমন না। তাই দ্রুত নিকটস্থ চিকিৎসাকেন্দ্র নিয়ে যান। বজ্রপাতে আহত হলে না ভেবেই ওই ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃৎস্পন্দন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালান।
এদিকে সুনামগঞ্জ অঞ্চলে বজ্রপাত প্রতিরোধে বজ্রনিরোধক দ- স্থাপন, তালগাছ রোপণসহ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও কার্যকর হয়নি এ সকল উদ্যোগ।
তাই বজ্রপাত মোকাবেলায় আরও গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করেন জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া। তিনি বলেন, সুনামগঞ্জ দেশের অন্যতম বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায়। প্রতিবছর এখানে বজ্রপাতের কবলে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। এমনটা ঘটতে দেয়া যায় না। স্থানীয়দের মধ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি সরকারের উচিত এই দুর্যোগ মোকাবেলায় গবেষণা করে করণীয় পদক্ষেপ আবিষ্কার করা। এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলে আমাদের পক্ষ থেকে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
হাওরে আতঙ্কের নাম বজ্রপাত, ১০ বছরে ১৮২ জনের মৃত্যু
- আপলোড সময় : ০৫-০৬-২০২৫ ১২:৫৭:৩০ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৫-০৬-২০২৫ ০৯:১৭:১৪ পূর্বাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