সুনামগঞ্জ , শনিবার, ৩১ মে ২০২৫ , ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
রুট পাল্টে নৌপথে সক্রিয় চোরাকারবারিরা প্রশাসনের জব্দকৃত বালুভর্তি বাল্কহেড উধাও! তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় হাওরে ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ দাবি নারীনেত্রী দিপালী চক্রবর্তী’র ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ভারী বর্ষণ ও ঢলে বাড়ছে নদ-নদীর পানি, বড় বন্যার আশঙ্কা নেই সাবেক প্রেমিকাকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতের পর আত্মহত্যার চেষ্টা ছাত্রলীগ নেতার রঙ্গারচরে ভিজিএফ কর্মসূচির চাল বিতরণ জেলা প্রশাসনের অনন্য উদ্যোগ : সবুজের সন্ধানে নতুন যাত্রা দ্রুত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করুন : তারেক রহমান গণতন্ত্র পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে : খালেদা জিয়া তাহিরপুরের ৪টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই জনবল সংকট, চরম ভোগান্তিতে মানুষ সুনামগঞ্জসহ ৬ জেলায় বন্যার শঙ্কা দেড় কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ এবার সুনামগঞ্জ সীমান্তে ১৬ জনকে ঠেলে পাঠিয়েছে বিএসএফ : সতর্ক অবস্থানে বিজিবি ঠিকাদারের দখলে বিদ্যালয়ের মাঠ, প্রায় তিন বছর ধরে খেলাধুলা বন্ধ সুনামগঞ্জের ক্রীড়াঙ্গনে উন্নয়ন ও সংস্কারে নানা উদ্যোগ গৃহীত সহকারী শিক্ষকের নানা ‘অপকর্মের’ প্রতিবাদে বিক্ষোভ দোয়ারাবাজার সীমান্তে ৩ অনুপ্রবেশকারী আটক ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের উদ্যোগে দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে চোখের ছানি অপারেশন

