তৃণা দে::
হাওর-বাওরের জেলা সুনামগঞ্জ আমার জন্মস্থান। সুনামগঞ্জ পৌর শহরেই বসবাস। বাবা একজন শ্রমজীবী মানুষ। বাবার শ্রমে ঘামে স্বল্প আয়ের সংসারে আমাদের তিন বোনের বেড়ে ওঠা। ছোটবেলা থেকেই অভাব দেখেছি। শিক্ষাগ্রহণ তো অনেক দূরের কথা, শুধু খেয়ে বাঁচার লড়াইটাই ছিলো অনেক কঠিন। একে তো দরিদ্রতা, তার উপরে সন্তান তিনটি মেয়ে। সমাজ ও পরিবারের দৃষ্টিতে এ যেন অভিশাপ। বৈষম্যপূর্ণ সমাজ ও পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি কঠোর। মেয়েদের লেখাপড়া করিয়ে কী হবে? বংশের প্রদীপ তো ছেলে। মায়ের কাছে শুনেছি অনেকে বাসার কাজের জন্যও আমাদের নিতে চাইতো। কিন্তু অদৃষ্টে বুঝি অন্যকিছুই লেখা ছিলো। আমার স্বল্প লেখাপড়া জানা মা আমাদের তিন বোনের জীবনের মোড় ঘুরানো একজন মানুষ। মায়ের হাতেই লেখাপড়ার হাতেখড়ি। বর্ণ অক্ষর, যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগের সাথে পরিচয় করিয়েছেন মা’ই। মা সেলাইয়ের কাজ করতেন। অভাব-অনটনের এই সংসারে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করে পড়ালেখা চালিয়ে গেছি।
২০১৪ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সুনামগঞ্জ জেলা শাখায় আমার যুক্ত হওয়া। সংগঠনের একজন সংগঠক রাশিদা বেগম (বর্তমান লিগ্যাল এইড সম্পাদক) পিসির হাত ধরেই সংগঠনে প্রথম আসা। সেই সময়ে পিসি আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন। তিনি প্রতিদিন বিকালে আমাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে আসতেন মহিলা পরিষদে। ঘরমুখো মেয়ে ছিলাম। খুব প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে খুব একটা বের হতাম না। মহিলা পরিষদে যেতেও ভীষণ অনীহা। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সুনামগঞ্জ জেলা শাখার অফিস আর আমাদের বাসা একই পাড়ায়। সেই সুবাদে মাঝে মাঝে পাড়ার গলি থেকে মহিলা পরিষদের মিছিল দেখতাম। অসংখ্য নারীর অংশগ্রহণে বিশাল সেই নারী সমাবেশ দূর থেকেই দেখেছি। একসময় মহিলা পরিষদে তরুণী সদস্য হিসেবে যুক্ত হলাম। মহিলা পরিষদে এসে দেখলাম সপ্তাহের প্রতি বুধবারে তৃণমূল নারীদের নিয়ে সংবাদপত্র পাঠের আসর অনুষ্ঠিত হয়। তরুণীরা পত্রিকা পাঠ করছে, আর তৃণমূলের নারীরা তা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। আমি পাঠ করতে ভালোবাসতাম। তাই সাগ্রহে পত্রিকা হাতে নিয়ে পাঠে অংশগ্রহণ করলাম। ক্রমশ ভালোলাগা তৈরি হয়। প্রতিদিন যে পথে আসা-যাওয়া করতাম অনেকের কৌতূহল কোথায় যাই! মহিলা পরিষদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করি। ধীরে ধীরে মহিলা পরিষদকে আরো কাছ থেকে জানার সুযোগ পেয়েছি। পরিচিত হয়েছি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করা অনেক মহীয়সী নারীনেত্রীর সঙ্গে। জেনেছি আমার জন্মস্থান সুনামগঞ্জ জেলায় নারীর সমঅধিকার, সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন করা নারীনেত্রী শ্রদ্ধেয় দিপালী চক্রবর্তী সম্পর্কে। প্রতিবছর ৩১ মে মহিলা পরিষদে উনার প্রয়াণ দিবসে জেলা শাখায় স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের নেতৃবৃন্দ শ্রদ্ধাভরে উনাকে স্মরণ করেন। উনার সংগ্রামী জীবন নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন। উনার জীবনগাঁথা শুনে গর্ববোধ করি এই ভেবে, ক্ষণজন্মা একজন মহীয়সীর বসবাস আর আমার জন্মস্থান একই পাড়ায়। ২০২০ সালে কোভিড ১৯ মহামারীর সময়টাতেও উনার প্রয়াণ দিবস পালিত হয় ভার্চুয়ালি। সেখানে আমিও যুক্ত ছিলাম। আজ উনার প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি প্রাতঃস্মরণীয়া দিপালী চক্রবর্তীকে। পরিবারের সকল প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে যে নারী আমাদের লেখাপড়া শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্নের পেছনে ছিলো দিপালী চক্রবর্তীর প্রভাব। একজন গৃহবধূ থেকে প্রগতিশীল সকল প্রকার আন্দোলনের তিনি ছিলেন একজন বলিষ্ঠ যোদ্ধা। উনার সঙ্গে সরাসরি দেখা হয়নি আমার এবং উনাকে নিয়ে লেখার যোগ্যতাও আমার নেই। মহিলা পরিষদে আসার পর জেলা নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন লেখা থেকে যতটুকু জেনেছি তারই বহিঃপ্রকাশ করছি। আজ থেকে প্রায় ৬ দশক পূর্বে এই প্রত্যন্ত মহকুমা শহরে একজন নারী সমাজ, সংসারের রক্ষণশীলতা এবং বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে এগিয়ে এসেছিলেন নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। তিনি নারীনেত্রী শ্রদ্ধেয় দিপালী চক্রবর্তী। ১৯৩৩ সালের ৫ জানুয়ারি জগন্নাথপুর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামে সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সত্যেন্দ্র চৌধুরী এবং মাতা হীরালতা চৌধুরী। শিক্ষার হাতেখড়ি পরিবার থেকেই। স্বামী মনোরঞ্জন চক্রবর্তী। তাঁদের দু’জনেরই সঙ্গীতের প্রতি ছিলো অগাধ ভালোবাসা । ষাটের দশকে ষষ্ঠ সন্তানের জন্মের পর দিপালী চক্রবর্তী এস.