দুর্যোগে রক্ষাকবচ পাগনার হাওরের সাত করচ বাগান

  • আপলোড সময় : ২৭-০৫-২০২৫ ১২:৪৩:৩৭ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২৭-০৫-২০২৫ ১২:৪৯:০৫ পূর্বাহ্ন
দুর্যোগে রক্ষাকবচ পাগনার হাওরের সাত করচ বাগান
শামস শামীম::
জলবায়ু সংকটের কারণে হাওর-সমতল-পাহাড় সর্বত্রই প্রাণ প্রকৃতি-প্রতিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। জলবায়ু মোকাবেলায় কার্যকর উদ্যোগের অভাবে সংকট আরো ঘনিভূত হচ্ছে।
এই দুঃসংবাদের সময় আশা দেখাচ্ছে পাগনার হাওরের ৭টি দৃষ্টিনন্দন করচ বাগান। প্রকৃতিতে বিশুদ্ধ নান্দনিকতা প্রদর্শনের সঙ্গে বর্ষা-হেমন্তে নির্মল বায়ু, ছায়া এবং দুর্গম হাওরে বর্ষায় উত্তাল আফাল (উত্তাল ঢেউ) থেকে প্রাকৃতিক ঢাল বা রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে বাগানগুলো।
জামালগঞ্জ উপজেলা পরিষদ ও সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডিস (সিএনআরএস) সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার দুর্গম হাওর এলাকায় পরিবেশ ও প্রতিবেশ প্রকল্পে ১৯৯৯ সন থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত হাওরের জলাবন হিজল-করচ লাগানোর কার্যক্রম শুরু করে উন্নয়ন সংগঠন সিএনআরএস। তারা বেছে নেয় দুর্গম পাগনার হাওরের নয় মৌজা এলাকাসহ কয়েকটি এলাকা। সংস্থাটি এসইএমপি ( সাসটেইনেবল এন্ড এনভায়রনমেন্ট প্রজেক্ট)-এ হাওরের কান্দা, জাঙ্গালে, হাওরের নদী ও খালের তীরে পরিকল্পিত হিজল করচের বাগান লাগানো শুরু করে। কোথাও সরকারি ভূমিতে এবং কোথাও ব্যক্তিমালিকানাধীন গ্রামীণ এজমালি (যৌথ) জায়গায় এই বৃক্ষ রোপণ করা হয়। ওই সময়ে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের হাওর-খাল-নদীর তীরে ৩০টি বাগান সৃজন করে সংস্থাটি। প্রতিটি বাগানে ৮-১০ হাজার করচ বৃক্ষ লাগানো হয়। অল্প হিজল বৃক্ষও লাগানো হয়েছিল। তবে সেগুলো পরিচর্যা ও সংরক্ষণের অভাবে মারা গেছে। ত্রিশটির মধ্যে টিকে থাকে ১০টি বাগান। যা এখন দৃষ্টিনন্দনে পরিণত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, স্থানীয় সুবিধাভোগী নারী পুরুষদের সংগঠিত করে বাস্তবায়ন শুরু হয় হাওরের এই করচ বাগান লাগানোর কার্যক্রম।
এর মধ্যে ফেনারবাঁক ইউনিয়নের ফেনারবাঁক, বিনাজুড়া, কামারগাঁও, ছয়হারা, খুজারগাঁও, মাতারগাঁও ও ভাটি দৌলতপুর করচ বাগানটি পরিচর্যার ফলে বেঁচে যায়। বাগানের সারি সারি বৃক্ষ ধিরে ধিরে সৌন্দর্য্যরে ছায়াময় ডালা বিছাতে শুরু করে। ৩০টি বাগানের মধ্যে ২০টিই পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। নয় মৌজার উপরোক্ত সাতটি বাগানসহ একই উপজেলার শুকদেবপুর, শরিফপুর, বদরপুরে বাগানের কিছু বৃক্ষ বেঁচে গেছে।
জামালগঞ্জের বেহেলির কিছু এলাকায়ও তখন সিবিডব্লিউএম (কমিউনিটি বেইজড ওয়েটলেন্ড ম্যানেজমেন্ট) প্রকল্পে আরো কিছু বৃক্ষ লাগানো হয়েছিল।
২০০৩ সালে প্রকল্পের কার্যক্রম শেষ হয়ে গেলে হাওরে পরিকল্পিত এই বনায়ন কার্যক্রম শেষ হয়ে যায়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রাম কমিটি করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওস্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অবগত ও সহায়তা নিয়ে কর্তৃপক্ষ বাগানটির কাজ শুরু করে।
স্থানীয় সুবিধাভোগীদের দেওয়া হয় প্রশিক্ষণ। বাগানে পারিশ্রমিক নিয়ে নিজেরাই শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন গ্রাম কমিটির লোকজনসহ শ্রমিকরা। পরবর্তীতে বাগানের সুরক্ষা ও ভবিষ্যতের জন্য বাগান এলাকা বন্দোবস্তের জন্য আবেদন করা হয় গ্রাম কমিটির মাধ্যমে। কিন্তু কমিটিকে বাগানের ভূমি ইজারা দেওয়া না হলেও একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী সুদূরপ্রসারী অসৎ চিন্তা মাথায় রেখে দৌলতপুর, বিনাজুড়া ও কামারগাঁওয়ের বাগানের কিছু অংশসহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমি গোপনে বন্দোবস্ত নিয়ে গেছে। ভবিষ্যতে তারা মালিকানা দাবি করে দৃষ্টিনন্দন বাগানটি নিজেদের ঘোষণা করতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন স্থানীয় লোকজন ও পরিবেশবিদরা।

সরেজমিনে সম্প্রতি পাগনার হাওরের কানাইখালী নদী ও পাগনার হাওর ঘিরে দৃষ্টিনন্দন বাগান ঘুরে দেখা যায় তীব্র গরমের মধ্যে কৃষকরা গাছের ছায়ায় জিরুচ্ছেন। অনেকে খলাঘর করে গ্রীষ্মের ভ্যাপসা গরম থেকে রক্ষার জন্য অবস্থান করছেন। বাগানের ফাঁকে ফাঁকে কৃষকদের গবাদিপশুও ঘাস খাচ্ছে। বাগানের ভিতর দিয়ে মাটির রাস্তা ধরে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যাতায়াত করছেন এলাকার মানুষজন। কিছু পর্যটকও দেখা গেল বাগানের ভিতর দিয়ে সৌন্দর্য্য দেখছেন। ছবি তোলছেন প্রকৃতির সঙ্গে। বাগানে ‘বউ কথা কও’ পাখির দল গান গাচ্ছে অবিরাম।
স্থানীয়রা জানান, সবকটি করচ বাগানে বউ কথা কউ পাখি মধুর সুরে গান গায় রাতদিন। তাই বাগানে এক অন্যরকম সাঙ্গীতিক আবহ বিরাজ করে। প্রকৃতিতে যখন বাগানগুলোর সৌন্দর্য্য বিলাচ্ছে তখন দেখা গেল প্রতিটি বাগানেই গোড়া সমেত কাটা কিছু বৃক্ষ। স্থানীয়রা জানালেন, বিভিন্ন এলাকার দুষ্কৃতকারীরা বর্ষায় করাত দিয়ে দূরদূরান্ত থেকে এসে নৌকা ভরে বৃক্ষ কেটে নিয়ে যায়।
বাগান তৈরি কালীন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত সিএনআরএসের সাবেক কর্মকর্তা অনীল চক্রবর্তী বলেন, ১৯৯৯-২০০৩ সাল পর্যন্ত আমরা বাগানগুলো তৈরি করে সরকারি খাস ভূমিতে। এর মধ্যে কিছু এজমালি জমিও রয়েছে। বাগান করার সময় হাওরের দরিদ্র নারী পুরুষের কর্মসংস্থানও হয়। তারা নিজেদের পরিবেশ রক্ষায় কাজ করেন। সংগঠন করে তাদেরকে আমরা প্রস্তুত ও তৈরি করেছিলাম। পরবর্তীতে তারা বাগান এলাকা গ্রাম কমিটির নামে বন্দোবস্তের জন্য আবেদন করলেও গ্রাম কমিটিকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়নি। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর আমরা চলে আসলেও নয় মৌজা এলাকার মানুষ বাগানগুলো রক্ষা করেন। এখন বাগানটি সুন্দর হয়েছে। তবে কিছু লোক এই সুযোগে বাগান এলাকা গোপনে ইজারা নিয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। ভবিষ্যতে এ নিয়ে জটিলতা দেখা দিতে পারে বলে জানান তিনি।