এস.সি পাস করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে তিনি কলেজে ভর্তি হন। তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় একজন বিবাহিত গৃহবধূর কলেজে পড়া ছিলো স্বপ্নের মতো। সেখানে তিনি সংসার এবং সন্তানদের সামলে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন এবং উচ্চশিক্ষা লাভ করেছেন। পরিবার, সমাজের ধর্মীয় প্রথা, কুসংস্কার, রক্ষণশীলতা ডিঙিয়ে এগিয়ে আসাটা অনেক কঠিন ছিলো। কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হন। নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। সাংস্কৃতিক আন্দোলন, বিভিন্ন প্রকার দাবি আদায়ের জন্য একজন গৃহবধু হয়ে সন্তান সম সহপাঠীদের সাথে মিছিল মিটিং এ তিনি একাকার হয়ে যেতেন। সহপাঠীদের সাথে গড়ে তুলেন সখ্যতা। কারো প্রিয় বৌদি, কারো দিদি। তাদের মধ্যে রাণী রায়, হুসনে আরা, নিরুপমা দে প্রমুখ। সুনামগঞ্জে সামাজিক, সাংস্কৃতিক সকল প্রকার প্রগতিশীল আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন শ্রদ্ধেয় দিপালী চক্রবর্তী। তিনি উদীচী’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। একাধারে অসংখ্য সংগঠনে যুক্ত ছিলেন তিনি, সর্বত্রই রেখেছেন বলিষ্ঠ ভূমিকা। উনার উকিলপাড়াস্থ বাসাটি ছিলো সামাজিক সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রগতিশীল ভাধারারার ব্যক্তিদের ঠিকানা। সেই সময়ে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রগতিশীল আন্দোলন, মিটিং-মিছিলের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিলো উনার বাসা। উনার উকিলপাড়ার বাসাটির পরিচয় ছিলো “দিপালী চক্রবর্তী’র বাসা”। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর পরিচয়ে বাসার পরিচিতি পাওয়ার বিষয়টি আজো বিরল। শ্রদ্ধেয় দিপালী চক্রবর্তী ষাটের দশকে সুনামগঞ্জ পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান পদে একজন পুরুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মাত্র হাতে গোনা ক’টা ভোটের ব্যবধানে হেরে যান তিনি। তবে এটা উনার পরাজয় নয়। ওই সময়ে একজন গৃহিণী হয়ে ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হওয়া এবং একজন পুরুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেটাই তো উনার বিজয় ছিলো। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি সপরিবারে ভারতের শরণাথী শিবিরে আশ্রয় নেন। সেখানেও তিনি শরণার্থীদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। নারীদের জীবন মান উন্নয়নে জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি লড়াই করে গেছেন। নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ১৯৯৮সালে তিনি যুক্ত হন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সুনামগঞ্জ জেলা শাখার দ্বিতীয় সম্মেলনে তিনি সভাপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তখন সংগঠনের কিছুই ছিলো না। নিয়মিত বসার জন্য মহিলা পরিষদের তখন কোনো অফিসঘর ছিলো না। শক্ত হাতে হাল ধরলেন তিনি। কর্মী সংগঠকদের উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে উনার বাসার ড্রয়িংরুমে বসার ব্যবস্থা করেন। সংগঠনের কার্যক্রম বৃদ্ধি পাওয়ার পর বাসার একটি ঘর বিনাভাড়ায় ব্যবহারের সুযোগ করে দেন। আজকের নারীদের এই পথচলাটাও হয়তো সহজ হতো না। তিনি নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে আওয়াজ তুলেছিলেন বলেই আজ এই প্রত্যন্ত শহরে নারীদের নির্বিঘেœ পথচলা সম্ভব হয়েছে। পরিবার, সমাজের কুসংস্কার বৈষম্যের বেড়াজাল ভেঙে আজ হাজার হাজার নারী সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসেছে। ২০০৩ সালের ৩১ মে মহীয়সী নারীনেত্রী দিপালী চক্রবর্তী মারা যান। উনার মৃত্যুতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সুনামগঞ্জ জেলা শাখা নাগরিক শোক সভার আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সুনামগঞ্জ জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শীলা রায়। শহরের উকিলপাড়াস্থ প্রেসক্লাবের হলরুমে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ভাটি বাংলার প্রাণপুরুষ কমরেড বরুণ রায়, প্রয়াত অ্যাড. বজলুল মজিদ চৌধুরী (খসরু), অ্যাড. সালেহ আহমেদ, সালেহা বেগম, দিপালী চক্রবর্তীর কন্যা রত্না চক্রবর্তী প্রমুখ। কমরেড বরুণ রায় তাঁর বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘আমার জানামতে এই শহরে একজন নারীর নাগরিক শোকসভা এই প্রথম।’’ তিনি কর্মের মধ্যে অমর হয়ে থাকবেন। আজ উনার প্রয়াণ দিবসে সহস্র প্রণাম।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
আজি প্রণমি তোমায়
- আপলোড সময় : ৩১-০৫-২০২৫ ১২:৫৪:৩৭ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ৩১-০৫-২০২৫ ০১:০০:১৬ পূর্বাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