রাঙ্গামাটি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুর কাছ থেকে শুনে দুর্গম এলাকায় করচ বাগান দেখতে এসেছেন অসীম চাকমা।
তিনি বলেন, আমি পাহাড়ের মানুষ। হাওরে এসে দীর্ঘ করচ বাগান দেখে আমার মনটা জুড়িয়ে গেল। তীব্র গরমের সময় প্রশান্তির ছায়া ও প্রকৃতির বিশুদ্ধ বাতাসে প্রাণ ভরে নিঃশাস নিয়েছি। এটাকে কেন্দ্র করে হাওরে বিরাট পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে। বাগানটির সুরক্ষা প্রয়োজন।

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, হাওরের প্রাণ ও প্রকৃতি এখন হুমকির মুখে। এক সময় হাওরে প্রাকৃতিক অনেক বাগান ছিল। বাগানগুলোর ডালপালা হাওরের পোকা মাকড় মাছের খাদ্য যোগান দিতো। নয় মৌজার এই বাগানগুলো স্থানীয়রা তৈরি করেছেন। তিনি বলেন, জলবায়ুর প্রভাব হাওরেও পড়েছে। যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা না, গরম পড়ার কথা না তখন উল্টোটা হচ্ছে। আগাম বন্যা হচ্ছে। এতে মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। এই বাগান জলবায়ুর এই পরিবর্তনের খারাপ প্রভাবের সময় আমাদেরকে নানাভাবে উপকার করছে।
লক্ষ্মীপুর গ্রামের কিষাণী রিপা আক্তার বলেন, আমাদের এলাকায় সাতটি করচ বাগান আছে। খুব সুন্দর। হাওরে ভয়াবহ বন্যা হলেও আমাদের ক্ষতি হয়না। গাছগুলোর কারণে নদী, এলাকার সড়ক এবং ঘরবাড়ি বর্ষার আফালে (উত্তাল ঢেউ) ভাঙে না। মানুষের অনেক উপকার করছে বাগানগুলো। বৈশাখ মাসে দিনমজুর-কৃষক রোদের মধ্যে এসে এখানে আরাম খোঁজেন।

হাওরের উদ্ভিদবৈচিত্র্য গবেষক কল্লোল তালুকদার চপল বলেন, দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে করচ বাগানগুলো। যারা বাগানটি করেছেন তারা একই ধরনের গাছ লাগিয়েছেন। এখানে হাওরের অভিযোজিত বৃক্ষ প্রজাতি লাগালে প্রতিবেশের দিক দিয়ে আরো ভালো হতো। তারপরও বাগানটি প্রকৃতির বিরাট উপকার করে চলছে।

জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুশফিকীন নূর বলেন, আমাদের ফেনারবাঁক ইউনিয়নের দৃষ্টিনন্দন করচ বাগানের ডাল-পালা কেটে নিচ্ছে বলে জানতে পেরেছি। আমি সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিদের বিষয়টি অবগত করবো। তবে যারা এই কাজে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাগানগুলোর সুরক্ষায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সচেতন মানুষদেরও নজর রাখা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha

কমেন্ট বক্স
রুট পাল্টে নৌপথে সক্রিয় চোরাকারবারিরা

রুট পাল্টে নৌপথে সক্রিয় চোরাকারবারিরা